Are you over 18 and want to see adult content?
More Annotations

A complete backup of www.numerama.com/sciences/609171-pas-de-panique-lasteroide-qui-va-passer-dans-le-voisinage-de-la-terre-le-2
Are you over 18 and want to see adult content?

A complete backup of news.now.com/home/finance/player?newsId=382247
Are you over 18 and want to see adult content?

A complete backup of poltava.to/news/54610/
Are you over 18 and want to see adult content?
Favourite Annotations

A complete backup of www.viva.ro/vedete-si-evenimente/mario-fresh-de-nerecunoscut-dupa-experienta-asia-express-m-am-ingrasat-cam
Are you over 18 and want to see adult content?

A complete backup of www.gsp.ro/fotbal/liga-2/liga-2-livescore-u-cluj-egal-cu-arges-in-primul-meci-din-2020-toate-detaliile-etap
Are you over 18 and want to see adult content?

A complete backup of www.indiatoday.in/education-today/notification/story/ap-intermediate-hall-ticket-2020-for-1st-2nd-year-out-
Are you over 18 and want to see adult content?

A complete backup of larepublica.pe/espectaculos/2020/02/21/el-chavo-en-acapulco-chespirito-senor-barriga-recuerda-episodio-y-pu
Are you over 18 and want to see adult content?

A complete backup of zestadionu.pl/neymar-dziewczyna-200220-pb-zdjecia
Are you over 18 and want to see adult content?

A complete backup of www.digi24.ro/stiri/externe/un-copil-de-9-ani-batjocorit-de-colegi-pentru-ca-sufera-de-nanism-spune-ca-vrea
Are you over 18 and want to see adult content?
Text
TO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE প্রত্যেক দলের হাতেই একটা করে ছোটো পতাকা । তাই দেখে নিজের নিজের গ্রুপের খোঁজ রাখে ! – সেখানে প্রত্যেক গ্রুপের ম্যানেজার নির্দিষ্ট প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে|বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE 7. ঝিনুক. স্বপ্নের থেকেও সুন্দর ইয়োহো ভ্যালি.. "দিন চলে যায়, সবই বদলায় শুধু যে আমার এ মন যা ছিল থাকে তেমন পুরনো হয় না কত কি শোনা কথা,কত
বিধবা মায়ের বিয়ে ! -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE বিধবা মায়ের বিয়ে !একটা বিজ্ঞাপন দেখি টি ভি তে । এক দীপ নিবে গেছে মম -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
2021 - বাংলা আড্ডা Web Page প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. BANGLAADDA | LATEST BENGALI DISCUSSION, TRENDING …TRANSLATE THIS PAGEHOMEআড্ডাঘরব্লগSPEAKজন্মদিনLISTENTO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE প্রত্যেক দলের হাতেই একটা করে ছোটো পতাকা । তাই দেখে নিজের নিজের গ্রুপের খোঁজ রাখে ! – সেখানে প্রত্যেক গ্রুপের ম্যানেজার নির্দিষ্ট প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে|বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE 7. ঝিনুক. স্বপ্নের থেকেও সুন্দর ইয়োহো ভ্যালি.. "দিন চলে যায়, সবই বদলায় শুধু যে আমার এ মন যা ছিল থাকে তেমন পুরনো হয় না কত কি শোনা কথা,কত
বিধবা মায়ের বিয়ে ! -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE বিধবা মায়ের বিয়ে !একটা বিজ্ঞাপন দেখি টি ভি তে । এক দীপ নিবে গেছে মম -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
2021 - বাংলা আড্ডা Web Page প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে| আড্ডার সেরা রাঁধুনীরা:BANGLA ADDA -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE 2021 - বাংলা আড্ডা Web Page চিলি হানি এগ সানন্দা দেখে আজ বানালাম । মোগলাই মুগের ডাল নামটা শুনলেই বেশ বাদ্শাহী লাগে তাই না। সোনামুগের ডালের যা দাম তাতে তাকে আরও একটু বাদশাহী আমেজে না মুড়লে চলে না। নিরামিষ আমিষ স্যান্কস সব ধরনের পদইতো
SHARADIYA -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Download - এটিতে click করে download করে নিন pdf version| তবে আমাদের মতে ebookএ পড়াটাই বেশী উপভোগ্য|. Show Table of Content - এটি সূচীপত্র| বইয়ের শুরুতেও একটা সূচীপত্র আছে এবং সেখানে click করেও কিনওয়া চাট বাড়ি বসে কাজ করলে যাতায়াতের সময় বাঁচছে, সে কথা ঠিক কিন্তু ম্যারাথন মিটিং এর মাঝে রান্না তো দূরের কথা খাওয়ার জন্য সময় বের করাও মুশকিল। মুশকিল আসান বেগুনী অমলেট চিরাচরিত অমলেট তো অনেকবার খেয়েছেন । চলুন আজ বানিয়ে ফেলি ফিলিপিনো কায়দায়অমলেট
প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. নববর্ষ পত্রিকা -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
আড্ডাঘরের নববর্ষ সংখ্যা "ভোরাই" - থিম 'জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক মুক্তি কোথায় আছে -BANGLA ADDATRANSLATETHIS PAGE
;;;মুক্তি কোথায় আছে ! এক দেশে চারজন যুবক ছিল । রাজার ছেলে BANGLAADDA | LATEST BENGALI DISCUSSION, TRENDING …TRANSLATE THIS PAGEHOMEআড্ডাঘরব্লগSPEAKজন্মদিনLISTENTO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ডালকিমা বা কিমাডাল ডালকিমা বা কিমাডাল - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English. প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে|বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE 7. ঝিনুক. স্বপ্নের থেকেও সুন্দর ইয়োহো ভ্যালি.. "দিন চলে যায়, সবই বদলায় শুধু যে আমার এ মন যা ছিল থাকে তেমন পুরনো হয় না কত কি শোনা কথা,কত
গোলবাড়ির কষা মাংস …. নামেই জিভে জল এসে যায়, তাই না? এক বন্ধুর দেয়ালে পেলাম। আর সাথে সাথে শেয়ার করে গেলাম আপনাদের সবার সাথে। ঠিক যেমন দেখি, তেমন আঁকি স্টাইলে ডাহা টুকে দীপ নিবে গেছে মম -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
2021 - বাংলা আড্ডা Web Page নববর্ষ পত্রিকা -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
আড্ডাঘরের নববর্ষ সংখ্যা "ভোরাই" - থিম 'জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক BANGLAADDA | LATEST BENGALI DISCUSSION, TRENDING …TRANSLATE THIS PAGEHOMEআড্ডাঘরব্লগSPEAKজন্মদিনLISTENTO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ডালকিমা বা কিমাডাল ডালকিমা বা কিমাডাল - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English. প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে|বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE 7. ঝিনুক. স্বপ্নের থেকেও সুন্দর ইয়োহো ভ্যালি.. "দিন চলে যায়, সবই বদলায় শুধু যে আমার এ মন যা ছিল থাকে তেমন পুরনো হয় না কত কি শোনা কথা,কত
গোলবাড়ির কষা মাংস …. নামেই জিভে জল এসে যায়, তাই না? এক বন্ধুর দেয়ালে পেলাম। আর সাথে সাথে শেয়ার করে গেলাম আপনাদের সবার সাথে। ঠিক যেমন দেখি, তেমন আঁকি স্টাইলে ডাহা টুকে দীপ নিবে গেছে মম -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
2021 - বাংলা আড্ডা Web Page নববর্ষ পত্রিকা -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
আড্ডাঘরের নববর্ষ সংখ্যা "ভোরাই" - থিম 'জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক আড্ডার সেরা রাঁধুনীরা:BANGLA ADDA -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE 2021 - বাংলা আড্ডা Web Page MYTHOLOGY IN BENGALI || GREEK INDIAN MYTHOLOGY …TRANSLATE THIS PAGE Mythology in Bengali || Greek Indian Mythology -Bangla Adda. link. আড্ডার সেরা পৌরাণিক লেখকেরা পৌরাণিক লেখার আগেপড়ুন.
মোগলাই মুগের ডাল নামটা শুনলেই বেশ বাদ্শাহী লাগে তাই না। সোনামুগের ডালের যা দাম তাতে তাকে আরও একটু বাদশাহী আমেজে না মুড়লে চলে না। নিরামিষ আমিষ স্যান্কস সব ধরনের পদইতো
কুইক ব্রেকফাষ্ট কুইক ব্রেকফাষ্ট - Bengali Recipe -Bangla Adda কুইক ব্রেকফাষ্ট বেগুনী অমলেট চিরাচরিত অমলেট তো অনেকবার খেয়েছেন । চলুন আজ বানিয়ে ফেলি ফিলিপিনো কায়দায়অমলেট
বাদশাহি মুর্গ নামটা আমি ই দিলুম। প্রধান উপকরণ সেই চিকেন। সপ্তাহে তিনবার করেরুই কষা
এই পদটি খুব সহজেই বানানো যায় আর খেতেও খুব সুস্বাদু| SHARADIYA -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Download - এটিতে click করে download করে নিন pdf version| তবে আমাদের মতে ebookএ পড়াটাই বেশী উপভোগ্য|. Show Table of Content - এটি সূচীপত্র| বইয়ের শুরুতেও একটা সূচীপত্র আছে এবং সেখানে click করেও নববর্ষ পত্রিকা -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
আড্ডাঘরের নববর্ষ সংখ্যা "ভোরাই" - থিম 'জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. BANGLAADDA | LATEST BENGALI DISCUSSION, TRENDING …TRANSLATE THIS PAGEHOMEআড্ডাঘরব্লগSPEAKজন্মদিনLISTENTO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE প্রত্যেক দলের হাতেই একটা করে ছোটো পতাকা । তাই দেখে নিজের নিজের গ্রুপের খোঁজ রাখে ! – সেখানে প্রত্যেক গ্রুপের ম্যানেজার নির্দিষ্ট ডালকিমা বা কিমাডাল ডালকিমা বা কিমাডাল - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English.বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে| চিলি হানি এগ সানন্দা দেখে আজ বানালাম । মোগলাই মুগের ডাল নামটা শুনলেই বেশ বাদ্শাহী লাগে তাই না। সোনামুগের ডালের যা দাম তাতে তাকে আরও একটু বাদশাহী আমেজে না মুড়লে চলে না। নিরামিষ আমিষ স্যান্কস সব ধরনের পদইতো
গোলবাড়ির কষা মাংস …. নামেই জিভে জল এসে যায়, তাই না? এক বন্ধুর দেয়ালে পেলাম। আর সাথে সাথে শেয়ার করে গেলাম আপনাদের সবার সাথে। ঠিক যেমন দেখি, তেমন আঁকি স্টাইলে ডাহা টুকে BANGLAADDA | LATEST BENGALI DISCUSSION, TRENDING …TRANSLATE THIS PAGEHOMEআড্ডাঘরব্লগSPEAKজন্মদিনLISTENTO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE প্রত্যেক দলের হাতেই একটা করে ছোটো পতাকা । তাই দেখে নিজের নিজের গ্রুপের খোঁজ রাখে ! – সেখানে প্রত্যেক গ্রুপের ম্যানেজার নির্দিষ্ট ডালকিমা বা কিমাডাল ডালকিমা বা কিমাডাল - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English.বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে| চিলি হানি এগ সানন্দা দেখে আজ বানালাম । মোগলাই মুগের ডাল নামটা শুনলেই বেশ বাদ্শাহী লাগে তাই না। সোনামুগের ডালের যা দাম তাতে তাকে আরও একটু বাদশাহী আমেজে না মুড়লে চলে না। নিরামিষ আমিষ স্যান্কস সব ধরনের পদইতো
গোলবাড়ির কষা মাংস …. নামেই জিভে জল এসে যায়, তাই না? এক বন্ধুর দেয়ালে পেলাম। আর সাথে সাথে শেয়ার করে গেলাম আপনাদের সবার সাথে। ঠিক যেমন দেখি, তেমন আঁকি স্টাইলে ডাহা টুকে প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে| পটলকারি তাড়াতাড়ি পটলকারি তাড়াতাড়ি - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English. ঠান্ডাই রং বর্ষে কি ভিগে চুনর ওয়ালে রঙ্গ বর্ষে ..মনে পড়ে রেখা কিনওয়া চাট বাড়ি বসে কাজ করলে যাতায়াতের সময় বাঁচছে, সে কথা ঠিক কিন্তু ম্যারাথন মিটিং এর মাঝে রান্না তো দূরের কথা খাওয়ার জন্য সময় বের করাও মুশকিল। মুশকিল আসান SHARADIYA -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Download - এটিতে click করে download করে নিন pdf version| তবে আমাদের মতে ebookএ পড়াটাই বেশী উপভোগ্য|. Show Table of Content - এটি সূচীপত্র| বইয়ের শুরুতেও একটা সূচীপত্র আছে এবং সেখানে click করেও-BANGLA ADDA
Switch Editor. DONE. Post বেগুন বাসন্তি ছোটবেলায় দুই চক্ষে দেখতে পারতাম না এই সব্জিটা। অনেক বড় হয়ে এর প্রেমে পড়েছি। কোন অদূরদর্শী এর নাম বেগুন রেখেছিলেন কেজানে! শুনলে মনে হয়, কোনো গুণ দীপ নিবে গেছে মম -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
2021 - বাংলা আড্ডা Web Page নববর্ষ পত্রিকা -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
আড্ডাঘরের নববর্ষ সংখ্যা "ভোরাই" - থিম 'জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. BANGLAADDA | LATEST BENGALI DISCUSSION, TRENDING …TRANSLATE THIS PAGEHOMEআড্ডাঘরব্লগSPEAKজন্মদিনLISTENTO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ডালকিমা বা কিমাডাল ডালকিমা বা কিমাডাল - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English.বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। ঠান্ডাই রং বর্ষে কি ভিগে চুনর ওয়ালে রঙ্গ বর্ষে ..মনে পড়ে রেখা গোলবাড়ির কষা মাংস …. নামেই জিভে জল এসে যায়, তাই না? এক বন্ধুর দেয়ালে পেলাম। আর সাথে সাথে শেয়ার করে গেলাম আপনাদের সবার সাথে। ঠিক যেমন দেখি, তেমন আঁকি স্টাইলে ডাহা টুকে দীপ নিবে গেছে মম -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
2021 - বাংলা আড্ডা Web Page-BANGLA ADDA
Switch Editor. DONE. Post প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. BANGLAADDA | LATEST BENGALI DISCUSSION, TRENDING …TRANSLATE THIS PAGEHOMEআড্ডাঘরব্লগSPEAKজন্মদিনLISTENTO US
India’s leading bangla website brings you latest discussion, trending news, headlines across globe . Read all great cuisine recipe,travel story,lifestyle,Mythology,chat, mail,blog,photogallery,cinema and
আড্ডা ঘর -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Bangla Adda - Bringing Everything that Bengali Loves under One RoofBENGALI COOKING
নিজের পছন্দ. এই বিভাগ দেখব: ডালকিমা বা কিমাডাল ডালকিমা বা কিমাডাল - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English.বেগুনি
বেগুনির রেসিপি দেখে পাগল মনে হতে পার। বেগুনি কে না বানাতে পারে। কিন্তু একটু অন্যরকম বানিয়ে দেখুন না। ঠান্ডাই রং বর্ষে কি ভিগে চুনর ওয়ালে রঙ্গ বর্ষে ..মনে পড়ে রেখা গোলবাড়ির কষা মাংস …. নামেই জিভে জল এসে যায়, তাই না? এক বন্ধুর দেয়ালে পেলাম। আর সাথে সাথে শেয়ার করে গেলাম আপনাদের সবার সাথে। ঠিক যেমন দেখি, তেমন আঁকি স্টাইলে ডাহা টুকে দীপ নিবে গেছে মম -BANGLA ADDATRANSLATE THISPAGE
2021 - বাংলা আড্ডা Web Page-BANGLA ADDA
Switch Editor. DONE. Post প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. প্রথম পাতা -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE আড্ডাঘর. জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে| ব্লগ সূচীপত্র -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE প্রত্যেক দলের হাতেই একটা করে ছোটো পতাকা । তাই দেখে নিজের নিজের গ্রুপের খোঁজ রাখে ! – সেখানে প্রত্যেক গ্রুপের ম্যানেজার নির্দিষ্ট MYTHOLOGY IN BENGALI || GREEK INDIAN MYTHOLOGY …TRANSLATE THIS PAGE Mythology in Bengali || Greek Indian Mythology -Bangla Adda. link. আড্ডার সেরা পৌরাণিক লেখকেরা পৌরাণিক লেখার আগেপড়ুন.
চিলি হানি এগ সানন্দা দেখে আজ বানালাম । পটলকারি তাড়াতাড়ি পটলকারি তাড়াতাড়ি - Bengali Recipe -Bangla Adda. Write in Phonetic (New Beta) Switch to English. বেগুনী অমলেট চিরাচরিত অমলেট তো অনেকবার খেয়েছেন । চলুন আজ বানিয়ে ফেলি ফিলিপিনো কায়দায়অমলেট
কিনওয়া চাট বাড়ি বসে কাজ করলে যাতায়াতের সময় বাঁচছে, সে কথা ঠিক কিন্তু ম্যারাথন মিটিং এর মাঝে রান্না তো দূরের কথা খাওয়ার জন্য সময় বের করাও মুশকিল। মুশকিল আসান SHARADIYA -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE Download - এটিতে click করে download করে নিন pdf version| তবে আমাদের মতে ebookএ পড়াটাই বেশী উপভোগ্য|. Show Table of Content - এটি সূচীপত্র| বইয়ের শুরুতেও একটা সূচীপত্র আছে এবং সেখানে click করেও বেগুন বাসন্তি ছোটবেলায় দুই চক্ষে দেখতে পারতাম না এই সব্জিটা। অনেক বড় হয়ে এর প্রেমে পড়েছি। কোন অদূরদর্শী এর নাম বেগুন রেখেছিলেন কেজানে! শুনলে মনে হয়, কোনো গুণ প্রতিধ্বনি আজো কাঁদে -BANGLA ADDATRANSLATE THIS PAGE এক যে ছিল রানী. পর্ব ৬. পাশা খেলে বাঘ্ছাল খোয়ালেন শিব. স্ফটিকের হৃদয়. এক যে ছিল রানী. পর্ব ৫. Online Members:3 Guests:33* Register
* Log in
Online Members:3 Guests:33* Home
* আড্ডাঘর* ব্লগ
* নতুন ব্লগ* Speak
* প্রথম পাতা * জন্মদিন * আড্ডাঘর* ব্লগ
* নতুন বিষয় * নতুন ব্লগ* Speak Up
* Listen to Us
*
* পত্রিকা * শিউলি পর্ব (শারদীয়া) * ভোরাই (নববর্ষ পত্রিকা) * জন্মদিন * শারদোৎসব ১৪২৩ * শারদীয়া মন্তব্য * নববর্ষ পত্রিকা মন্তব্য * রেসিপি * নতুন রেসিপি * ফোটো গ্যালারি * নতুন ফোটো গ্যালারি * লাইফস্টাইল * নতুন লাইফস্টাইল * সফরনামা*
* সিনেমা * নতুন সিনেমা * পৌরাণিক * নতুন পৌরাণিক* অফবিট
* ব্যক্তিগত * আমার ঘর * আমার চিঠি * অন্যান্য* মতামত
* সদ্স্য অনুসন্ধান * সাহায্য* Contact Us
*
* নতুন ব্লগ* Speak
* Contact Us
* Just Write
* Fun Take
* Just Write
Photo
Add Photo+
আড্ডাঘর জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে| স্তুতি‚ চঞ্চল‚ হিমাদ্রী ‚ আরো যারা যারা বাংলার বাইরে বসবাস কর তাদের কাছে আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে.....ইদানীং আমাদের এখানে গণেশ চতুর্থীর খুব বাড় বাড়ন্ত দেখছি.....সব্টাই বাঙালীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়..অন্তত্ঃ আমাদের পাড়ায় যা দেখি ভিন রাজ্যের পুজোকে রীতিমত আত্নস্থ করে নিয়েছে বাঙালীরা..কিন্তু ঠিক উল্টোটা কোথাও হয় কি.. মানে জানতে চাইছি অন্য্যন্য রাজ্যে দুর্গাপুজো সম্পূর্ণ অবাঙালীদের উদ্যোগে হয় কি গত কয়েকদিন ধরে খবরে দেখছি কলকাতায় মেট্রো রেলের আণ্ডারগ্রাউন্ড টানেল বানাতে গিয়ে বেশ কিছু বাড়ী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে , আজ তো দেখলাম বউবাজার অঞ্চলে একটি পুরানো বাড়ী ভেঙেই পরছে বাসীন্দারা সব রাস্তায় । দিল্লী মেট্রো বানানোর সময় চাঁদনীচক ,চাঊরীবাজার অঞ্চলে শত শত বছরের পুরানো বাড়ীর নীচ দিয়ে টানেল বানানো হয়েছে । পেপারে পড়েছিলাম বাসীন্দারা বলেছে বাড়ীর নিচ দিয়ে টানেল গেছে জানতেই পারি নি । গন্ডোগোল টা কোথায় ???? সন্দর্পন আর প্রতিমকে শুভ জন্মদিনে প্রাণভরা ভালোবাসা‚ শুভেচ্ছা!সুস্থ থাকুক‚ আনন্দে থাকুক‚ বাবা-মায়ের বুকজুড়ে থাকুক চিরটাকাল!আমেন! চঞ্চল ও মণি দিআমাদের এখানে আজকাল ঘটা করে গণেশ পুজো হয় যেটা নাকি এতকাল জেনে এসেছি বম্বে তথা মহারাষ্ট্রের উৎ্সব বলে| এখানে কি ভাবে পুজো হয় জানি না..ওদের গণেশ পুজোতে মোদক প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়.এখানে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে দেখতে পাই |মাইকে গণপতি বাপ্পা মোরিয়া বাজছে..তাও শুনতে পাই | কথাটা তা নয় | বাংলার বাইরে ত প্রচুর দুর্গাপুজো হয় ....আমার জিজ্ঞাস্য হল এই সব পুজোর কোনটাই কি অবাঙালী উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়...তারা হয়্ত সামিল হয় কিন্তু পুজোটা হয়্ত বাঙালী রাই করে থাকে.... গণেশ পুজোর ক্ষেত্রে যেটা দেখছি ‚ আমাদের পাড়ার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছি ‚ বাঙালীরাই করছে.... আড্ডাঘর জমিয়ে আড্ডা মারুন| রাজনীতি‚ খেলাধুলো‚ পরনিন্দা-পরচর্চা‚ ভালোলাগা ছবি‚ ভালো লাগা গান সব কিছু চলবে| স্তুতি‚ চঞ্চল‚ হিমাদ্রী ‚ আরো যারা যারা বাংলার বাইরে বসবাস কর তাদের কাছে আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে.....ইদানীং আমাদের এখানে গণেশ চতুর্থীর খুব বাড় বাড়ন্ত দেখছি.....সব্টাই বাঙালীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়..অন্তত্ঃ আমাদের পাড়ায় যা দেখি ভিন রাজ্যের পুজোকে রীতিমত আত্নস্থ করে নিয়েছে বাঙালীরা..কিন্তু ঠিক উল্টোটা কোথাও হয় কি.. মানে জানতে চাইছি অন্য্যন্য রাজ্যে দুর্গাপুজো সম্পূর্ণ অবাঙালীদের উদ্যোগে হয় কি গত কয়েকদিন ধরে খবরে দেখছি কলকাতায় মেট্রো রেলের আণ্ডারগ্রাউন্ড টানেল বানাতে গিয়ে বেশ কিছু বাড়ী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে , আজ তো দেখলাম বউবাজার অঞ্চলে একটি পুরানো বাড়ী ভেঙেই পরছে বাসীন্দারা সব রাস্তায় । দিল্লী মেট্রো বানানোর সময় চাঁদনীচক ,চাঊরীবাজার অঞ্চলে শত শত বছরের পুরানো বাড়ীর নীচ দিয়ে টানেল বানানো হয়েছে । পেপারে পড়েছিলাম বাসীন্দারা বলেছে বাড়ীর নিচ দিয়ে টানেল গেছে জানতেই পারি নি । গন্ডোগোল টা কোথায় ???? সন্দর্পন আর প্রতিমকে শুভ জন্মদিনে প্রাণভরা ভালোবাসা‚ শুভেচ্ছা!সুস্থ থাকুক‚ আনন্দে থাকুক‚ বাবা-মায়ের বুকজুড়ে থাকুক চিরটাকাল!আমেন! চঞ্চল ও মণি দিআমাদের এখানে আজকাল ঘটা করে গণেশ পুজো হয় যেটা নাকি এতকাল জেনে এসেছি বম্বে তথা মহারাষ্ট্রের উৎ্সব বলে| এখানে কি ভাবে পুজো হয় জানি না..ওদের গণেশ পুজোতে মোদক প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়.এখানে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে দেখতে পাই |মাইকে গণপতি বাপ্পা মোরিয়া বাজছে..তাও শুনতে পাই | কথাটা তা নয় | বাংলার বাইরে ত প্রচুর দুর্গাপুজো হয় ....আমার জিজ্ঞাস্য হল এই সব পুজোর কোনটাই কি অবাঙালী উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়...তারা হয়্ত সামিল হয় কিন্তু পুজোটা হয়্ত বাঙালী রাই করে থাকে.... গণেশ পুজোর ক্ষেত্রে যেটা দেখছি ‚ আমাদের পাড়ার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছি ‚ বাঙালীরাই করছে.... ব্লগ ব্লগ লিখুন ব্লগ - বিষয়ভিত্তিক লেখার জায়গা| একাধিক পর্বে লিখতে পারেন‚ অনেকে মিলেও লিখতেপারেন|
চাঁদনী চকের হট্টমেলা সেদিন প্রায় দশ বার বছর পরে গিয়েছিলাম চাঁদনী চকের ভগীরথ প্লেসে । ভগীরথ প্লেস ল্যাম্পসেড ও ইলেক্ট্রিক্যাল জিনিষপত্রের খনি বলা যায় । ছোট বড় পাইকারী ও খুচরো দোকান । চারিদকে আলোর রোশনাই । ঢুকলেই মনে হয় আজ দেওয়ালি । চাঁদনী চক মানে উপচে পড়া ভিড় ,হৈচৈ , ঠেলাঠেলি । সরু অলিগলি । প্রতিটি বাঁকে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে হকার । ওপরদিকে তাকালে এক চিলতে নীল দেখা ভার । অগণিত ইলেকট্রিক , টেলিফোন আর কেবলের তার এঁকেবেঁকে জানজট সৃষ্টি করেছে । রাস্তার দুই পাসে গাড়ী পার্ক করা । তারই ফাঁক ফোকর দিয়ে গলে যেতে হয় । ফুটপাথ দিয়েও বেশ সর্ন্তপনে চলতে হয় ।ফুটপাথ জুড়ে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের জিনিষ বিক্রী হচ্ছে । একটু বেশামাল হলেই ঠেলাওলার ঠেলা বা মুটের ধাক্কা খেতে হয় । দোকানগুলো সব পুরানো অবয়বে ব্যবসা করে । বেশীর ভাগ দোকানেই নেই নিওন লাইটের চমকানি ।সাদা মাটা সাইনবোর্ড । রাস্তার ধারে দোকানের এজেন্ট দাঁড়িয়ে থাকে । কানের কাছে সমানে রানিং কমেন্ট্রী চালিয়ে যায় । সেল লাগা দিয়া সস্তে মে স্যুট , শাড়ী ,ল্যাঙ্ঘা- চোলী , নাইটি মিল রহে ...আইয়ে দেখিয়ে । ইয়ে হামারি দোকান কি কার্ড ............... হাতে ধরিয়ে দেবে এরকম শতাধিক কার্ড । একবার এরকম এক লোকের পাল্লায় পরে তার দোকানে গেছিলাম । সামনেই দোকান বলে গলির মধ্যে নিয়ে গেল । সে গলিতে সামনাসামনি বাড়ীর লোকেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হ্যাণ্ডসেক করতে পারে । একটা বেশ বাড়ী । দেখলেই বোঝা যায় কোনকালের ধনী ব্যক্তির বাড়ী ছিল ।ভেতরে ঊঠান ভর্তি দোকান । একপাশের সরু সিঁড়ি । একসাথে দুইজন ওঠা যায় না । দোতলায় বারান্দার চারিদিকের প্রতিটী ঘর এক একটি দোকান । এরকম ভাবে তিনতলা ঘুরিয়ে ছাদে নিয়ে তুলল । সে ছাদ থেকে আকাশ দেখা যায় না ।সারা ছাদ ভর্তি কাঠের পার্টিশন করা দোকান । দরজা ঠেলে একটীর ভেতরে নিয়ে গেল ।ভেতরে এয়ারকণ্ডিশন । মাটিতে ফরাস পাতা । মান্ধাতা স্টাইলে মাটিতে বসে কেনা বেচা চলছে । মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত আলমারী শাড়ী , সালোয়ার কামিজে ঠাসা । ওই টঙের ওপর দোকানে এত স্টক দেখে মাথা ঘুরে গেছিল । যারা জানে তারাই ওখানে যেতে পারে । ১৬৫০ সালে শাহজাহান কন্যা জাহানারার স্থাপনা চাঁদনী চক । লাল কেল্লার লাহোরি গেট থেকে শুরু হয়ে ফতেপুরী মসজিদে শেষ । মূল নকশা অনুযায়ী চৌকোনা বাজারটির দোকানগুলি বানানো হয়েছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে । মাঝখানে টলটলে দিঘি । এ ছাড়াও চাঁদনী রাতে ঝলমল করার জন্য বাজারের মাঝে নহের বা খাল কেটে জলের ব্যবস্থা করা ছিল । ১৯৫০ সালে সেই দিঘি বুজিয়ে ঘন্টাঘর বানানো হয়েছে । চাদনী চকের মূল রাস্তাটি তিন ভাগে বিভক্ত । লাহোরি গেট থেকে কোতয়ালী চক পর্যন্ত অংশটির নাম উর্দু বাজার । এখানে প্রধানত দরবারের উচ্চ পদাধিকারীদের বাস ছিল । কোতয়ালী থেকে মাঝখানের দিঘি অবধি জায়গা র নাম ছিল জহুরী বাজার । ওখান থেকে ফতেপুরী মসজিদ অবধি বাজারের নাম ছিল ফতেপুরী বাজার । যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ হয়েছে চাঁদনী চক । পাশাপাশি গড়ে উঠেছে শ্রী দিগম্বর জৈন মন্দির ,গৌরিশঙ্কর মন্দির ,শিব নবগ্রহ মন্দির ,ব্যপটীস্ট চার্চ ,গুরদুয়ারা শীশগঞ্জ সহিব , ফতেপুরি মসজিদ ,সুনহেরি মসজিদ । দিল্লী লুন্ঠনের সময় নাদির শাহ সুনেহরি মসজিদে বসে কোতলে -ই-আম ( দেখা মাত্র মেরে ফেল ) প্রত্যক্ষ করেছিল । তিরিশ হাজার লোকের প্রাণনাশ করেছিল ।শেষ মাথায় ফতেপুরী মসজিদের স্থাপনা করেছিল ফতেপুরী বেগম ( শাহজাহানের এক বেগম ) । জনস্ফিতির চাপে সেই সুন্দর পরিচ্ছন্ন বাজার পরিবর্তিত হয়েছে উত্তরভারতের প্রধান হোলসেল মার্কেটে । লালকেল্লার উল্টোদিকে বেগম সম্রুর প্যালেস পরিণত হয়েছে ইলেকট্রিক্যাল জিনিষের বাজার ভগীরথ প্লেস । গলি খাজাঞ্চির খাজাঞ্চি হাভেলি খুজে পাওয়া ভার । নিরাপদে টাকা পয়সা আনা নেওয়ার জন্য নাকি এই হাভেলি থেকে মাটির তলায় সুরঙ্গ দিয়ে লাল কেল্লার সাথে যোগাযোগ ছিল ।বলিমারানে মির্জা গলিবের হাভেলি অবশ্য মিউজিয়াম হয়েছে ।নীল কাটরার চুনরমল নামে এক ধনী বস্ত্র ব্যবসায়ীর হাভেলি পরিণত হয়েছে সালোয়ার কামিজের পিসের হোলসেল মার্কেটে । দিল্লী আসার প্রথম দিকে মাঝে মাঝেই লাল কেল্লার পারকিং এ গাড়ী রেখে চাঁদনী চকে যেতাম । এমনি দিনে দোকান পাট খোলা , রবিবারে মার্কেট বন্ধ কিন্তু সেদিন ফুটপাথ জুড়ে বিরাট বাজার । চাঁদনী চকের ওলিগলিতে ঘোরা একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেছিল । কত কিছু পাওয়া যেত । কিনারী বাজারে সেলাই র জিনিষ ,পাথরের সম্ভার । দরীবাকালানে ছোট ছোট সোনা চাঁদীর দোকানের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ রোমাঞ্চিত হতাম । পরোঠেওলা গলি দেখে বেশ হতাশ হয়ে ছিলাম । গলিতে পরোঠা র দোকানের থেকে শাড়ী জামাকাপড়ের দোকান বেশী । পরোঠার দোকানে যে কাল তেলে পড়োঠা ভাজছিল তা দেখে খুব একটা খেতে ভক্তি হয় নি । নীল কাটরার কিছু গলি দুইজনে একসাথে যাওয়া যায় না । কিন্তু ঢুকলে মনে হয় শাড়ী ,সালোয়ার কামিজের কাপড়ের খনিতে এসে পড়েছি । দেখেশুনে কিনতে পারলে বেশ সস্তায় পাওয়া যায় । পারকিং তুলে দেওয়ায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল ।আবার নাগালের মধ্যে এনেদিয়েছে মেট্রো । এখন চাঁদনী চক আর লাল কেল্লা দুটো স্টেশন থেকেই যাওয়া যায় । আবার জৌলুস ফিরে পাচ্ছে চাঁদনি চক । মেট্রো থেকে নেমে গলি পেরিয়ে যখন মেন রাস্তায় উঠলাম... দেখি চাঁদনী চকের ভোল একদম পালটে ফেলেছে ।চাঁদনী চকের পালে লেগেছে আধুনিকতার হাওয়া । ঝলমলে এল-ই-ডি লাইটের রোশনাই । দোকানে দোকানে কাঁচের শোকেস। জিনিষপত্র ঝলমলে আলোয় ঝিলিক মারছে । রাস্তায় ভিড় জ্যাম আছে । রিক্সার জায়গা নিয়েছে ই-রিক্সা । হলদিরাম খোলনালচে পাল্টিয়ে নতুন সাজে সেজেছে । সাজতে ত হবেই কারন পাশেই পা নাচাচ্ছে ম্যাগডোনাল্ড বাবু । নতুন জোয়ারে গা ভাসিয়েছে চক । চিরাচরিত বাঙ্গালী মিষ্টির দোকান অন্নপূর্ণা সুইটস বা ঘন্টিওলা মনে হল উঠে গেছে । শ্রাবণীর বাঁকে ১দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। বর্ষাকাল এখন, ধানের বীজতলাগুলো সবুজে সবুজ। প্রথম যখন ধান ছড়ানো হয়, এই বীজতলাতেই। তারপর একটু বড় আর ঘন হয়ে যখন এরা মনোমুগ্ধকর সবুজে ভরিয়ে দেয়, এদেরই তুলে নিয়ে গিয়ে লাগানো হয় সারা মাঠজুড়ে। কোথাও কোথাও সেই কাজ শুরুও হয়ে গেছে। গ্রামের নাম মনোহরা, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী শ্রাবণী। সারা বছর অল্পবিস্তর জল বয়ে গেলেও বর্ষাকালে, বিশেষ করে শ্রাবণ মাসে এই নদী ধারণ করে মাতৃমুর্তি। সেই জলে সমৃদ্ধ হয় এপারের গ্রাম মনোহরা আর ওপারের স্বর্ণগ্রাম, যাকে সবাই সোনাগাঁ বলেই চেনে।একটু একটু করে দৃশ্যপটে ফুটে উঠছে এপারের গ্রামখানি, মনোহরাই বটে। যেমন তার রূপ তেমনি সবুজে সবুজ। নদীর পারে একখানি খেলার মাঠ। লম্বায় চওড়ায় একটা বড় আয়তনের ফুটবল মাঠের চেয়ে কোনও অংশে কম হবে না।আজ একটা বিশেষ দিন, যে কারণে এই মাঠে এত বেশি খেলোয়ার জড়ো হয়েছে। অন্য দিন দুই দলে পাঁচ-ছয়জন করে খেলোয়াড় জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়, আর আজ, পনেরজন করে খেলছে এক এক দলে। হবে নাই বা কেন। আজ যে এই গ্রামের গ্রাম্য দেবীর পূজো। গ্রামের ছেলেরা তো এসেছেই, আর এসেছে অতিথিরা। সারাদিনের পূজোর আনন্দ কাটিয়ে বিকেলটায় অল্প খেলাধূলা হবে। খিদেটাও বেশ বেড়ে যাবে এতে। সন্ধ্যেবেলার আহারটা ভালই জমবে।অল্প কাদায় খেলাটাকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা। এমন কাউকে দেখা যাচ্ছেনা যে কর্দমাক্ত হয়নি। তবুও সম্পূর্ণ উদ্যমে চলেছে সে খেলা। দুইপাশের গোলরক্ষক মনের আনন্দে বসে ঘাস চিবোচ্ছে, আর বল ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঝমাঠে, বলা বাহুল্য বাকী সব খেলোয়ারকে ওই মাঝমাঠেই দেখা যাচ্ছে।এই ধরণের কাদা মেখে খেলার একটা সুবিধা আছে, অসুবিধাও বলা যায়। যেমন ধরুন আপনি বল দাবী করলেন অন্য দলের ছেলের কাছে, সেও নিজের দল ভেবে বল বাড়িয়ে দিল। এতে আপনার যেমন সুবিধা হল, যেকোন সময়েই আপনিও এই অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন, এটাই অসুবিধা। আরে মশাই, নিজের নিজের দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে এগারোজনের মাঠে বড় বড় খেলোয়াররা ভুল করে, আর এখানে তো...এই খেলায় যেহেতু নিরপেক্ষভাবে বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন, সেহেতু আমি মাঠের দুটো দিকের একটাকে গ্রামের দিক অর্থাৎ এদিক আর অন্যটাকে ওদিক বলে অভিহিত করব।...খেলা শুরু হওয়ার দশ মিনিট অতিক্রান্ত, এখনও পর্যন্ত কোনপক্ষই কোন গোল করতে পারেনি। অবশ্য গোল হতে গেলে ন্যুনতম বলটার স্থিতাবস্থার গতিশীল অবস্থায় পরিবর্তিত হওয়া প্রয়োজন। দুএকবার বলটার গতি এলেও তা এসেছিল মধ্যরেখা বরাবর। হবে নাই বা কেন। সার দিয়ে দুপাশে দশজন করে দাঁড়িয়ে থাকলে কি করেই বা বল এদিক ওদিক যেতে পারবে। এপাশের ট্যারা দেয় ওপাশের ভুতোকে। ভুতো আবার দুম করে একটা শট নেওয়ার চেষ্টা করে সোজা এদিকের গোল বরাবর, কিন্তু সঠিক ভাবে পায়ে-বলে না হওয়ার কারণেই হোক আর অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণেই হোক বল সোজা না এসে নব্বই ডিগ্রি গেল বেঁকে। আবার মধ্যরেখা বরাবর এপারের দিলীপ, দিলীপের থেকে বল কেড়ে নিল এপারেরই নেপাল (চিনতে ভুল করে বোধহয়)। দেখা যাক সে হয়ত নতুন কিছু করবে, কিন্তু না, দৌড়ে এসে ওপারের দুজন প্লেয়ার একসাথে পা চালাল বলের উপর। এরা সম্ভবত এই গ্রামের নয়, পুজোর ভোজ খেতে এসেছে এ-গাঁয়ের কোনও আত্মীয়বাড়ি। নেপাল একটু বল কাটাতে জানত, তাই এপা-ওপা করে বলের উপর আসা ওপারের আঘাত বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেল, আর তখনই দুর্ভাগ্যবশত সেই আঘাত গিয়ে লাগল তার নিজেরই পায়ে। বিপক্ষের জোড়া পায়ের আঘাতে ‘ওরে বাবারে’ বলে বসে পড়ল সে বলের উপরে। আরও দুচারটে লাথি কষিয়ে নেপালের থেকে বল কেড়ে নিল তারা। কি ভাবছেন? ফাউল? ওসব দাবি করে সময় নষ্ট করে না এ গাঁয়ের ছেলেরা। রেললাইনটা বেশ কিছুটা দূরে হলেও ট্রেন এলে দেখা যায়। তাই চারটের ট্রেন গেলে খেলা শুরু হয় আর ছ-টার ট্রেন এলে খেলা শেষ। এর মাঝে যদি কারও কিছু ইয়ে পায় তাহলে কাছাকাছি থাকা নিজের দলের যেকোন সদস্যের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেলেই হল। মোটকথা, কোন বিরতি এখানে দেওয়া হয়না।এইভাবেই অনেকক্ষণ ধরে মাঝমাঠে বল নিয়ে টানাহিঁচড়া করার পর এদিকে বল আসার একটা প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে এপারের রক্ষণভাগের শোভন জোরে একটা শট নিয়েই প্রচণ্ড বেগে ওপারের দিকে ছুটে গেল। যেহেতু সবাই মাঝমাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওপারে পৌঁছে বলও পেয়ে গেল সে। ওপারের গোলরক্ষক বিকাশ বেগতিক দেখে দৌড় দিল বলের পানে। এতক্ষণ পর মনে হল কিছু একটা হবে। গোলের প্রায় কাছাকাছি শোভন পৌঁছেও গেল। কিন্তু শেষ অব্দি বিকাশকে ছুটে আসতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে কিছুটা আগে থেকেই নিল প্রচণ্ড জোরে একটা শট। এপারের বাকী চোদ্দজনের সমবেত চিৎকার গোওওওওওল...; কিন্তু বল গোলের দশ হাত বাইরে দিয়ে বেঁকে হাওয়ায় অনেকটা সাঁতরে সোজা পৌঁছলো নদীর ওপারে।এবার বাঁধল গোল। কে যাবে নদীর ওপারে সেই নিয়ে। যদিও বেশিরভাগ ছেলেই সাঁতার জানে, এবং নদীটাও ততটা চওড়া নয়, কিন্তু কেউই বর্ষাকালে স্ফীত নদী ডিঙিয়ে ওপারে যেতে রাজি হল না। তাছাড়া বলটা গেছে পরিত্যক্ত জঙ্গলটার দিকে; নিতান্ত জরুরী দরকার না পড়লে সচরাচর কেউ সেদিকে যায়না। ওই গাঁয়ের রাখালদের হাঁক দিলে হয়ত বলটা খুঁজে দেবে, কিন্তু তেমন কাউকে আজ দেখাও যাচ্ছেনা। হয়ত নেমন্তন্ন খেতে এপারের বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে এসেছে কেউ কেউ সেতু পেরিয়ে। কিন্তু সে সেতু তো অনেক দূর। প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা। তাহলে কি আজ আর খেলা হবেনা?আর একটা বল অবশ্য ছিল, পরশু সেটাও লিক হয়ে গেছে। এই হয়েছে আজকাল বড় এক অশান্তি। লিক হয়ে গেলে তা সারাবার লোক পাওয়া যায়না। প্রথমে যাওয়া হয়েছিল সাইকেল সারাবার দোকানে। সে বলল, সেলাই করা বা বলের চামরা কাটা তার কাজ নয়। সে শুধু লিক সারিয়ে দেবে। অনেক কষ্ট করে একজন সেলাই করার লোক পাওয়া গেল, সে বলল সে নাকি ফুটবলে হাত লাগাবেনা। অনেক নোংরা জিনিস মিশে থাকে এর মধ্যে। আর একজন সেলাইয়ের লোক আছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে পরের হাটবারে, আরও তিনদিন পর। ততদিন এই এক্সট্রা বলটাই ছিল ভরসা, সেটাও গেল। একে তো পুজোর দিন, এই আনন্দ কি আর সারাবছর পাওয়া যায়! সুতরাং, যেকোন ভাবে বলটা এনে এখনি খেলার ব্যবস্থা করতেই হবে। কিন্তু পূজোর দিনে নদীতে নামতে কেউই রাজী নয়।তখন সবার নজর গেল ছোট্ট বিনুর দিকে। সে বেচারা রোজ খেলবার আশা নিয়ে আলপথ, মা পেরিয়ে এতদূর ছুটে আসে খেলতে সুযোগ পাওয়ার আশায়। যেদিন ছেলে খুব কম থাকে সেদিন সুযোগ পেলেও সাধারণত বড়দের সঙ্গে খেললে হাতে পায়ে লেগে যাবে এই অজুহাতে তাকে খেলতে নেওয়া হয়না। তাই গোলের পিছনে বল গেলে, কিংবা মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেলে বল কুড়িয়ে একটা দুটো শত মেরে মাঠের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়েই সে খুশী থাকে।- এই বিনু তুই একটু ওপার থেকে বলটা এনে দিবি? খেলতে পাবি তাহলে আজকে।- ধুর, এই ভিড়ের মধ্যে তোরাই খেলতে পাচ্ছিসনা আবার আমি খেলব...বিনুর সোজা সাপটা জবাব। ছোট বড় নির্বিশেষে এই মাঠে সবাই সবাইকে তুই বলেই ডাকে।- চানাচুর চলবে? পঞ্চাশ?- একশ হলে বল।একশ গ্রাম চানাচুরের চুক্তিতে বিনু নদী পার হতে রাজী হয়ে গেল। কি অপরূপ দক্ষতায় স্রোতস্বিনী নদী পার হয়ে তরতরিয়ে সে ওপারে চলে গেল। তারপর ঝোপের দিকটায় গেল বল আনতে।.........................................................................................‘মিনিট পনের কেটে গেল, এখনও ছেলেটা ফিরলনা। একবার দেখে আসা দরকার নাকি রে?’ সন্তোষ বলল।শোভন বেশ খানিকটা হতাশ হয়ে বসেছিল, মনেহয় গোলটা না হওয়ার দুঃখেই। সে এবার মুখ খুলল, ‘দেখ ফাজলামি করছে হয়ত। একবার ডেকে দেখি চল।’সবাই মিলে এক এক করে ডাক দিল তারা, কোন সাড়া নেই।কোন বিপদ হলনা তো? শেষ পর্যন্ত ওপারে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সবাই যেতে রাজী না হলেও জন দশেক ছেলে সঙ্গে পাওয়া গেল। জঙ্গলে সত্যিই যদি কোনও বিপদ থেকে থাকে তখন সবাই মিলে থাকলে একটা আলাদা মনোবল পাওয়া যায়।সাঁতরে ওপারে পৌঁছে যেটা দেখা গেল তাতে সবাই স্তব্ধ। একজন যুবকের মৃতদেহ, কিছুদিনের পুরনোই হবে, উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আর তার সামনে বসে ভিজে মাটিতে একটা কঞ্চি দিয়ে আঁক কেটে চলেছে বিনু। চারিদিক শান্ত, নিঃশব্দ।সাহস করে শোভন ডেকে বসল, ‘বিনু...বিনু...’যে ক্রোধভরা হিংস্র দৃষ্টিতে ঘুরে তাকাল বিনু, তাতে অনেকেরই হাড় হিম হয়ে গেল। চোখ মুখ লাল, দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, অথচ শরীর যেন অবশ, কারও ছোঁয়া লাগলেই পড়ে যাবে, এমন। তারপর উঠে দাঁড়াল সে। দিলীপ এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে বলটা কোথায়? অপ্রত্যাশিতভাবে, এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিল বিনু, আর দিলীপ ছিটকে গিয়ে পড়ল মাটিতে। কোমর ধরে বসে পড়ল সে। এরপর শোভন এগিয়ে গেলে, সামনে হাত বাড়িয়ে শোভনের বুকে সে এমন এক ধাক্কা দিল, হুড়মুড়িয়ে বাকি সবার উপর এসে পড়ল সে। তখন সবাই মিলে চেপে ধরে চেষ্টা করা হল বিনুকে শান্ত করার। কিন্তু ছোট্ট হাতের তখন সে কি জোর। সবাইকে ছিটকে ফেলে দেয় একসাথে।তারপর থরথর করে প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে থাকে আর বলে চলে একটাই ছড়া,‘মুখ করে পূবপানে দাঁড়া মাঝখানেসোজা গিয়ে শেষকালে ঘোর তুই ডানে।এইভাবে কর আরও তিনেক বারজেনেও যেতে পারিস কিবা হবে আর।’কয়েক বার চিৎকার করে এই ছড়া বলার পর মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। ওই ভয়ের মধ্যেও সবার মনের মধ্যে তীক্ষ্ণভাবে গেঁথে গিয়েছিল ছড়াটি। ছড়ার বয়ান অনুযায়ী পূর্বদিকে তাকায় সবাই। সেদিকে, মাটিতে কঞ্চির আঁচড়ে যে সংকেতটা আঁকা আছে, তা নিম্নরূপ,লে । চ । চাছে । ভ । যর । ড়ি । বাপুলিশকে খবর দিতেই হল এবং তদন্তের সাহায্যার্থে পুলিশকে সবটা জানানো হল। সংকেত অনুযায়ী মাঝখানে আছে ‘ভ’, সেখান থেকে সোজা গেলে ‘ভচ’ তারপর ডানদিকে ঘুরে হয় ‘ভচচা’, তারপর আরও তিনবার ডানদিকে ঘুরে পাওয়া যায় ‘ভচচাযবাড়িরছেলে’। সোনাগাঁয়ে কোন ভট্টাচার্য পরিবার থাকেনা এবং মনোহরা গ্রামে একটি মাত্র পরিবার যেখানে মা আর ছেলে বাস করেন। পুলিশ তো এই সংকেত পেয়ে মহা খুশি এবং হাতেনাতে অলৌকিক শক্তির দ্বারা যে খুনি ধরা পড়ল, সর্বোপরি তাঁরাই যে গুপ্ত সংকেত-এর মানেটা উদ্ধার করেছেন সে খবর ফলাও করে ছাপা হল।তার ফলস্বরূপ ভট্টাচার্য বাড়ির একমাত্র ছেলেকে জেল খাটতে হল খুনের অপরাধে।২নমস্কার, আমি বিকাশ, এখন থেকে এই গল্পটি আমার বয়ানে পাবেন। কারণ আগের ঘটনাটি যিনি লিখেছিলেন, সেই নিশীথবাবু মারা গিয়েছেন দুদিন হল। স্থানীয় সংবাদপত্রে তার ডায়েরী থেকে উদ্ধার পাওয়া এই ঘটনাটি ছাপা হয়েছে জন সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। বিধির কি বিধান দেখুন! জনতাকে সচেতন করা হচ্ছে যাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে, উনি নিজেই এতটা অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও রয়ে গেলেন অসচেতন এবং ঘোর মৃত্যু এসে গ্রাস করল তাঁকে।বিনুর উপর দিয়ে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর প্রায় দুবছর কেটে গেছে। এখন আমার ইঞ্জিনিয়ারিং - দ্বিতীয় বর্ষ। ক্লাস চলছে ফ্লুইড মেকানিক্স এর। প্রোফেসর দিগন্ত দেব নিজের মনে ক্লাস নিয়ে চলেছেন। এদিকে আমি নিজের মত করে লিখে চলেছি ক্লাস ডায়েরী। লাস্ট বেঞ্চে বসার এই এক সুবিধা। সেসব যাক, বরং ডায়েরীতেই মন দিইঃসেই সব দিন, পাশের বাড়ির গৌরী গেয়েই চলেছে সকাল থেকে সেই এক কর্ণপীড়াদায়ী লাইন, ‘তোড়া যে যা বলিসস ভাই, আমাড় সোনাড় হড়িন চাই’; ‘স’ এর উচ্চারণ যেখানে প্রকৃতই ‘স’ এর মত।এদিকে গ্রামের বখাটে ছেলেরা একটা ছড়া বানিয়েছে যেটা রাস্তায় ঘাটে নাকি প্রায়ই শোনা যায়, ‘ভচচায বাড়ির ছেলে/খুনের দায়ে জেলে।’ নিশীথবাবুর হঠাৎ করেই মৃত্যু হল সেই একই জায়গায়, দুবছর আগে যেখানে ওই ঘটনাটি ঘটেছিল। এত এত ঘটনা রোজ গ্রামে ঘটে চলেছে আর আমি এখানে বসে সময় নষ্ট করছি সামান্য পড়াশুনার পিছনে? যেগুলো আগেই লোকে আবিষ্কার করে গেছে, নতুন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা যেখানে নেই, থাকলেও অন্তত আমার দ্বারা যেটা সম্ভব নয়, সেই বিষয়ে পড়াশুনা করে আমি কি পাবো?- চাকরী... এই যে ক্লাসে বসে এইসব হিজবিজি লিখলে চাকরী তো দূরের কথা, পাশই করবে না। দেখি দেখি কী লিখেছ?এই বলে তিনি আমার খাতাটা কেড়ে নিলেন এবং দুচারলাইন যা লিখেছিলাম পড়লেন। তারপর খাতার ফাঁকে রাখা ভচচায বাড়ির ছেলের জেলে যাওয়ার খবরের জেরক্সটা দেখলেন এবং চুপিচুপি বললেন, ‘এটা কি ভৌতিক ঘটনা? আমি রাখতে পারি একদিনের জন্য?’কেউ বাংলা লেখা চেয়ে পড়লে মনটা খুশীতে ভরে যায়। বললাম, ‘নিশ্চয়ই রাখবেন। হ্যাঁ, এটা সত্যি ঘটনা, এবং আমার নিজের চোখে দেখা।’দিগন্তবাবুর চোখদুটো চকচক করে উঠল, অবশ্য সেটা বুঝতে না দিয়ে জেরক্সটা নিয়ে টেবিলে গেলেন এবং গম্ভীর মুখে পড়ানোয় মন দিলেন। ক্লাস শেষে ধমকের সুরে আমাকে বলে গেলেন, ‘টিফিনের পর দেখা করবে একবার আমার সঙ্গে।’টিফিনের খাওয়াদাওয়া শেষে ভয়ে ভয়ে গেলাম টিচার্স রুমে। না জানি কি ধরণের ব্যবহার করবেন তিনি আমার সাথে। উনি তখন গল্পের শেষ পাতাটা পড়ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘আরে বিকাশ যে, এসো। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই চেয়ারটায় বসো।’পাশেই বসে ছিলেন সুচন্দ্রা ম্যাডাম। উনি আমাদের মধ্যে কোনও গভীর ব্যাপারে আলোচনা হবে আন্দাজ করে উঠে গেলেন।এই ফাঁকে সুচন্দ্রা ম্যাডামের ব্যাপারে একটু বলে নিই। উনি স্বভাবে শান্ত, নিরীহ। শাড়ির সাথে কেটস জুতো পড়ে অফিস আসেন, এবং যেকোন প্রশ্নের, তা সে যত সহজই হোক না কেন, উত্তর দিলেই সারা ক্লাসকে হাততালি দিতে উৎসাহিত করেন। কোন জটিলতার মধ্যে এবং অন্যের কথায় থাকেন না। তাই হয়ত এই মুহূর্তে তিনি বেরিয়ে গেলেন।এখন দিগন্তবাবুর গম্ভীর ভাবটা কমে এসেছে। তিনি অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা সত্যি নাকি? এখানে আবার তোমার নামও আছে দেখছি। তার মানে তুমি এই পুরো ঘটনাটা সামনাসামনি দেখেছো?’‘হ্যাঁ, এবং যিনি এই গল্পটা লিখেছিলেন, তিনিও ওই একইভাবে, একই জায়গায় গতকাল মারা গেছেন।’ আমি হতাশার সুরে বললাম।‘তাহলে তো ‘ভচচায বাড়ির ছেলে’ অভিযোগটা ধোপে টেকে না? নিশ্চয়ই এরপর ছেলেটা জেল থেকে ছাড়া পাবে।’ দিগন্তবাবুর চোখে তখন উত্তেজনা ভরপুর।‘সে তো আগেই পাওয়া উচিৎ ছিল। পোস্টমর্টেমে যখন বেরোল যে শ্রী গোবিন্দনারায়ণ চৌধুরী হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন, তখন সেই পুলিশ অফিসারই পাল্টা অভিযোগ আনলেন,‘হয়ত ও জঙ্গলে গিয়ে ভয় দেখিয়ে কিম্বা অন্য কোনভাবে হার্ট অ্যাটাক হতে বাধ্য করেছে। আর তাছাড়া গোবিন্দবাবুর আত্মা যখন ওই... কি যেন নাম ছেলেটার?‘বিনু’, আমি ধরিয়ে দিলাম...‘...হ্যাঁ যখন ও বিনুর মধ্যে ঢুকে তোমাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করল, তোমরাই তো বলেছ সবকিছু, সেসব কি মিথ্যা?’এরপর আর কোনও ব্যাখ্যা চলেনা। তাছাড়া নিজে হাতে কেস সমাধা করার ক্রেডিট কেইবা হাতছাড়া করতে চায়। হয়ত বেশী কিছু বলতে গেলে ধরে ফাটকে ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু একটা খটকা আমাদের থেকেই গেল।’‘কি খটকা?’‘গোবিন্দবাবুর অশরীরী যদি বিনুর মধ্যে ঢুকেই থাকবে, তাহলে সোজাসুজি অপরাধীর নামটা বলে দিলেই তো পারতেন। এইরকম একটা বাজে ধাঁধাঁ তৈরী করে সনাক্তকরণের কি সত্যিই কোনও উদ্দেশ্য ছিল?’‘সেটা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা তুমি তো সেই সময় ওখানে ছিলে, ঠিক কি কি ঘটেছিল আর একবার বল তো। মানে এমন কিছু যা এখানে লেখা হয়নি...’‘মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বিনুর জ্ঞান ফেরানো হল। বিনু এবং আমরা তিন-চারজন বাদে বাকী সবাই ঘুরপথে বাড়ি ফিরে গেল। সাঁতার কাটার রিস্ক আর কেউই নিতে চাইল না। আমরা এতটাই হতভম্ব হয়েছিলাম যে শেষ পর্যন্ত দেখে যাওয়াই ঠিক করলাম। আমদের দুই গ্রামের থানা যেহেতু সোনাগাঁয়েই, তাই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পুলিশ এল। অবশ্য তার কিছু আগেই আমাদের গ্রামের বেশ কয়েকজন এপারে পৌঁছে গেছেন সে দৃশ্য দেখতে; নিশীথবাবুও ছিলেন। অল্প অল্প পচনের গন্ধ আসছে, তবুও নাক চেপে থেকেও দেখার সে কি আগ্রহ। আমাদের কাছ থেকে সব শুনলেন তাঁরাও। নিশীথবাবু মৃতের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন এবং উপুড় হয়ে থাকা মৃতদেহকে সোজা করলেন। কি বীভৎস সে দৃশ্য। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কি এক তীব্র আতঙ্কে।বিনু বেশ ভয় পেয়েছে বোঝা গেল। যদিও ওই হঠাৎ শক্তির উদয় হওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলতে পারল না।’‘আচ্ছা এই নিশীথবাবু লোকটি ঠিক কেমন?’‘উনি অঙ্কের টিউশনি করেন এবং শখের কবি। আমি কোনওদিন ওনার কাছে পড়িনি, কিন্তু শুনেছি বিষয়গত জ্ঞান অসাধারণ। তার বাইরে সাধারণ মুখ চেনা আর কি।’‘তুমি বলছ গ্রামের লোকেদের মধ্যে নিশীথবাবুই প্রথম ওনার কাছে গিয়েছিলেন। ওনাকে ঘটনাস্থল থেকে কোন জিনিস পকেটস্থ করতে দেখেছ কি?’ দিগন্তবাবুর কৌতূহল তখন চরমে।‘না তেমনভাবে আমরা লক্ষ্য করিনি। তবে অন্যরা যেখানে নাক সিঁটকে দূরে গিয়ে পুলিশ আসার অপেক্ষা করছিলেন, নিশীথবাবু কিন্তু ওই গোবিন্দবাবুর দেহের পাশেই ঘুরঘুর করছিলেন অনেকক্ষণ ধরে।’‘হুঁ, যেটা আন্দাজ করেছিলাম।’ দিগন্তবাবু টেবিলের উপর রাখা ফাইলটা খুলে নিজের ক্যালেন্ডারটা দেখে নিলেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা তোমাদের গ্রামে আমাকে একবার নিয়ে যাবে?’‘আপনি যাবেন স্যার?’‘হ্যাঁ তোমাদের ওই ভচচায বাড়ির ছেলের কেসটা একটু দেখতে হচ্ছে ভাই।’‘তা চলুন না আমাদের বাড়ি, কোনও অসুবিধা হবে না। কাল শুক্রবার, কাল বিকেলে তো বাড়ি যাবই।’‘না না কাল নয়, আজই। বিকেলের ট্রেনেই চলো বেরিয়ে পড়ি। এক কাজ করো, তুমি হস্টেলে গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। আমি ততক্ষণ প্রিন্সিপালকে বলে ছুটিটা নিয়ে আসি।’এবার আমার একটু আমোদ লাগল, বললাম, ‘এইভাবে একজন ছাত্রকে কলেজ কামাই করতে উৎসাহ দিচ্ছেন স্যার?’‘সবে সেশন শুরু হয়েছে। একদিনের ক্লাসনোট তুমি অন্যদের কাছেও পেয়ে যাবে। কিন্তু একটা দিন পেরিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যাবেনা। বিশেষ করে যখন একজনের জেলে থাকা না থাকার প্রশ্ন চলে আসছে, যে করেই হোক সত্যিটা জানতেই হবে। যদি আমার কাছে এই ঘটনাটা এসে না পৌঁছাত তাহলে অবশ্য কোন ব্যাপার ছিলনা। কিন্তু যখন একবার আমার হাতে ভগবান কেসটা তুলে দিয়েছেন কিছু একটা তো করেই ছাড়ব।’এমন যেচে ছাত্রের পড়া কামাই করিয়ে তারই বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার দাবী করা শিক্ষক এই প্রথমবার দেখলাম। দেখা তো দূরের কথা এমন ঘটনা আদৌ ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণাই ছিলনা।এ তো গেল কথার কথা। আসল কথা হল আমার ক্লাস নোট নেওয়া বা ক্লাস করার ব্যাপারে কোনও আগ্রহই ছিলনা। নেহাৎ বলতে হয় তাই...দূর্গাপুর থেকে ট্রেনে বর্ধমান এবং সেখান থেকে বাসে মনোহরপুর পৌঁছলাম। সন্ধ্যা সাতটা। বাস থেকে নেমেই বুঝলাম আগের সপ্তাহে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক খুনগুলো নিয়ে এলাকা বেশ অশান্ত। জায়গায় জায়গায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সাদা পোষাকের পুলিশদেরও চেনা যাচ্ছে মুখচোখ দেখে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই তুলে নিয়ে যাবে একেবারে হাজতে। পরিস্থিতি তেমন খারাপ বুঝলে গুলিও চলতে পারে যখন তখন।ধীরে ধীরে এই জায়গাগুলোয় রিক্সা উঠে যাচ্ছে। দুএকটা দেখা গেলেও আগের সেই প্রাচুর্য আর নেই। সেই জায়গা দখল করেছে ই-রিক্সা বা যাকে বাংলায় আমরা টোটোগাড়ি বলি। তাতে করেই বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলাম।আজ বাড়িতে কেউ নেই। সবাই গেছে এক আত্মীয়ের বিয়েতে। ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলাম, নাহলে স্যার আসার আগেই কথাটা তুলতাম। পাশের বাড়ি থেকে চাবি নিয়ে দরজাটা খুললাম। বাইরে মাইকে ঘোষণা করছে, আগামীকাল সন্ধ্যায় শ্রদ্ধেয় কবি ও লেখক নিশীথবাবুর স্মরণে এক কবি সম্মেলণের আয়োজন করা হয়েছে।ক্লাবঘরটায় আড্ডা জমেছে দেখলাম। একটু বাইরে পায়চারী করে নিয়ে বাড়ি এসে খিচুড়ি আর ডিমভাজা রেঁধে নিলাম। এ এমনই এক অমৃত যার কাছে স্বর্গসুখ তুচ্ছ। দুজনে খেয়ে উঠতে নটা বেজে গেল। রাস্তার ক্লান্তিতে ঘুমটাও এল খুব তাড়াতাড়িই।.........................................................................................সকালে ঘুমটা ভাঙল ফোনের শব্দে। বিয়েবাড়ি থেকে আমাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। আমার একেবারেই যে ইচ্ছা নেই তা নয়। কিন্তু এই অবস্থায় স্যারকে ফেলে যাই কেমন করে। তাই ঘটনাটা বেমালুম চেপে গেলাম। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি স্যার একটা সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন।‘কি ভাবছেন স্যার?’ বলেই মনে হল যেন আমি একটা গভীর ভাবনার বিঘ্ন ঘটালাম।‘আরে কিছু না, কখন উঠলে?’ হাসিমুখে স্যার বললেন। এই হাসিমুখটা যেন ক্লাসের সেই ক্লাস টিচার দিগন্তবাবুর গম্ভীর বদনটার থেকে অনেকটাই আলাদা।‘এইমাত্র, ডাকতে পারতেন। বাড়িতে কেউ নেই, জানি আপনার অসুবিধা হচ্ছে, একটু মানিয়ে নেবেন প্লিজ। জানেনই তো হস্টেলে থাকি, সামাজিকতা থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছি।’‘আরে এসব নিয়ে নো টেনশন। আমিও তো বছর পাঁচেক আগে হস্টেলেই থাকতাম না কি! কোনও অসুবিধা হবেনা।’ বলেই চট করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন দিগন্তবাবু, ‘যাবে নাকি জায়গাটায় একবার?’উৎসাহ আমারও ছিল, যদিও ব্যাপারটা আতঙ্কের। রাজী হয়েই গেলাম। মাঠ দেখতে যাচ্ছি এমন হাবভাব নিয়ে রওনা দিলাম দুজনে। খেলার মাঠটা থেকে অনতিদূরেই আমাদের বিঘা পাঁচেক জমি। সেখানটা একবার ঘুরে এসেই খেলার মাঠে যাব ঠিক করলাম।‘শোনা যায় আমার প্রপিতামহ এই জায়গাগুলো কিনেছিলেন খুব অল্প দামে। চাষাবাদের পক্ষে বেশ উঁচু আর রুক্ষ, পাহাড়ের মত ছিল এখানটা তখন। কিন্তু একটা গোপন অভিসন্ধি ছিল তাঁর। সেটা হল গুপ্তধন। তিনি বেশ আশাবাদী ছিলেন এই জায়গাটাতেই লুকিয়ে রাখা আছে চৌধুরী পরিবারের গুপ্ত ধনসম্ভার।’ আমি বেশ ঐতিহাসিক ভঙ্গীমায় বললাম।‘তারপর কিছু বেরিয়েছিল?’‘হ্যাঁ শয়ে শয়ে সাপ। আর পাহাড় কেটে যে মাটি পাওয়া গেল তা দিয়ে একটা সাময়িক ইঁটের কারখানা করা হল। সেটাও বেশিদিন টিকলনা। অবশেষে এই জায়গাটায় চাষবাস করাই ঠিক হল। তারপর এখানে ফলল স্বর্ণালী শস্য। এটাই তো গুপ্তধন, বলুন।’‘তা যা বলেছ। এবার চলো ওদিকটায় যাওয়া যাক।’ উনি পা বাড়ালেন। আমিও পিছু নিলাম।কার্তিকের সকাল। শ্রাবণীর দুপাশে রাশি রাশি কাশের বুকে ঝরে যাওয়ার ব্যাথা। ধানের জমিগুলোতে একটু একটু করে স্বর্ণালী আভা লাগতে শুরু করেছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় মনে পরিয়ে দিচ্ছে সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের দিনগুলো। এই হাওয়ায় একটা আতঙ্কের পরশ বয়ে যেত শিরদাঁড়া বেয়ে, খালি মনে হত কিছুই তো পড়া হয়নি। স্যারকে এপার থেকেই সবকিছু দেখালাম পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সহ। আসলে ওপারে যাওয়ার মত সাহস তখনও করে উঠতে পারিনি।কবি সম্মেলনে যাওয়ার জন্য বিকেল থেকেই আগ্রহ বাড়ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই আরম্ভ হয়ে যাবে সেই অনুষ্ঠান। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের থেকেও বেশী আকর্ষণীয় নতুন নতুন কবিদের কবিতাপাঠ। তাড়াতাড়ি পৌঁছে সামনের দিকে চট পাতলাম। শহরের মানুষ উনি, হয়ত একটু অসুবিধা হবে, তাও মানিয়ে নিতে হবে আর কি। এই সভাতেই প্রথমবার নিশীথবাবুর কবিতা শুনলাম। আসলে উনি তো লিটল ম্যাগাজিনে লিখতেন, সেগুলো কিনে পড়ার খুব একটা সুযোগ হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় কবির কবিতা পাঠের সময় গ্রামের প্রবীণ গোছের মানুষ শ্যামচরণবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও কিছু বলতে চাই ওনার সম্পর্কে। একেতো তিনি লুঙ্গি পরে এসেছেন, তার উপর খালি গা। তাই ওনাকে উঠতে দেওয়া হলনা।যাইহোক, অনুষ্ঠানের বেশিরভাগটা জুড়েই তাঁর স্মৃতিচারণ আর কবিতাপাঠ। তাঁর কবিতার ছত্রে-ছত্রে ফুটে ওঠে গ্রামের প্রতি প্রেম, নিবিড় টানের কথা। সবার শেষে তাঁরই ছেলে পা করলেন তাঁর লেখা একটা কবিতা যার লাইনগুলো বেশ মন টানল। কয়েকটা লাইন যেমন,পা ধুয়ে নিই প্রবাহমানা জলে,ছলাৎ ঢেউ উথলে উঠে বলেঃশুনবি নাকি আমার কথা চুপে?কেমনে বাঁচি ইতিহাসের স্তুপে?এই রকমের আরও কতকগুলি কথা যা সহজ সরল, কিন্তু মন কেড়ে নেয়।ফেরার সময় দিগন্তবাবু বললেন, ‘চলো, একবার থানাটা ঘুরে আসি।’‘এখন, মানে এই রাত্রে?’ আমি অবাক হলাম।‘হ্যাঁ, সাইকেল দুটো বের করো।’এই দুদিনে স্যারের উপর বেশ খানিকটা ভরসা জন্মেছে। মনে হচ্ছে এই ঘটনার কিছু কিনারা করতে উনিই পারবেন। অতএব বিনা বাক্যব্যয়ে সাইকেলে রওনা হলাম থানার উদ্দেশ্যে। থানার যত কাছে এগিয়ে আসি, বুক ঢিপঢিপ ভাবটা ততই যেন বাড়তে থাকে। মনে হয় একদিন এই ভূতের খপ্পরে নাহলে পুলিশের খপ্পরে ঠিকই আমি মারা পরব।‘কি দরকার?’ বাইরের চেয়ারে বসে থাকা খাঁকি পোষাকের ভদ্রলোক বললেন।‘একটু বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।’ স্যারের উত্তর।ভদ্রলোক শাণিত দৃষ্টিতে একটু মেপে নিয়ে বললেন, ‘অ্যাপয়নমেন্ট নিয়েছেন?’‘সেটা কিভাবে নিতে হয়? ভিতরে গিয়ে?’ স্যারের এই প্রশ্নে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললাম, ‘বলুন ওই শ্রাবণীর পারের কেসটা নিয়ে কিছু বলতে চায়, একজন প্রত্যক্ষদর্শী এসেছেন।’এরপরে আর কেইবা আপত্তি করে! তবুও রাগত স্বরে ভদ্রলোক বললেন, ‘ফোনে কথা বলে আসতে হয় আগে থেকে। দাঁড়ান এখানে, জিজ্ঞেস করে আসছি।’ভদ্রলোক ফিরে এলে জানা গেল বড়বাবু ডেকেছেন।‘আসুন, বলে ফেলুন কি চাই? আপনি নিশীথবাবুর মার্ডারটা সামনে থেকে দেখেছেন?’ বড়বাবু সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন দিগন্তবাবুকে।‘আমি। নিশীথবাবুর নয়, দুবছর আগের গোবিন্দবাবুর সময়ে আমরাই দেহটা প্রথম দেখেছিলাম স্যার। তারপরই তো বিনু... মানে ওই ছোট্ট ছেলেটার ওইরকম...’ আমি তোতলাতে থাকি।‘এই গল্প আমার অনেকবার শোনা, নতুন কিছু থাকলে বলো।’ বড়বাবুর কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি।এবার হাল ধরলেন দিগন্তবাবু, ‘আসলে আমরা এই মৃত্যুটার প্যাটার্ন সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি। যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি এই তদন্তে খানিকটা সাহায্য করতে পারি।’‘পুলিশ নিজের মত করে তদন্ত করছে, তুমি আবার নতুন কি করবে?’‘দেখুন স্যার ভুল বুঝবেন না, তবে আমি হলফ করে বলতে পারি ওই তন্ময় ভচচায নির্দোষ। শুধুমাত্র কিছু তথ্য জানার অপেক্ষা। আমি কলেজে পড়াই, এই দেখুন আমার কার্ড। কথা দিচ্ছি কোনওরকম অসুবিধার সৃষ্টি করবনা আপনাদের। শুধুমাত্র একটা সাহায্য চাই আপনার কাছে।’‘বলে ফেলুন, আমি তো দানছত্র খুলেই বসে আছি।’ বিরক্তি হতাশা সবকিছু মিলেমিশে একাকার বড়বাবুর গলায়।‘মৃত নিশীথবাবুর কাছ থেকে সন্দেহজনক কিছু কি পাওয়া গিয়েছিল? জাস্ট এমনি জিজ্ঞাসা আর কি।’‘কিসব হিজিবিজি কাটা ভাঁজ করা কাগজ। দেখে তো মনে হয় বেশ পুরনো দিনের একটা চিঠি, বাংলা হরফে লেখা। কিন্তু এরকমের লেখা এতবছরের চাকরিজীবনে কখনও দেখিনি। মানেও বোঝা যায়না। ভদ্রলোক হয় পাগল ছিলেন নাহয় গোপনে ডাকাতদলে ভিড়েছিলেন, বুঝলেন?’ বলতে বলতে ফাইল থেকে একজোড়া কাগজ বের করে দেখালেন।প্রথম কাগজটাতে একটু চোখ বোলালাম, একটা চিঠি বলেই মনে হল। শুরুটা অনেকটা এরকম,“য়উ ঐমঐড় চএড়এজএড়কঔ চড়এদএনমএ,............................................................ইত্যাদি”বাপরে, এমন দাঁতভাঙা বাংলায় কোনওকালে মানুষ কথা বলত নাকি, মনে মনে ভাবলাম। তবুও হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। এখানে বোধগম্য কিছুই নেই, এই ভেবে পরের পাতায় গেলাম। পরের পাতার একদম শেষে খুব ছোট্ট হরফে একটা ছড়া, ছড়া না বলে ধাঁধাঁ বলাই ভাল, কারণ শেষের লাইনে তার উল্লেখ আছে।‘শ্রাবণীর বাঁকে বাঁকে বর্ণ পরিচয়চন্দ্রকে গ্রহ করে পঞ্চাশে তাই রয়।বলবৎ বল ছেড়ে বাদ দিয়ে দেবেতাহলেই এ ধাঁধার মানে খুজে পাবে।।’অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়ে কাগজদুটোর জেরক্স নিয়ে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। অবশ্য আমাদের পরিচয় এবং ছবি সবকিছুই থানায় রেখে তবেই আমাদের ছাড়া হল।দিগন্তবাবু কাগজদুটো পেয়ে অব্দি ওদিকেই আটকে রইলেন। রাত বারোটা নাগাদ রান্না শেষ হল। ভাত, ডালসিদ্ধ, আলুসিদ্ধ, আর ডিম ভাজা। সঙ্গে বাড়ির ঘি। খেতে খেতে ওনার প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, শ্রাবণী নদীটার কোনও ম্যাপ আছে তোমাদের বাড়িতে?’‘তা হয়ত দলিলের বাক্সে থাকবে, কিন্তু সে দিয়ে কি হবে?’‘এই দেখেছিস, এখানে বলেছে, শ্রাবণীর বাঁকে বাঁকে... তারমানে নিশ্চয়ই... থাক, কাল সকালেই দেখব।’ এই বলে লম্বমান হলেন তিনি।হঠাৎ স্যারের মুখে ‘তুই’ ডাকটা কেমন যেন ভালো লাগতে শুরু করল, মনে হল উনি তো আমাকে ‘তুই’ বলতেই পারেন। ‘তুমি’ ডাকটা কেমন যেন কৃত্রিম।পরদিন সেকথা বেমালুম ভুলে গেলাম ওনার একের পর এক দাবীতে। চা খেতে খেতে প্রথম প্রশ্নই হল, ‘মনে আছে, সেদিন যে লোকটাকে স্টেজে উঠতে দেওয়া হলনা? ওনার কাছে একবার যেতে হবে।’‘হঠাৎ? ওখানে কিন্তু স্যার কিছুই জানা যাবেনা।’‘কেন?’‘উনি বড় ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু ছেলে আর বৌয়ের অত্যাচারে, এখন কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে তেড়ে আসেন। কিছুটা বিকারগ্রস্তও বলা যেতে পারে।’স্যারের চাপে রাজী হতেই হল। এদিকে বিয়েবাড়িতে ফোন করে জানলাম, ওদের জোড়াজুড়িতে মা-বাবা আরও একদিন থেকে যেতে রাজী হয়েছেন, অর্থাৎ রবিবারে ফিরবেন। আমাদের হাতে স্বাধীন আরও একটা দিন পাওয়া গেল।হাজির হলাম সেই বৃদ্ধ অর্থাৎ শ্যামচরণ চক্রবর্তীর বাড়ি। খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট ঘর, ছোট্ট বারান্দায় মশারি টাঙানো। ভদ্রলোক সম্ভবত বেরিয়েছেন কোথাও।পাশেই দোতলা দালান ঘর। তাঁর ছেলের। সকালের মিষ্টি হাওয়া আর নরম আলোয় পুকুর পারের বাড়িটাকে সবে ভালো লাগতে শুরু করেছে এমন সময়ে শ্যামবাবু নিমের দাঁতন করতে করতে ফিরলেন।‘নমস্কার। আমরা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।’‘আপনারা? পুলিশের লোক তো নন মনে হচ্ছে।’ তারপর একটু অন্যমনস্ক হয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। দুটো চাটাই হাতে বেরিয়ে এলেন। আমাদের বসতে নিয়ে মশারিটা গোছাতে গোছাতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘আমি জানতাম একদিন কেউ না কেউ আসবে, আসবেই। আমাকে কেউ পাত্তা দেয়না জানেন। দিলে আমি কিছুটা উপকারে লাগলেও লাগতে পারতাম। কিন্তু...’‘আমরা পুলিশের লোক নই। শুধু জানতে এসেছি আপনি ওই মৃত্যুগুলোর ব্যাপারে যদি কিছু জানেন আর কি। বুঝতেই তো পারছেন, ভচচায বাড়ির ছেলে, তন্ময়, বিনা অপরাধে জেল খাটছে।’‘বিনা অপরাধে। হ্যাঁ সেই বটে। ওরা সবাই পূর্বপুরুষদের কর্মফল ভোগ করছে। তোমরা কিন্তু সাবধান। ওই লোভের ফাঁদে কখনও পা দেবে না।’‘কিসের লোভ?’ আমি প্রশ্ন করলাম।‘তোমরা এটার জন্যই এসেছ তো?’ শ্যামবাবুর চোখে শাণিত চাহনি, হাতে একটা পুরনো দিনের জরাজীর্ণ ম্যাপ। নিচে লেখা শ্রাবণী-লিপি। ‘নিশীথবাবুও এসেছিলেন। কিচ্ছু উদ্ধার করে উঠতে পারেননি। শুধুমুধু প্রেতের হাতে প্রাণটা খোয়ালেন।’‘আপনি নিশ্চিত, এটা প্রেতেরই কাজ? মানুষের নয়?’‘হ্যাঁ, আর এও জানি একমাত্র আমিই পারব কিছু একটা সমাধান বের করতে।’‘তাহলে করছেন না কেন?’ সন্দেহের স্পষ্ট ছাপ দিগন্তবাবুর কণ্ঠে।‘সেদিন স্টেজে আমাকে উঠতেই দেওয়া হলনা। এরকমই আরও কত কি হয় আমার উপর, তোমরা তার কোনও খবর রাখো? বরং এবার এসো তোমরা, নিজেরা যদি কিছুটা এগোতে পারো, তাহলে আবার এসো।’‘কিছু যদি মনে না করেন, এর একটা ছবি তুলতে পারি?’‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ মোবাইলটা বের করে ছবি তুললেন উনি।তারপর সেই ছবির বেশ কয়েকটা প্রিন্ট করানো হল। দিগন্তবাবু এক-একটা প্রিন্ট নেন আর বিভিন্ন রকম আঁক কাটেন। স্কেল দিয়ে নানান মাপ করেন আবার রেখে দেন। এভাবেই দুপুরটা কেটে গেল। বিকেলের দিকে বললেন, এই দেখো বুঝতে পারছ কিছু?’কাগজটা হাতে নিলাম। বললাম, ‘কিছুটা। তার মানে এই হল আমাদের শ্রাবণী লিপি, তাইতো?’ জিজ্ঞেস করলাম।‘হ্যাঁ এই দিয়েই উন্মোচিত হবে যত রহস্য। কই সেই চিঠিটা দাও দেখি।’তাক থেকে চিঠিটা আনলাম।প্রথম লাইনটা এরকম,“য়উ ঐমঐড় চএড়এজএড়কঔ চড়এদএনমএ,”‘য়’ অর্থাৎ ৪৭ নম্বর, ওটার জায়গায় হবে ৪৪ নম্বর অর্থাৎ ‘হ’। তারপর কি আছে? ‘উ’ মানে হল গিয়ে ৫, তার জায়গায় হবে ৯ অর্থাৎ ‘এ’। এইভাবেই প্রথম লাইনটার মানে দাঁড়ালঃ‘হএ আমআর পঅরঅবঅরতঈ পরঅজঅনমঅ’অর্থাৎ‘হে আমার পরবর্তী প্রজন্ম’।‘ধুর এইভাবে কার্ভ দেখে দেখে হচ্ছেনা। একটা ছক করো দেখি যাতে সহজেই জিনিসটা ডিকোড করা যায়।’ স্যার বললেন।অতএব আমি পয়েন্টগুলো থেকে ছক বানাতে শুরু করলাম। ছকটা মোটামুটি এরকম দাঁড়ালঃ১ অ → ৯ এ২ আ → ১০ ঐ৩ ই → ১১ ও৪ ঈ → ১২ ঔ৫ উ → ১ অ৬ ঊ → ২ আ৭ ঋ → ৩ ই৮ ঌ → ৮ ঌ৯ এ → ৫ উ১০ ঐ → ৬ ঊ১১ ও → ৭ ঋ১২ ঔ → ৪ ঈ১৩ ক → ২৩ ট১৪ খ → ২৪ ঠ১৫ গ → ২৫ ড১৬ ঘ → ২৬ ঢ১৭ ঙ → ১৭ ঙ১৮ চ → ২৮ ত১৯ ছ → ২৯ থ২০ জ → ৩০ দ২১ ঝ → ৩১ ধ২২ ঞ → ২২ ঞ২৩ ট → ৩৩ প২৪ ঠ → ৩৪ ফ২৫ ড → ৩৫ ব২৬ ঢ → ৩৬ ভ২৭ ণ → ২৭ ণ২৮ ত → ১৩ ক২৯ থ → ১৪ খ৩০ দ → ১৫ গ৩১ ধ → ১৬ ঘ৩২ ন → ৩২ ন৩৩ প → ১৮ চ৩৪ ফ → ১৯ ছ৩৫ ব → ২০ জ৩৬ ভ → ২১ ঝ৩৭ ম → ৩৭ ম৩৮ য → ৪৪ হ৩৯ র → ৪৫ ড়৪০ ল → ৪৬ ঢ়৪১ শ → ৩৮ য৪২ ষ → ৩৯ র৪৩ স → ৪০ ল৪৪ হ → ৪৭ য়৪৫ ড় → ৪১ শ৪৬ ঢ় → ৪২ ষ৪৭ য় → ৪৩ স৪৮ ং → ৪৮ ং৪৯ ঃ → ৪৯ ঃ৫০ ঁ → ৫০ ঁএবার বেশ সহজ হয়ে গেল চিঠিটা পড়া। চিঠিতে পেলাম,“হে আমার পরবর্তী প্রজন্ম, ১৩ই মে, ১৯৩৩আমি অনন্তনারায়ণ চৌধুরী, পিতা ঁবসন্তনারায়ণ চৌধুরী, নিবাস মনোহরা, জমিদারবাটি। যে বিশেষ কারণে এই পত্রের অবতারণা তাহা হইল, আমাদের বংশ আজ অতি সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়া যাইতেছে। দেশের যে ভয়াবহ অবস্থা তাহাতে যেকোন মুহূর্তে আমাদের নিকট হইতে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইতে পারে, এই আশঙ্কা করিয়া পিতা যক্ষ কর্তৃক সম্পত্তি আগলাইবার ব্যবস্থা করিয়া যান। কুলপুরোহিত চক্রবর্তী মহাশয় তখন কোন এক অজ্ঞাত কারণে শহরে গিয়াছিলেন। অতএব ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আসিয়া সেই আয়োজন সম্পন্ন করেন। কথিত আছে, গরীবের সন্তানকে যক্ষ বানাইলে তাহার মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে, অথচ সেই যক্ষ সম্মান প্রদানের পূর্বেই বাগদী বালকটি প্রস্থান করিল সেই স্থান হইতে। সেই ক্ষণে আর একটি বালককে নদীতীরে দেখা যায় এবং তাহাকেই ভুলাইয়া নিবেদন করা হয় যক্ষ হিসেবে। উহাকে ভূতলে বন্দি করিবার পর দুই দিনকাল অতিবাহিত হয়। চক্রবর্তী মহাশয় আপন কার্য সমাধা করিয়া জানিতে পারেন উহার পুত্র নিখোঁজ। খোঁজ করিতে উনি জমিদার গৃহে আসিয়া উপস্থিত হন। তাঁহার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী সেই বালকটিই ছিল চক্রবর্তী মহাশয়ের সন্তান, যাহাকে যক্ষপুরীতে রাখিয়া আসা হইয়াছে। তাহাকে না বলা হইলেও কোনও এক তান্ত্রিক মারফৎ তিনি এই সংবাদ পান, এবং সন্তানের উদ্ধারে সেই স্থানে পৌঁছান। পিতার এক বাক্য, একবার যাহাকে যক্ষপুরীতে পাঠানো হইয়াছে, মৃত হউক বা জীবিত, উহাকে বাহিরে আনা যাইবেনা। বেগতিক দেখিয়া এবং ইংরাজ পুলিশদের নিকট খবর পৌঁছাইলে কি হইবে তাহা চিন্তা করিয়া লাঠিয়াল কর্তৃক চক্রবর্তী মহাশয়কেও হত্যা করিয়া যক্ষপুরী নিকটস্থ ভূমিতে প্রোথিত করা হয়। মৃত্যুপূর্বে উনি অভিসম্পাত করেন যে, এই বংশের শেষ রক্তবিন্দু দেখিয়া তবেই তিনি মুক্তি লইবেন। যদি আমাদের বংশের কেহ ওই ভূমির কাছাকাছি পৌঁছান তাহা হইলেই তাহার মৃত্যু হইবে।এক চতুর প্রেতবিশারদের শরণাপন্ন হইয়া পিতৃদেব উহার আত্মাকে স্মরণ করেন এবং ব্যক্ত করেন যে, সেক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীকে অর্থ প্রদান না করিয়া ওনার সন্তানের মুক্তি হইবে কিভাবে? অনেক অনুনয়ের ফলস্বরূপ ব্রাহ্মণ মহাশয়ের প্রেত নিয়ম কিছুটা শিথিল করেন। বলেন, যদি কেহ ঐ অর্থ ভোগের আশা না করিয়া, কোন জনকল্যানে ব্যয় করিবেন স্থির করেন তাহাকেই ঐ অর্থের উত্তরাধিকারী বলিয়া স্থির করা হইবে এবং তাহার উপর কোন অপঘাত ঘটিবে না।সুতরাং যেই আমার এই পত্রখানি পাইয়া থাকো, ভোগ সংবরণ করিয়া শুদ্ধচিত্তে ওই অর্থ লহিয়া জনকল্যানে ব্যয় করিবে এবং বংশকে অভিশাপমুক্ত করিবে, ইহাই আমার অভিপ্রায়। শ্রাবণীর উপরিস্থিত ত্রিভূজভূমি স-হ-ড় তে উহার সন্ধান পাওয়া যাইবে।”চিঠি শেষ করে আমার মনে হল শ্যামচরণবাবুর বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার। স্যারকে সে কথা বলতে দেখলাম উনি এককথায় রাজী। হয়ত উনিওএকই কথা
ভাবছিলেন।সন্ধ্যেবেলা। রাস্তায় যেতে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই ছড়াটার মানে কিভাবে বের করলেন একটু বলবেন। বেশ কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি, কিন্তু পুরোটা নয়।’স্যারের হালকা হাসির আভাস তাঁর কথাতেই পাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, ‘চিঠিটার তারিখ হয়ত খেয়াল করেছ। সাল ১৯৩৩। তারই আগের বছর অর্থাৎ ১৯৩২-এ বর্ণপরিচয়ের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সেখানে ছিল ১২ টি স্বরবর্ণ এবং ৪০ টি ব্যঞ্জন বর্ণ। তার মধ্যে দুটিকে বাদ দিতে হল, ‘ব’ আর ‘ৎ’, ‘বলবৎ’ এর ‘বল’ রেখে দিতে বলা হয়েছে নিশ্চয়ই দেখেছ। তার মানে একটা ‘ব’ থাকল আর একটা গেল বাদ। এবার আসি গ্রাফটার কথায়। এক-এ চন্দ্র, আবার এক-এ আসে প্রথম বর্ণ ‘অ’, নয়-এ নবগ্রহ আবার সেইসঙ্গে নয়-এ হয় নবম বর্ণ ‘এ’। অর্থাৎ শুরুর বিন্দুটি হল (১,৯)। শেষের বিন্দুটি ‘পঞ্চাশে তাই রয়’ অর্থাৎ (৫০,৫০)। এবার এক থেকে শুরু আর পঞ্চাশে শেষ হলে সমান ঊনপঞ্চাশ ভাগে ভাগ করতে হয় শ্রাবণীর গতিপথকে। সেটাই করলাম, আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তাই মিলে গেল উত্তর।’শ্য্যামবাবুর বাড়িতে কোনও দরজা নেই। দেখতে পেলাম একটা হ্যারিকেনের আলো-কে কমিয়ে রাখা হয়েছে, তার সামনে চোখ বুঝে বসে কি যেন সুর করে গাইছেন। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম। শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। চোখ খুলেই বলে উঠলেন, ‘চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।’এমন আকস্মিক দাবিদাওয়ার জন্য আমরা তৈরী ছিলাম না। তবুও বৃদ্ধের পথ ধরলাম। পথ ধীরে ধীরে পৌঁছচ্ছে শ্রাবণীর তীরে। নিশির টানে যেন আমরা এগিয়ে চলেছি রাত্রির বুক চিরে, আলপথ বেয়ে। ছোট্ট শিশু বিনুর সাথে যেমনটি হয়েছিল, ওর দেহে প্রবেশ করে কোন এক প্রেত সিদ্ধ করতে চেয়েছিল তার অভিপ্রায়, তেমনটি আমাদের সাথেও ঘটবে না তো। ওইরকম শিশু ছিটকে ফেলে দিয়েছিল দশজন তাগরা জোয়ানকে। তাও আবার যেমন তেমন ধাক্কা নয়, কারও হাতে যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল, কারও পায়ে, কেউ আবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল শ্রাবণীর জলে।কি মনে হতে নিজের হাতে প্রচণ্ড জোরে চিমটি কেটে নিজেই ‘আআআ’ করে উঠি। মানে এখনও সজ্ঞানেই আছি। আর এক সপ্তাহ পর কালীপূজো। আজ রাত্রের পর আর কোনও কালীপূজো আসবে কিনা সেই নিয়েই এখন দেখা দিয়েছে সংশয়। অমাবস্যা আসতে কয়েকদিন বাকী, তাই চাঁদের আলো এখনও পুরোটা নিভে যায়নি। দূরে অনবরত হুক্কাহুয়া স্বরে ডেকে চলেছে শিয়ালের দল। ঝিঁঝিরা গেয়েই চলেছে, এক সুরে। আর কি এক আদিম মোহে আমরা এগিয়ে চলেছি যক্ষপুরীর দিকে।ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। আমরা সেতু ধরেই নদী পেরোলাম। রাত্রে অন্ততঃ নদী সাঁতরাতে হলনা। একটা ফাঁড়া থেকে তো রেহাই পেলাম। তারপরই সাঁই করে পিছন দিকে কে যেন চলে গেল মনে হতেই চমকে উঠলাম। স্যার বললেন, ‘কুকুর টুকুর হবে বোধহয়।’আমরা পৌছে গেছি সেই জায়গায়, যেখানে বহু বছর ধরে বন্দি আছে এক ছোট্ট শিশুর আত্মা, অন্ধকারের গহবরে। এবার ঘটল আর এক ঘটনা, কাপড়ে জড়ানো একটা শাবল বের করে ফেললেন শ্যামবাবু। সেটা আমাকে দিয়ে একটা গাছের নিচে খুঁড়তে বললেন তিনি।‘তার মানে আপনি সবটা...’‘হ্যাঁ, আমি সবটাই জানতাম। বাবাকে খুন করে যখন পুঁতে ফেলে, আমি তখন মায়ের পেটে। মা লুকিয়ে গিয়ে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তারপর দীর্ঘ বারো বছরের সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর আমরা আবার গ্রামে ফিরে আসি অবশ্য। তখন জমিদারদের ক্ষমতাও অনেকখানি কমে গেছে। আর পূর্বপুরুষদের কুকীর্তির খবর ওরা নিজেরাই বুঝতে পারেনি হয়ত। নাহলে সেদিন গোবিন্দবাবু যখন ওই লেখাটা নিয়ে আমার কাছে এল, আমি কি আর অভিশাপের কথাটা বেমালুম চেপে গিয়ে ওকে এখানে পাঠাতে পারতাম? চৌধুরী বংশের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমার বাবার মুক্তি দেখে যেতে পারতাম?’‘আর নিশীথবাবুর ব্যাপারটা? তাকেও কি আপনিই...’‘নিশীথবাবুও আমার কাছে এসেছিলেন এই একই প্রশ্ন নিয়ে। আমি ওকে পুরো ঘটনাটা বলি এবং অনুরোধ করি যাতে উনি না আসেন এখানে। নিজের জেদ আর লোভের কাছে পুরোপুরি হেরে গিয়েছিলেন অত ভালো মানুষটা। হয়ত ওনার দুর্বল হৃদয় বাবার আত্মাকে দেখে ফেলেছিল, আর ওনার লোভকে দেখে ফেলেছিলেন আমার বাবার আত্মা। অতএব...’বুক ঢিপঢিপ করছে, ইতিমধ্যে হাঁটুসমান খোঁড়া হয়ে গেছে। এরপর মাটিতে শাবলের আঘাত পরতেই ধাতব ঝঙ্কার শোনা গেল। সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন শোনা গেল এক শিশুর গগনবিদারী অট্টহাসি। স্যারের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। ওনারও যে হাত কাঁপছে বোঝা গেল। দুজনেই তাকালাম শ্যামচরণ বাবুর দিকে। ওনার মুখে প্রসন্ন হাসি, ‘ও কিছু নয়। অনেকদিন পর মুক্তির আশায় শিশুমনে খুশীর জোয়ার এসেছে। হাত চালাও তাড়াতাড়ি।’একে তো ঘামে ভিজে গেছে সারা গা ভয়ে আর ক্লান্তিতে, তার উপর বৃদ্ধের এরকম আচরণ। আর হাত চালাতে পারলাম না। দেখলাম এইবার স্যার শাবলটা নিয়ে খুঁড়তে শুরু করলেন। একটু পরেই পাওয়া গেল লোহার একটা ঢাকনা। প্রচণ্ড শক্তিতে দুজনে মিলে খুলে ফেললাম সেটা। টর্চ লাইট জ্বেলে দেখা গেল ভিতরে একটা সিড়ি। হ্যাঁ, চলো নামা যাক। সামনে শ্যামবাবু, তারপর আমি আর সবশেষে দিগন্তবাবু, এইভাবে নামতে শুরু করলাম। হাসির শব্দটা থেমেছে। অনেক মাকড়সার ঝুল, বাদুড়ের আক্রমণ পেরিয়ে নিচে পৌঁছে যা দেখলাম তা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। ছোট্ট একটা শিশু, অনেকদিনের না আঁচড়ানো জটবাঁধা চুল, দীর্ঘদিনের না খেতে পাওয়া হাড়সর্বস্ব শরীর, একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। চোখের পাতা পড়ছেনা একটুও, শুধু অবাক চাহনি তার দুচোখে।‘দাদা... আমার দাদাটাকে ওরা এভাবে চাপা দিয়ে মারলে... না জানি কতদিন খেতে পায়নি, অন্ধকারে খিদের জ্বালায় ছটফট করেছে।’ কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধের গলা ধরে এল।শিশুটির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সেই গোপন কুঠুরীতেই আমাদের ঈশারা করে নিয়ে চলল কোন অজানার উদ্দেশ্যে। আমরাও সম্মোহিতের মত চললাম তার পিছু পিছু। একটু এগিয়ে গিয়ে উইয়ের ঢিবির মত জায়গায় পৌঁছে সেখানে উঠে গিয়ে শিশু অদৃশ্য হল। আন্দাজ যদি খুব একটা ভুল না হয়, হয়ত শিশুটির ইহজগতের কাজের এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু কপাল তো আর সবসময় আন্দাজমত চলে না। এদিকে লক্ষ্য করে দেখলাম শ্যামবাবু আমাদের সঙ্গে আসেননি। সিড়িতেই বসে আছেন হয়ত। আবার শাবলের কাজ শুরু হল। দুর্বল ঢিবি গুঁড়িয়ে ঝরে ঝরে পড়ল। এবং বেরিয়ে এল একটা পিতলের বাক্স। তালা ছিল না, তাই সহজেই খোলা গেল। ভিতরে যা দেখলাম... এত সোনা জীবনে কখনো দেখিনি। কিন্তু না। এ আমার নয়, এ আমাদের। গ্রামের স্বার্থে খরচ করতে পারলে তবেই এতগুলো মানুষের আত্মবলি সার্থক হবে। হঠাৎ সিড়ির দিক থেকে শব্দ এলো, ‘ইউ আর আণ্ডার আরেস্ট মিস্টার চক্রবর্তী। আজ তোমার সব গল্প আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছি। এবার মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অপরাধে বুড়ো বয়সে যে তোমায় জেলের ঘানি টানতে হবে বাছা।’ এরকম একজন বয়স্ক মানুষকে বাছা বলার প্রতিবাদ করতে যাব ততক্ষণে ওনার ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে ফেলেছেন বড়বাবু। কিন্তু ঘুরে তাকানোর বদলে বন্দুকের সামান্য স্পর্শেই শ্যামবাবুর নিথর দেহটা উপুড় হয়ে সিড়ি থেকে পড়ে গেল। এবার বন্দুকের নল ঘুরল আমাদের দিকে। শ্যামচরণ ভট্টাচার্যকে খুন করে গুপ্তধন হাতানোর অপরাধে তোমাদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি... বলতে বলতেই চোখ পাকিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন বড়বাবু।‘ইনিও কি তাহলে টপকে গেলেন নাকি?’ বললাম আমি।‘পুলিশের হার্ট এত দুর্বল নয়। এত সহজে টপকাবে না। বাইরে নিয়ে গিয়ে জলের ঝাপটা দাও ঠিক হয়ে যাবে।’ শ্যামবাবুর গলা শুনে দুজনেই চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। শুধু একরাশ আদিম গন্ধ নাকের উপর আক্রমণ হানিয়ে জানিয়ে যায় তার অব্যক্ত যন্ত্রণা।জ্ঞান ফেরার পর বড়বাবু নিজের উদ্যোগে গ্রামের উন্নতিকল্পে কিভাবে সেই গুপ্তধন ব্যয় করা যায় তার উপদেশ দিতে শুরু করলেন। আমরাও ওনার এহেন পরিবর্তনে হতবাক। শুধু শ্যামবাবুকে আর বাঁচানো গেল না। প্রতিশোধের আগুনে আর দাদার মুক্তির আশায় তিনি আশিটা বছর কাটিয়ে দিলেন। একেই বোধহয় বলে ভ্রার্তৃপ্রেম। হয়ত তাঁর পুত্র-পুত্রবধু এখন গভীর ঘুমে মগ্ন, জানতেও পারলনা বাবার এইভাবে মৃত্যুর কথা। কিন্তু পুলিশ আছে যখন, নিশ্চয়ই জানাবে। হাজার-হোক, রক্তের টান তো ওনাদের সাথেই। আমরা তো ওনার কাছে দুদিনের সহচর মাত্র।‘আচ্ছা সবই তো হল, আরও একটা খটকা...’ আমি বললাম।‘আবার!’ দিগন্তবাবু হাসতে হাসতে বললেন।‘হ্যাঁ, বলছিলাম ম্যাপে যে দেখাচ্ছে উল্লিখিত স্থানটি অর্থাৎ স-হ-ড় ত্রিভূজটি আমাদের গ্রামে অবস্থিত। এদিকে আমরা গুপ্তধন পেলাম স্বর্ণগ্রামে। ব্যাপারটা যদি একটু খোলসা করেন...’‘ভূগোলে নিশ্চয়ই পড়েছ যে নদীর এই ধরণের অতিরিক্ত বাঁক ধীরে ধীরে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে পরিণত হয়, আর নদী ধীরে ধীরে ঘুরপথ ছেড়ে সোজাপথে প্রবাহিত হতে শুরু করে। জঙ্গলের ওই পাশে জলাশয়টা খেয়াল করেছ?আচ্ছা এবার তোমাকে একটা টেকনিক্যাল প্রশ্ন করি।”‘নিশ্চয়ই’, আমি বললাম।‘আগের দিন ফ্লুইডের ক্লাসে লাগ্রেঞ্জিয়ান অ্যাপ্রোচ আর অয়লারিয়ান অ্যাপ্রোচ পড়িয়েছিলাম। বর্তমান ঘটনাটাকে তুমি এই দুটোর মধ্যে কোন শ্রেণীতে ফেলবে?’এই চ্যাপ্টারের প্রথমে থাকা এই দুটো জিনিসই মাত্র আমি পড়েছিলাম। তাই উত্তর দিতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলনা।‘নিঃসন্দেহে অয়লারিয়ান ভূত এগুলো। লাগ্রেঞ্জিয়ান হলে তো দেশে দেশে ঘুরে লোক মেরে বেড়াত।’‘একদম, প্রাক্টিক্যালে তোমার জন্য দশ নম্বর এক্সট্রা রইল।’আনন্দে মনে মনে নেচেনিলাম
খানিকটা।..........................................................................................রবিবার সকাল। বাড়ির সবাই আজ দুপুরে ফিরবে। আমরাও এসপ্তাহের ছুটি শেষ করে ফিরে যাব কলেজ জীবনে। তার আগে একবার খেলার মাঠটা দেখতে এলাম। শ্রাবণীর ধারে বসে দিগন্তবাবু গুনগুন করে কি যেন বলছেন। ভালো করে কান পেতে শুনলাম, এ যে নিশীথবাবুর সেই কবিতাঃ‘পা ধুয়ে নিই প্রবাহমানা জলে,ছলাৎ ঢেউ উথলে উঠে বলেঃশুনবি নাকি আমার কথা চুপে?কেমনে বাঁচি ইতিহাসের স্তুপে?’আমিও গলা মেলালাম তাঁর সাথে,‘কতটা পথ পেরিয়ে এসেছো তুমি,আরও কতক পেরিয়ে যাওয়া বাকী;আমার ঘড়ি তোমার জলস্রোত,ইতিহাসের পরোয়া করে নাকি!’ হপ্তা দুইয়ের গদ্য দেশের ডায়েরি- ৪আমাদের ছোটবেলায় কল্যাণী একটি প্রায়-গ্রামদেশ ছিল । আম, জাম, তেঁতুল, নিমের বৃক্ষ ছিল অগুনতি। দিগন্ত বিস্তৃত (তখন সেইরকমই লাগত) মাঠ আর নানাপ্রকারের সবুজের হাল্কা ঘন শেডের ফাঁকে ফোকরে কোলকাতা শহর থেকে দুদিনের জন্য হাঁপ ছাড়তে আসা শৌখিন মানুষদের বাড়ি ছিল গোনাগুনতি। সুন্দর সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। কোনো বাড়ির ভিত কাটা হলেই কেমন করে যেন আমরা খবর পেয়ে যেতাম। যতক্ষণ না ইঁট, বালি, সুরকি, সিমেন্ট পড়ছে, ততক্ষণ সেই কাটা ভিতে, মাথা সমান মাটির গভীরে ঢুকে আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলতো সারা বিকেল। মাঝে মাঝে বাড়ির মালিকেরা কলকাতা থেকে এসে গাছের তলায় মাদুর পেতে বসে স্বপ্ন বিধুর চোখে, তদগত চিত্তে সেই খালি জমির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কখনো পুরোনো বাসিন্দাদের সাথে বাড়ি সংক্রান্ত আলাপ আলোচনায় মেতে উঠতেন। আমরা ছোট ছিলাম কিন্তু তবুও বুঝতে অসুবিধে হতনা যে বাড়ি ঘিরে তাঁদের কত শত স্বপ্ন! সামনে কেয়ারি করা এক চিলতে ফুলের বাগান হবে। পাঁচিলের পাশ ঘেঁষে সারি সারি দেবদারু গাছ বিকেলের রোদ মেখে লেকের থেকে আসা মিষ্টি হাওয়ায় পাতা নাড়বে মুহুর্মুহু। একদিকে শক্ত পোক্ত কোনো গাছের ডাল বেয়ে দোলনা ঝুলবে। বাড়ির গেট খুললেই লালচে সুরকি বেছানো পথের পাশে সম্ভ্রম জাগানো তুলসী মঞ্চ থাকবে। আর তাতে একটি বাচ্চা তুলসীগাছের ছোট্ট শীর্ষ দীপ্ত ভঙ্গিতে আকাশ ছুঁতে চাইবে। পেছনে কেয়ারটেকারের ঘরের ছাদের অ্যাসবেসটারের চাল বেয়ে লাউ, কুমড়োর লকলকে লতা লতিয়ে উঠবে একদিন। আর আজকের মধ্যবয়সের দ্বার ছুঁয়ে থাকা থাকা যুবক, কালকে প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে পৌঁছে, ধুলো ধোঁয়ার শহরের পাট চুকিয়ে সবুজের সমারোহে, সতেজ আবহাওয়ায় অবসরপ্রাপ্ত অলস জীবন কাটাবার স্বপ্ন সাকার করতে এসে পৌঁছবে এই ঠিকানায়। যদিও তাঁদের স্বপ্নালু চোখ বিরক্তিকর কুঁচকে উঠতো যখন তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যত স্বপ্নপ্রতীম বাসস্থানে আমাদের হুটোপাটা করতে দেখতেন। তবুও সত্যিই বকাঝকা খাইনি বিশেষ। হয়ত ভবিষ্যত অতি বিচ্ছু প্রতিবেশীদের বিগড়ে রাখবেন না এই সংকল্পে মুখখানা পেঁচোপনা করে নিজেদের বিরক্তি-ক্রোধ কোনক্রমে গিলে নিতেন।সেই সব মায়াবী দিনগুলোতে তাদের আগমন ছিল নিয়মিত। কিন্তু কখনো তারা ঘরের চৌহদ্দির ভিতরে পা বাড়াত না। দূরে, বাগানে আচমকা ঘন সবুজ পাতার আড়ালে আবডালে তাদের পোড়া মুখ নজরে আসত। অনেক সময় কিছু দেখা না গেলেও যখন সজোরে আম-জামগাছের ডালগুলো আচমকা উত্তাল হয়ে উঠত, তখন বোঝা যেত যে তারা এসেছে। আজ সেইসব বৃক্ষের দল অন্তর্হিত। একসময় যে তেঁতুলগাছটির মস্ত গুঁড়ির আনাচে-কানাচে, মাটির ওপর তীব্রভাবে উঁচু হয়ে জেগে থাকা শিকড়ের গলি ঘুপচিতে আমাদের কাল্পনিক পাঠশালা ছিল, এখন সেখানে ঝাঁ চকচকে অ্যামাজনের অফিস। কালবৈশাখীর তুমুল ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে দৌড়ে সবার আগে পৌঁছনোর তীব্র উল্লাস মনে নিয়ে যে কাঁচামিঠে আম দিয়ে জামার কোঁচড় ভরাতাম, সেই আমগাছের জায়গা এখন নিয়ে নিয়েছে আধুনিক বিউটি পার্লার। পুজো পার্বনে একছুটে দুর্বা নিয়ে আসা ঘাস জমিতে শান বাঁধানো সিমেন্টের প্রলেপ। প্রতিবেশী দেশের বহু মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে, রাশি রাশি কাঁচা টাকা সহ এদেশে এসে কল্যাণীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিয়েছেন। অকাতরে গাছের পরে গাছ কেটে, বস্তা বস্তা সিমেন্ট ফেলে তাদের জন্য কংক্রিটের খুপরি তৈরী হচ্ছে। বিধান রায়ের সুপরিকল্পিত ছোট্ট শিল্পাঞ্চলটিতে এমস আসছে। শুনলাম এয়ারপোর্টও নাকি তৈরী হবে। প্রতিদিন জ্ঞাতে অজ্ঞাতে কত যে পাপকর্ম সাধিত হচ্ছে আমাদের দ্বারা! বাপ-ঠাকুর্দার বয়সী, মা-দিদিমার মত, যারা জন্ম থেকে শুধু দিয়েই এসেছে, উন্নয়নের লোভে তাদের ওপর কুঠারের আঘাত হানছি নির্মম হস্তে। বোবা, তাই তাদের বিলাপ আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছোয় না, আর আমরা এমন অন্ধ যে নিজেদের ভবিষ্যতও দেখতে চাইনা। নিজেরা খেয়ে পড়ে, ভালোভাবে শ্বাস নিয়ে এই জীবন হয়ত পার করে দেব। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম? সেই নিয়ে কথা বলতে একদিন দেখা করতে গেলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের সাথে। তাঁরাও যে ভাবছেন না তা নয়। এটা ওটা করছেন। তবে ভেবে আর আড্ডাপাতায় গদ্যরচনা করে তো কোনো লাভ নেই, কঠোর বাস্তবকে উপলব্ধি করে সুপরিকল্পিত কিছু ব্যবস্থাপনা চাই। এত বছরের পাপ ধুতে সামনের বহু বছরের একনিষ্ঠ কর্মযোগ চাই। দেখা যাক। যা বলছিলাম, এখনও হনুমানের দল মাঝে মাঝে আসে। আসলে আসে না, হানা দেয় বলাই সঙ্গত। পাঁচ সাতজনের মিলিত দল। মা হনুর কোঁখে সদ্যোজাত। চোখ ফোটা অবস্থা থেকেই তারা মায়ের বুকে লেগে থেকে থেকে দিব্যি চুরি- ছিনতাইয়ের থিওরিক্যাল অংশটি শেখে। উন্নয়নের জেরে তাদের খাদ্য সম্ভারে স্বাভাবিকভাবেই টান পড়েছে। তাই তারা এখন প্রচন্ড হিংস্র হয়ে উঠেছে। সোজাপথে খাবার না জুটলে, কেড়ে কামড়ে খাবার সংগ্রহ করতে একটুও দ্বিধা দেখায়না। ওদের দলনেতা প্রথম সুযোগেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে আসে। অপেক্ষারত বাকি সদস্যরা তখন পাঁচিলে ওপর সার সার বসে কিচকিচে ভাষায়, মুখ ভেঙচে একে অপরের সাথে আলাপচারিতায় মত্ত থাকে। আপনি হয়ত বারান্দায় বসে একমনে সকালের খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে গরমাগরম চায়ে গলা ভেজাচ্ছেন। হঠাৎ দেখতে পারেন, হনুনেতা খোলা সদর দরজা দিয়ে গটগট করে আপনার পাশ কাটিয়ে আপনারই ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল! আর খানিক পরে হতভম্ব আপনার দিকে দৃকপাতও না করে, ডাইনিংয়ের টেবিলের ওপরে রাখা ফল পাকুড় ছেড়ে ফ্রিজের ওপরে রাখা চকোলেটবা বিস্কুট নিয়ে ধীরে সুস্থে বেরিয়ে গেল। পছন্দের জিনিস তুলে ঘর থেকে বেরোবার পথে যদি আপনার প্রতিবাদের সম্মুখীন হয় তবে কি হতে পারে তার চাক্ষুষ প্রমাণও পেলাম।সত্যি মিথ্যা জানিনা, বাজারে দূর থেকে এক ভদ্রলোককে দেখানো হল। স্কার্ফ দিয়ে মাথা, মুখ পেঁচিয়ে ঢাকা। শুনলাম এক হনু তাঁর বাড়ির খাদ্যদ্রব্য ছিনতাই করে পালাবার পথে ভদ্রলোক তার সাথে সম্মুখ রণে অবতীর্ণ হন। ফল স্বরূপ হনুমানটি তাঁর ডানগালে এক মোক্ষম চাপাটি কষিয়ে এমন আঁচড় দিয়েছে যে তাঁর ডানগালে এখন নেই ভূমির মানচিত্র জ্বলজ্বল করছে। একটু পরে মাছ কিনতে গিয়ে তাঁর সাথে পাশাপাশি দেখা! ওজনে ঠকাচ্ছে সন্দেহে বয়স্ক মাছওয়ালাকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তুমুল বকাবকি করছেন। বুঝলাম, হনু শুধু গালে দাগ রেখে যায়নি, স্বভাবেও ছাপ ফেলে গেছে! বাইশ বেলা কোথা যে উধাও হলোপরস্বপর শ্রাবণ বায়োস্কোপঅপেক্ষায় আদুল গায় রাত কাটলোপথেসারা জনম বাইশ বেলাও মোর দরদিয়া .... https://www.youtube.com/watch?v=2TfkSI2WAqs&fbclid=IwAR3Oyr_B-EweQJA7uD26bRNnkFv_-i4sNb4yyIBiK5jkAGS1T5EpBuWlqYc ব্লগ ব্লগ লিখুন ব্লগ - বিষয়ভিত্তিক লেখার জায়গা| একাধিক পর্বে লিখতে পারেন‚ অনেকে মিলেও লিখতেপারেন|
চাঁদনী চকের হট্টমেলা সেদিন প্রায় দশ বার বছর পরে গিয়েছিলাম চাঁদনী চকের ভগীরথ প্লেসে । ভগীরথ প্লেস ল্যাম্পসেড ও ইলেক্ট্রিক্যাল জিনিষপত্রের খনি বলা যায় । ছোট বড় পাইকারী ও খুচরো দোকান । চারিদকে আলোর রোশনাই । ঢুকলেই মনে হয় আজ দেওয়ালি । চাঁদনী চক মানে উপচে পড়া ভিড় ,হৈচৈ , ঠেলাঠেলি । সরু অলিগলি । প্রতিটি বাঁকে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে হকার । ওপরদিকে তাকালে এক চিলতে নীল দেখা ভার । অগণিত ইলেকট্রিক , টেলিফোন আর কেবলের তার এঁকেবেঁকে জানজট সৃষ্টি করেছে । রাস্তার দুই পাসে গাড়ী পার্ক করা । তারই ফাঁক ফোকর দিয়ে গলে যেতে হয় । ফুটপাথ দিয়েও বেশ সর্ন্তপনে চলতে হয় ।ফুটপাথ জুড়ে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের জিনিষ বিক্রী হচ্ছে । একটু বেশামাল হলেই ঠেলাওলার ঠেলা বা মুটের ধাক্কা খেতে হয় । দোকানগুলো সব পুরানো অবয়বে ব্যবসা করে । বেশীর ভাগ দোকানেই নেই নিওন লাইটের চমকানি ।সাদা মাটা সাইনবোর্ড । রাস্তার ধারে দোকানের এজেন্ট দাঁড়িয়ে থাকে । কানের কাছে সমানে রানিং কমেন্ট্রী চালিয়ে যায় । সেল লাগা দিয়া সস্তে মে স্যুট , শাড়ী ,ল্যাঙ্ঘা- চোলী , নাইটি মিল রহে ...আইয়ে দেখিয়ে । ইয়ে হামারি দোকান কি কার্ড ............... হাতে ধরিয়ে দেবে এরকম শতাধিক কার্ড । একবার এরকম এক লোকের পাল্লায় পরে তার দোকানে গেছিলাম । সামনেই দোকান বলে গলির মধ্যে নিয়ে গেল । সে গলিতে সামনাসামনি বাড়ীর লোকেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হ্যাণ্ডসেক করতে পারে । একটা বেশ বাড়ী । দেখলেই বোঝা যায় কোনকালের ধনী ব্যক্তির বাড়ী ছিল ।ভেতরে ঊঠান ভর্তি দোকান । একপাশের সরু সিঁড়ি । একসাথে দুইজন ওঠা যায় না । দোতলায় বারান্দার চারিদিকের প্রতিটী ঘর এক একটি দোকান । এরকম ভাবে তিনতলা ঘুরিয়ে ছাদে নিয়ে তুলল । সে ছাদ থেকে আকাশ দেখা যায় না ।সারা ছাদ ভর্তি কাঠের পার্টিশন করা দোকান । দরজা ঠেলে একটীর ভেতরে নিয়ে গেল ।ভেতরে এয়ারকণ্ডিশন । মাটিতে ফরাস পাতা । মান্ধাতা স্টাইলে মাটিতে বসে কেনা বেচা চলছে । মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত আলমারী শাড়ী , সালোয়ার কামিজে ঠাসা । ওই টঙের ওপর দোকানে এত স্টক দেখে মাথা ঘুরে গেছিল । যারা জানে তারাই ওখানে যেতে পারে । ১৬৫০ সালে শাহজাহান কন্যা জাহানারার স্থাপনা চাঁদনী চক । লাল কেল্লার লাহোরি গেট থেকে শুরু হয়ে ফতেপুরী মসজিদে শেষ । মূল নকশা অনুযায়ী চৌকোনা বাজারটির দোকানগুলি বানানো হয়েছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে । মাঝখানে টলটলে দিঘি । এ ছাড়াও চাঁদনী রাতে ঝলমল করার জন্য বাজারের মাঝে নহের বা খাল কেটে জলের ব্যবস্থা করা ছিল । ১৯৫০ সালে সেই দিঘি বুজিয়ে ঘন্টাঘর বানানো হয়েছে । চাদনী চকের মূল রাস্তাটি তিন ভাগে বিভক্ত । লাহোরি গেট থেকে কোতয়ালী চক পর্যন্ত অংশটির নাম উর্দু বাজার । এখানে প্রধানত দরবারের উচ্চ পদাধিকারীদের বাস ছিল । কোতয়ালী থেকে মাঝখানের দিঘি অবধি জায়গা র নাম ছিল জহুরী বাজার । ওখান থেকে ফতেপুরী মসজিদ অবধি বাজারের নাম ছিল ফতেপুরী বাজার । যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ হয়েছে চাঁদনী চক । পাশাপাশি গড়ে উঠেছে শ্রী দিগম্বর জৈন মন্দির ,গৌরিশঙ্কর মন্দির ,শিব নবগ্রহ মন্দির ,ব্যপটীস্ট চার্চ ,গুরদুয়ারা শীশগঞ্জ সহিব , ফতেপুরি মসজিদ ,সুনহেরি মসজিদ । দিল্লী লুন্ঠনের সময় নাদির শাহ সুনেহরি মসজিদে বসে কোতলে -ই-আম ( দেখা মাত্র মেরে ফেল ) প্রত্যক্ষ করেছিল । তিরিশ হাজার লোকের প্রাণনাশ করেছিল ।শেষ মাথায় ফতেপুরী মসজিদের স্থাপনা করেছিল ফতেপুরী বেগম ( শাহজাহানের এক বেগম ) । জনস্ফিতির চাপে সেই সুন্দর পরিচ্ছন্ন বাজার পরিবর্তিত হয়েছে উত্তরভারতের প্রধান হোলসেল মার্কেটে । লালকেল্লার উল্টোদিকে বেগম সম্রুর প্যালেস পরিণত হয়েছে ইলেকট্রিক্যাল জিনিষের বাজার ভগীরথ প্লেস । গলি খাজাঞ্চির খাজাঞ্চি হাভেলি খুজে পাওয়া ভার । নিরাপদে টাকা পয়সা আনা নেওয়ার জন্য নাকি এই হাভেলি থেকে মাটির তলায় সুরঙ্গ দিয়ে লাল কেল্লার সাথে যোগাযোগ ছিল ।বলিমারানে মির্জা গলিবের হাভেলি অবশ্য মিউজিয়াম হয়েছে ।নীল কাটরার চুনরমল নামে এক ধনী বস্ত্র ব্যবসায়ীর হাভেলি পরিণত হয়েছে সালোয়ার কামিজের পিসের হোলসেল মার্কেটে । দিল্লী আসার প্রথম দিকে মাঝে মাঝেই লাল কেল্লার পারকিং এ গাড়ী রেখে চাঁদনী চকে যেতাম । এমনি দিনে দোকান পাট খোলা , রবিবারে মার্কেট বন্ধ কিন্তু সেদিন ফুটপাথ জুড়ে বিরাট বাজার । চাঁদনী চকের ওলিগলিতে ঘোরা একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেছিল । কত কিছু পাওয়া যেত । কিনারী বাজারে সেলাই র জিনিষ ,পাথরের সম্ভার । দরীবাকালানে ছোট ছোট সোনা চাঁদীর দোকানের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ রোমাঞ্চিত হতাম । পরোঠেওলা গলি দেখে বেশ হতাশ হয়ে ছিলাম । গলিতে পরোঠা র দোকানের থেকে শাড়ী জামাকাপড়ের দোকান বেশী । পরোঠার দোকানে যে কাল তেলে পড়োঠা ভাজছিল তা দেখে খুব একটা খেতে ভক্তি হয় নি । নীল কাটরার কিছু গলি দুইজনে একসাথে যাওয়া যায় না । কিন্তু ঢুকলে মনে হয় শাড়ী ,সালোয়ার কামিজের কাপড়ের খনিতে এসে পড়েছি । দেখেশুনে কিনতে পারলে বেশ সস্তায় পাওয়া যায় । পারকিং তুলে দেওয়ায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল ।আবার নাগালের মধ্যে এনেদিয়েছে মেট্রো । এখন চাঁদনী চক আর লাল কেল্লা দুটো স্টেশন থেকেই যাওয়া যায় । আবার জৌলুস ফিরে পাচ্ছে চাঁদনি চক । মেট্রো থেকে নেমে গলি পেরিয়ে যখন মেন রাস্তায় উঠলাম... দেখি চাঁদনী চকের ভোল একদম পালটে ফেলেছে ।চাঁদনী চকের পালে লেগেছে আধুনিকতার হাওয়া । ঝলমলে এল-ই-ডি লাইটের রোশনাই । দোকানে দোকানে কাঁচের শোকেস। জিনিষপত্র ঝলমলে আলোয় ঝিলিক মারছে । রাস্তায় ভিড় জ্যাম আছে । রিক্সার জায়গা নিয়েছে ই-রিক্সা । হলদিরাম খোলনালচে পাল্টিয়ে নতুন সাজে সেজেছে । সাজতে ত হবেই কারন পাশেই পা নাচাচ্ছে ম্যাগডোনাল্ড বাবু । নতুন জোয়ারে গা ভাসিয়েছে চক । চিরাচরিত বাঙ্গালী মিষ্টির দোকান অন্নপূর্ণা সুইটস বা ঘন্টিওলা মনে হল উঠে গেছে । শ্রাবণীর বাঁকে ১দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। বর্ষাকাল এখন, ধানের বীজতলাগুলো সবুজে সবুজ। প্রথম যখন ধান ছড়ানো হয়, এই বীজতলাতেই। তারপর একটু বড় আর ঘন হয়ে যখন এরা মনোমুগ্ধকর সবুজে ভরিয়ে দেয়, এদেরই তুলে নিয়ে গিয়ে লাগানো হয় সারা মাঠজুড়ে। কোথাও কোথাও সেই কাজ শুরুও হয়ে গেছে। গ্রামের নাম মনোহরা, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী শ্রাবণী। সারা বছর অল্পবিস্তর জল বয়ে গেলেও বর্ষাকালে, বিশেষ করে শ্রাবণ মাসে এই নদী ধারণ করে মাতৃমুর্তি। সেই জলে সমৃদ্ধ হয় এপারের গ্রাম মনোহরা আর ওপারের স্বর্ণগ্রাম, যাকে সবাই সোনাগাঁ বলেই চেনে।একটু একটু করে দৃশ্যপটে ফুটে উঠছে এপারের গ্রামখানি, মনোহরাই বটে। যেমন তার রূপ তেমনি সবুজে সবুজ। নদীর পারে একখানি খেলার মাঠ। লম্বায় চওড়ায় একটা বড় আয়তনের ফুটবল মাঠের চেয়ে কোনও অংশে কম হবে না।আজ একটা বিশেষ দিন, যে কারণে এই মাঠে এত বেশি খেলোয়ার জড়ো হয়েছে। অন্য দিন দুই দলে পাঁচ-ছয়জন করে খেলোয়াড় জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়, আর আজ, পনেরজন করে খেলছে এক এক দলে। হবে নাই বা কেন। আজ যে এই গ্রামের গ্রাম্য দেবীর পূজো। গ্রামের ছেলেরা তো এসেছেই, আর এসেছে অতিথিরা। সারাদিনের পূজোর আনন্দ কাটিয়ে বিকেলটায় অল্প খেলাধূলা হবে। খিদেটাও বেশ বেড়ে যাবে এতে। সন্ধ্যেবেলার আহারটা ভালই জমবে।অল্প কাদায় খেলাটাকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা। এমন কাউকে দেখা যাচ্ছেনা যে কর্দমাক্ত হয়নি। তবুও সম্পূর্ণ উদ্যমে চলেছে সে খেলা। দুইপাশের গোলরক্ষক মনের আনন্দে বসে ঘাস চিবোচ্ছে, আর বল ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঝমাঠে, বলা বাহুল্য বাকী সব খেলোয়ারকে ওই মাঝমাঠেই দেখা যাচ্ছে।এই ধরণের কাদা মেখে খেলার একটা সুবিধা আছে, অসুবিধাও বলা যায়। যেমন ধরুন আপনি বল দাবী করলেন অন্য দলের ছেলের কাছে, সেও নিজের দল ভেবে বল বাড়িয়ে দিল। এতে আপনার যেমন সুবিধা হল, যেকোন সময়েই আপনিও এই অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন, এটাই অসুবিধা। আরে মশাই, নিজের নিজের দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে এগারোজনের মাঠে বড় বড় খেলোয়াররা ভুল করে, আর এখানে তো...এই খেলায় যেহেতু নিরপেক্ষভাবে বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন, সেহেতু আমি মাঠের দুটো দিকের একটাকে গ্রামের দিক অর্থাৎ এদিক আর অন্যটাকে ওদিক বলে অভিহিত করব।...খেলা শুরু হওয়ার দশ মিনিট অতিক্রান্ত, এখনও পর্যন্ত কোনপক্ষই কোন গোল করতে পারেনি। অবশ্য গোল হতে গেলে ন্যুনতম বলটার স্থিতাবস্থার গতিশীল অবস্থায় পরিবর্তিত হওয়া প্রয়োজন। দুএকবার বলটার গতি এলেও তা এসেছিল মধ্যরেখা বরাবর। হবে নাই বা কেন। সার দিয়ে দুপাশে দশজন করে দাঁড়িয়ে থাকলে কি করেই বা বল এদিক ওদিক যেতে পারবে। এপাশের ট্যারা দেয় ওপাশের ভুতোকে। ভুতো আবার দুম করে একটা শট নেওয়ার চেষ্টা করে সোজা এদিকের গোল বরাবর, কিন্তু সঠিক ভাবে পায়ে-বলে না হওয়ার কারণেই হোক আর অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণেই হোক বল সোজা না এসে নব্বই ডিগ্রি গেল বেঁকে। আবার মধ্যরেখা বরাবর এপারের দিলীপ, দিলীপের থেকে বল কেড়ে নিল এপারেরই নেপাল (চিনতে ভুল করে বোধহয়)। দেখা যাক সে হয়ত নতুন কিছু করবে, কিন্তু না, দৌড়ে এসে ওপারের দুজন প্লেয়ার একসাথে পা চালাল বলের উপর। এরা সম্ভবত এই গ্রামের নয়, পুজোর ভোজ খেতে এসেছে এ-গাঁয়ের কোনও আত্মীয়বাড়ি। নেপাল একটু বল কাটাতে জানত, তাই এপা-ওপা করে বলের উপর আসা ওপারের আঘাত বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেল, আর তখনই দুর্ভাগ্যবশত সেই আঘাত গিয়ে লাগল তার নিজেরই পায়ে। বিপক্ষের জোড়া পায়ের আঘাতে ‘ওরে বাবারে’ বলে বসে পড়ল সে বলের উপরে। আরও দুচারটে লাথি কষিয়ে নেপালের থেকে বল কেড়ে নিল তারা। কি ভাবছেন? ফাউল? ওসব দাবি করে সময় নষ্ট করে না এ গাঁয়ের ছেলেরা। রেললাইনটা বেশ কিছুটা দূরে হলেও ট্রেন এলে দেখা যায়। তাই চারটের ট্রেন গেলে খেলা শুরু হয় আর ছ-টার ট্রেন এলে খেলা শেষ। এর মাঝে যদি কারও কিছু ইয়ে পায় তাহলে কাছাকাছি থাকা নিজের দলের যেকোন সদস্যের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেলেই হল। মোটকথা, কোন বিরতি এখানে দেওয়া হয়না।এইভাবেই অনেকক্ষণ ধরে মাঝমাঠে বল নিয়ে টানাহিঁচড়া করার পর এদিকে বল আসার একটা প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে এপারের রক্ষণভাগের শোভন জোরে একটা শট নিয়েই প্রচণ্ড বেগে ওপারের দিকে ছুটে গেল। যেহেতু সবাই মাঝমাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওপারে পৌঁছে বলও পেয়ে গেল সে। ওপারের গোলরক্ষক বিকাশ বেগতিক দেখে দৌড় দিল বলের পানে। এতক্ষণ পর মনে হল কিছু একটা হবে। গোলের প্রায় কাছাকাছি শোভন পৌঁছেও গেল। কিন্তু শেষ অব্দি বিকাশকে ছুটে আসতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে কিছুটা আগে থেকেই নিল প্রচণ্ড জোরে একটা শট। এপারের বাকী চোদ্দজনের সমবেত চিৎকার গোওওওওওল...; কিন্তু বল গোলের দশ হাত বাইরে দিয়ে বেঁকে হাওয়ায় অনেকটা সাঁতরে সোজা পৌঁছলো নদীর ওপারে।এবার বাঁধল গোল। কে যাবে নদীর ওপারে সেই নিয়ে। যদিও বেশিরভাগ ছেলেই সাঁতার জানে, এবং নদীটাও ততটা চওড়া নয়, কিন্তু কেউই বর্ষাকালে স্ফীত নদী ডিঙিয়ে ওপারে যেতে রাজি হল না। তাছাড়া বলটা গেছে পরিত্যক্ত জঙ্গলটার দিকে; নিতান্ত জরুরী দরকার না পড়লে সচরাচর কেউ সেদিকে যায়না। ওই গাঁয়ের রাখালদের হাঁক দিলে হয়ত বলটা খুঁজে দেবে, কিন্তু তেমন কাউকে আজ দেখাও যাচ্ছেনা। হয়ত নেমন্তন্ন খেতে এপারের বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে এসেছে কেউ কেউ সেতু পেরিয়ে। কিন্তু সে সেতু তো অনেক দূর। প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা। তাহলে কি আজ আর খেলা হবেনা?আর একটা বল অবশ্য ছিল, পরশু সেটাও লিক হয়ে গেছে। এই হয়েছে আজকাল বড় এক অশান্তি। লিক হয়ে গেলে তা সারাবার লোক পাওয়া যায়না। প্রথমে যাওয়া হয়েছিল সাইকেল সারাবার দোকানে। সে বলল, সেলাই করা বা বলের চামরা কাটা তার কাজ নয়। সে শুধু লিক সারিয়ে দেবে। অনেক কষ্ট করে একজন সেলাই করার লোক পাওয়া গেল, সে বলল সে নাকি ফুটবলে হাত লাগাবেনা। অনেক নোংরা জিনিস মিশে থাকে এর মধ্যে। আর একজন সেলাইয়ের লোক আছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে পরের হাটবারে, আরও তিনদিন পর। ততদিন এই এক্সট্রা বলটাই ছিল ভরসা, সেটাও গেল। একে তো পুজোর দিন, এই আনন্দ কি আর সারাবছর পাওয়া যায়! সুতরাং, যেকোন ভাবে বলটা এনে এখনি খেলার ব্যবস্থা করতেই হবে। কিন্তু পূজোর দিনে নদীতে নামতে কেউই রাজী নয়।তখন সবার নজর গেল ছোট্ট বিনুর দিকে। সে বেচারা রোজ খেলবার আশা নিয়ে আলপথ, মা পেরিয়ে এতদূর ছুটে আসে খেলতে সুযোগ পাওয়ার আশায়। যেদিন ছেলে খুব কম থাকে সেদিন সুযোগ পেলেও সাধারণত বড়দের সঙ্গে খেললে হাতে পায়ে লেগে যাবে এই অজুহাতে তাকে খেলতে নেওয়া হয়না। তাই গোলের পিছনে বল গেলে, কিংবা মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেলে বল কুড়িয়ে একটা দুটো শত মেরে মাঠের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়েই সে খুশী থাকে।- এই বিনু তুই একটু ওপার থেকে বলটা এনে দিবি? খেলতে পাবি তাহলে আজকে।- ধুর, এই ভিড়ের মধ্যে তোরাই খেলতে পাচ্ছিসনা আবার আমি খেলব...বিনুর সোজা সাপটা জবাব। ছোট বড় নির্বিশেষে এই মাঠে সবাই সবাইকে তুই বলেই ডাকে।- চানাচুর চলবে? পঞ্চাশ?- একশ হলে বল।একশ গ্রাম চানাচুরের চুক্তিতে বিনু নদী পার হতে রাজী হয়ে গেল। কি অপরূপ দক্ষতায় স্রোতস্বিনী নদী পার হয়ে তরতরিয়ে সে ওপারে চলে গেল। তারপর ঝোপের দিকটায় গেল বল আনতে।.........................................................................................‘মিনিট পনের কেটে গেল, এখনও ছেলেটা ফিরলনা। একবার দেখে আসা দরকার নাকি রে?’ সন্তোষ বলল।শোভন বেশ খানিকটা হতাশ হয়ে বসেছিল, মনেহয় গোলটা না হওয়ার দুঃখেই। সে এবার মুখ খুলল, ‘দেখ ফাজলামি করছে হয়ত। একবার ডেকে দেখি চল।’সবাই মিলে এক এক করে ডাক দিল তারা, কোন সাড়া নেই।কোন বিপদ হলনা তো? শেষ পর্যন্ত ওপারে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সবাই যেতে রাজী না হলেও জন দশেক ছেলে সঙ্গে পাওয়া গেল। জঙ্গলে সত্যিই যদি কোনও বিপদ থেকে থাকে তখন সবাই মিলে থাকলে একটা আলাদা মনোবল পাওয়া যায়।সাঁতরে ওপারে পৌঁছে যেটা দেখা গেল তাতে সবাই স্তব্ধ। একজন যুবকের মৃতদেহ, কিছুদিনের পুরনোই হবে, উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আর তার সামনে বসে ভিজে মাটিতে একটা কঞ্চি দিয়ে আঁক কেটে চলেছে বিনু। চারিদিক শান্ত, নিঃশব্দ।সাহস করে শোভন ডেকে বসল, ‘বিনু...বিনু...’যে ক্রোধভরা হিংস্র দৃষ্টিতে ঘুরে তাকাল বিনু, তাতে অনেকেরই হাড় হিম হয়ে গেল। চোখ মুখ লাল, দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, অথচ শরীর যেন অবশ, কারও ছোঁয়া লাগলেই পড়ে যাবে, এমন। তারপর উঠে দাঁড়াল সে। দিলীপ এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে বলটা কোথায়? অপ্রত্যাশিতভাবে, এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিল বিনু, আর দিলীপ ছিটকে গিয়ে পড়ল মাটিতে। কোমর ধরে বসে পড়ল সে। এরপর শোভন এগিয়ে গেলে, সামনে হাত বাড়িয়ে শোভনের বুকে সে এমন এক ধাক্কা দিল, হুড়মুড়িয়ে বাকি সবার উপর এসে পড়ল সে। তখন সবাই মিলে চেপে ধরে চেষ্টা করা হল বিনুকে শান্ত করার। কিন্তু ছোট্ট হাতের তখন সে কি জোর। সবাইকে ছিটকে ফেলে দেয় একসাথে।তারপর থরথর করে প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে থাকে আর বলে চলে একটাই ছড়া,‘মুখ করে পূবপানে দাঁড়া মাঝখানেসোজা গিয়ে শেষকালে ঘোর তুই ডানে।এইভাবে কর আরও তিনেক বারজেনেও যেতে পারিস কিবা হবে আর।’কয়েক বার চিৎকার করে এই ছড়া বলার পর মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। ওই ভয়ের মধ্যেও সবার মনের মধ্যে তীক্ষ্ণভাবে গেঁথে গিয়েছিল ছড়াটি। ছড়ার বয়ান অনুযায়ী পূর্বদিকে তাকায় সবাই। সেদিকে, মাটিতে কঞ্চির আঁচড়ে যে সংকেতটা আঁকা আছে, তা নিম্নরূপ,লে । চ । চাছে । ভ । যর । ড়ি । বাপুলিশকে খবর দিতেই হল এবং তদন্তের সাহায্যার্থে পুলিশকে সবটা জানানো হল। সংকেত অনুযায়ী মাঝখানে আছে ‘ভ’, সেখান থেকে সোজা গেলে ‘ভচ’ তারপর ডানদিকে ঘুরে হয় ‘ভচচা’, তারপর আরও তিনবার ডানদিকে ঘুরে পাওয়া যায় ‘ভচচাযবাড়িরছেলে’। সোনাগাঁয়ে কোন ভট্টাচার্য পরিবার থাকেনা এবং মনোহরা গ্রামে একটি মাত্র পরিবার যেখানে মা আর ছেলে বাস করেন। পুলিশ তো এই সংকেত পেয়ে মহা খুশি এবং হাতেনাতে অলৌকিক শক্তির দ্বারা যে খুনি ধরা পড়ল, সর্বোপরি তাঁরাই যে গুপ্ত সংকেত-এর মানেটা উদ্ধার করেছেন সে খবর ফলাও করে ছাপা হল।তার ফলস্বরূপ ভট্টাচার্য বাড়ির একমাত্র ছেলেকে জেল খাটতে হল খুনের অপরাধে।২নমস্কার, আমি বিকাশ, এখন থেকে এই গল্পটি আমার বয়ানে পাবেন। কারণ আগের ঘটনাটি যিনি লিখেছিলেন, সেই নিশীথবাবু মারা গিয়েছেন দুদিন হল। স্থানীয় সংবাদপত্রে তার ডায়েরী থেকে উদ্ধার পাওয়া এই ঘটনাটি ছাপা হয়েছে জন সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। বিধির কি বিধান দেখুন! জনতাকে সচেতন করা হচ্ছে যাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে, উনি নিজেই এতটা অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও রয়ে গেলেন অসচেতন এবং ঘোর মৃত্যু এসে গ্রাস করল তাঁকে।বিনুর উপর দিয়ে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর প্রায় দুবছর কেটে গেছে। এখন আমার ইঞ্জিনিয়ারিং - দ্বিতীয় বর্ষ। ক্লাস চলছে ফ্লুইড মেকানিক্স এর। প্রোফেসর দিগন্ত দেব নিজের মনে ক্লাস নিয়ে চলেছেন। এদিকে আমি নিজের মত করে লিখে চলেছি ক্লাস ডায়েরী। লাস্ট বেঞ্চে বসার এই এক সুবিধা। সেসব যাক, বরং ডায়েরীতেই মন দিইঃসেই সব দিন, পাশের বাড়ির গৌরী গেয়েই চলেছে সকাল থেকে সেই এক কর্ণপীড়াদায়ী লাইন, ‘তোড়া যে যা বলিসস ভাই, আমাড় সোনাড় হড়িন চাই’; ‘স’ এর উচ্চারণ যেখানে প্রকৃতই ‘স’ এর মত।এদিকে গ্রামের বখাটে ছেলেরা একটা ছড়া বানিয়েছে যেটা রাস্তায় ঘাটে নাকি প্রায়ই শোনা যায়, ‘ভচচায বাড়ির ছেলে/খুনের দায়ে জেলে।’ নিশীথবাবুর হঠাৎ করেই মৃত্যু হল সেই একই জায়গায়, দুবছর আগে যেখানে ওই ঘটনাটি ঘটেছিল। এত এত ঘটনা রোজ গ্রামে ঘটে চলেছে আর আমি এখানে বসে সময় নষ্ট করছি সামান্য পড়াশুনার পিছনে? যেগুলো আগেই লোকে আবিষ্কার করে গেছে, নতুন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা যেখানে নেই, থাকলেও অন্তত আমার দ্বারা যেটা সম্ভব নয়, সেই বিষয়ে পড়াশুনা করে আমি কি পাবো?- চাকরী... এই যে ক্লাসে বসে এইসব হিজবিজি লিখলে চাকরী তো দূরের কথা, পাশই করবে না। দেখি দেখি কী লিখেছ?এই বলে তিনি আমার খাতাটা কেড়ে নিলেন এবং দুচারলাইন যা লিখেছিলাম পড়লেন। তারপর খাতার ফাঁকে রাখা ভচচায বাড়ির ছেলের জেলে যাওয়ার খবরের জেরক্সটা দেখলেন এবং চুপিচুপি বললেন, ‘এটা কি ভৌতিক ঘটনা? আমি রাখতে পারি একদিনের জন্য?’কেউ বাংলা লেখা চেয়ে পড়লে মনটা খুশীতে ভরে যায়। বললাম, ‘নিশ্চয়ই রাখবেন। হ্যাঁ, এটা সত্যি ঘটনা, এবং আমার নিজের চোখে দেখা।’দিগন্তবাবুর চোখদুটো চকচক করে উঠল, অবশ্য সেটা বুঝতে না দিয়ে জেরক্সটা নিয়ে টেবিলে গেলেন এবং গম্ভীর মুখে পড়ানোয় মন দিলেন। ক্লাস শেষে ধমকের সুরে আমাকে বলে গেলেন, ‘টিফিনের পর দেখা করবে একবার আমার সঙ্গে।’টিফিনের খাওয়াদাওয়া শেষে ভয়ে ভয়ে গেলাম টিচার্স রুমে। না জানি কি ধরণের ব্যবহার করবেন তিনি আমার সাথে। উনি তখন গল্পের শেষ পাতাটা পড়ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘আরে বিকাশ যে, এসো। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই চেয়ারটায় বসো।’পাশেই বসে ছিলেন সুচন্দ্রা ম্যাডাম। উনি আমাদের মধ্যে কোনও গভীর ব্যাপারে আলোচনা হবে আন্দাজ করে উঠে গেলেন।এই ফাঁকে সুচন্দ্রা ম্যাডামের ব্যাপারে একটু বলে নিই। উনি স্বভাবে শান্ত, নিরীহ। শাড়ির সাথে কেটস জুতো পড়ে অফিস আসেন, এবং যেকোন প্রশ্নের, তা সে যত সহজই হোক না কেন, উত্তর দিলেই সারা ক্লাসকে হাততালি দিতে উৎসাহিত করেন। কোন জটিলতার মধ্যে এবং অন্যের কথায় থাকেন না। তাই হয়ত এই মুহূর্তে তিনি বেরিয়ে গেলেন।এখন দিগন্তবাবুর গম্ভীর ভাবটা কমে এসেছে। তিনি অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা সত্যি নাকি? এখানে আবার তোমার নামও আছে দেখছি। তার মানে তুমি এই পুরো ঘটনাটা সামনাসামনি দেখেছো?’‘হ্যাঁ, এবং যিনি এই গল্পটা লিখেছিলেন, তিনিও ওই একইভাবে, একই জায়গায় গতকাল মারা গেছেন।’ আমি হতাশার সুরে বললাম।‘তাহলে তো ‘ভচচায বাড়ির ছেলে’ অভিযোগটা ধোপে টেকে না? নিশ্চয়ই এরপর ছেলেটা জেল থেকে ছাড়া পাবে।’ দিগন্তবাবুর চোখে তখন উত্তেজনা ভরপুর।‘সে তো আগেই পাওয়া উচিৎ ছিল। পোস্টমর্টেমে যখন বেরোল যে শ্রী গোবিন্দনারায়ণ চৌধুরী হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন, তখন সেই পুলিশ অফিসারই পাল্টা অভিযোগ আনলেন,‘হয়ত ও জঙ্গলে গিয়ে ভয় দেখিয়ে কিম্বা অন্য কোনভাবে হার্ট অ্যাটাক হতে বাধ্য করেছে। আর তাছাড়া গোবিন্দবাবুর আত্মা যখন ওই... কি যেন নাম ছেলেটার?‘বিনু’, আমি ধরিয়ে দিলাম...‘...হ্যাঁ যখন ও বিনুর মধ্যে ঢুকে তোমাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করল, তোমরাই তো বলেছ সবকিছু, সেসব কি মিথ্যা?’এরপর আর কোনও ব্যাখ্যা চলেনা। তাছাড়া নিজে হাতে কেস সমাধা করার ক্রেডিট কেইবা হাতছাড়া করতে চায়। হয়ত বেশী কিছু বলতে গেলে ধরে ফাটকে ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু একটা খটকা আমাদের থেকেই গেল।’‘কি খটকা?’‘গোবিন্দবাবুর অশরীরী যদি বিনুর মধ্যে ঢুকেই থাকবে, তাহলে সোজাসুজি অপরাধীর নামটা বলে দিলেই তো পারতেন। এইরকম একটা বাজে ধাঁধাঁ তৈরী করে সনাক্তকরণের কি সত্যিই কোনও উদ্দেশ্য ছিল?’‘সেটা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা তুমি তো সেই সময় ওখানে ছিলে, ঠিক কি কি ঘটেছিল আর একবার বল তো। মানে এমন কিছু যা এখানে লেখা হয়নি...’‘মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বিনুর জ্ঞান ফেরানো হল। বিনু এবং আমরা তিন-চারজন বাদে বাকী সবাই ঘুরপথে বাড়ি ফিরে গেল। সাঁতার কাটার রিস্ক আর কেউই নিতে চাইল না। আমরা এতটাই হতভম্ব হয়েছিলাম যে শেষ পর্যন্ত দেখে যাওয়াই ঠিক করলাম। আমদের দুই গ্রামের থানা যেহেতু সোনাগাঁয়েই, তাই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পুলিশ এল। অবশ্য তার কিছু আগেই আমাদের গ্রামের বেশ কয়েকজন এপারে পৌঁছে গেছেন সে দৃশ্য দেখতে; নিশীথবাবুও ছিলেন। অল্প অল্প পচনের গন্ধ আসছে, তবুও নাক চেপে থেকেও দেখার সে কি আগ্রহ। আমাদের কাছ থেকে সব শুনলেন তাঁরাও। নিশীথবাবু মৃতের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন এবং উপুড় হয়ে থাকা মৃতদেহকে সোজা করলেন। কি বীভৎস সে দৃশ্য। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কি এক তীব্র আতঙ্কে।বিনু বেশ ভয় পেয়েছে বোঝা গেল। যদিও ওই হঠাৎ শক্তির উদয় হওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলতে পারল না।’‘আচ্ছা এই নিশীথবাবু লোকটি ঠিক কেমন?’‘উনি অঙ্কের টিউশনি করেন এবং শখের কবি। আমি কোনওদিন ওনার কাছে পড়িনি, কিন্তু শুনেছি বিষয়গত জ্ঞান অসাধারণ। তার বাইরে সাধারণ মুখ চেনা আর কি।’‘তুমি বলছ গ্রামের লোকেদের মধ্যে নিশীথবাবুই প্রথম ওনার কাছে গিয়েছিলেন। ওনাকে ঘটনাস্থল থেকে কোন জিনিস পকেটস্থ করতে দেখেছ কি?’ দিগন্তবাবুর কৌতূহল তখন চরমে।‘না তেমনভাবে আমরা লক্ষ্য করিনি। তবে অন্যরা যেখানে নাক সিঁটকে দূরে গিয়ে পুলিশ আসার অপেক্ষা করছিলেন, নিশীথবাবু কিন্তু ওই গোবিন্দবাবুর দেহের পাশেই ঘুরঘুর করছিলেন অনেকক্ষণ ধরে।’‘হুঁ, যেটা আন্দাজ করেছিলাম।’ দিগন্তবাবু টেবিলের উপর রাখা ফাইলটা খুলে নিজের ক্যালেন্ডারটা দেখে নিলেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা তোমাদের গ্রামে আমাকে একবার নিয়ে যাবে?’‘আপনি যাবেন স্যার?’‘হ্যাঁ তোমাদের ওই ভচচায বাড়ির ছেলের কেসটা একটু দেখতে হচ্ছে ভাই।’‘তা চলুন না আমাদের বাড়ি, কোনও অসুবিধা হবে না। কাল শুক্রবার, কাল বিকেলে তো বাড়ি যাবই।’‘না না কাল নয়, আজই। বিকেলের ট্রেনেই চলো বেরিয়ে পড়ি। এক কাজ করো, তুমি হস্টেলে গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। আমি ততক্ষণ প্রিন্সিপালকে বলে ছুটিটা নিয়ে আসি।’এবার আমার একটু আমোদ লাগল, বললাম, ‘এইভাবে একজন ছাত্রকে কলেজ কামাই করতে উৎসাহ দিচ্ছেন স্যার?’‘সবে সেশন শুরু হয়েছে। একদিনের ক্লাসনোট তুমি অন্যদের কাছেও পেয়ে যাবে। কিন্তু একটা দিন পেরিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যাবেনা। বিশেষ করে যখন একজনের জেলে থাকা না থাকার প্রশ্ন চলে আসছে, যে করেই হোক সত্যিটা জানতেই হবে। যদি আমার কাছে এই ঘটনাটা এসে না পৌঁছাত তাহলে অবশ্য কোন ব্যাপার ছিলনা। কিন্তু যখন একবার আমার হাতে ভগবান কেসটা তুলে দিয়েছেন কিছু একটা তো করেই ছাড়ব।’এমন যেচে ছাত্রের পড়া কামাই করিয়ে তারই বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার দাবী করা শিক্ষক এই প্রথমবার দেখলাম। দেখা তো দূরের কথা এমন ঘটনা আদৌ ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণাই ছিলনা।এ তো গেল কথার কথা। আসল কথা হল আমার ক্লাস নোট নেওয়া বা ক্লাস করার ব্যাপারে কোনও আগ্রহই ছিলনা। নেহাৎ বলতে হয় তাই...দূর্গাপুর থেকে ট্রেনে বর্ধমান এবং সেখান থেকে বাসে মনোহরপুর পৌঁছলাম। সন্ধ্যা সাতটা। বাস থেকে নেমেই বুঝলাম আগের সপ্তাহে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক খুনগুলো নিয়ে এলাকা বেশ অশান্ত। জায়গায় জায়গায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সাদা পোষাকের পুলিশদেরও চেনা যাচ্ছে মুখচোখ দেখে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই তুলে নিয়ে যাবে একেবারে হাজতে। পরিস্থিতি তেমন খারাপ বুঝলে গুলিও চলতে পারে যখন তখন।ধীরে ধীরে এই জায়গাগুলোয় রিক্সা উঠে যাচ্ছে। দুএকটা দেখা গেলেও আগের সেই প্রাচুর্য আর নেই। সেই জায়গা দখল করেছে ই-রিক্সা বা যাকে বাংলায় আমরা টোটোগাড়ি বলি। তাতে করেই বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলাম।আজ বাড়িতে কেউ নেই। সবাই গেছে এক আত্মীয়ের বিয়েতে। ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলাম, নাহলে স্যার আসার আগেই কথাটা তুলতাম। পাশের বাড়ি থেকে চাবি নিয়ে দরজাটা খুললাম। বাইরে মাইকে ঘোষণা করছে, আগামীকাল সন্ধ্যায় শ্রদ্ধেয় কবি ও লেখক নিশীথবাবুর স্মরণে এক কবি সম্মেলণের আয়োজন করা হয়েছে।ক্লাবঘরটায় আড্ডা জমেছে দেখলাম। একটু বাইরে পায়চারী করে নিয়ে বাড়ি এসে খিচুড়ি আর ডিমভাজা রেঁধে নিলাম। এ এমনই এক অমৃত যার কাছে স্বর্গসুখ তুচ্ছ। দুজনে খেয়ে উঠতে নটা বেজে গেল। রাস্তার ক্লান্তিতে ঘুমটাও এল খুব তাড়াতাড়িই।.........................................................................................সকালে ঘুমটা ভাঙল ফোনের শব্দে। বিয়েবাড়ি থেকে আমাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। আমার একেবারেই যে ইচ্ছা নেই তা নয়। কিন্তু এই অবস্থায় স্যারকে ফেলে যাই কেমন করে। তাই ঘটনাটা বেমালুম চেপে গেলাম। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি স্যার একটা সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন।‘কি ভাবছেন স্যার?’ বলেই মনে হল যেন আমি একটা গভীর ভাবনার বিঘ্ন ঘটালাম।‘আরে কিছু না, কখন উঠলে?’ হাসিমুখে স্যার বললেন। এই হাসিমুখটা যেন ক্লাসের সেই ক্লাস টিচার দিগন্তবাবুর গম্ভীর বদনটার থেকে অনেকটাই আলাদা।‘এইমাত্র, ডাকতে পারতেন। বাড়িতে কেউ নেই, জানি আপনার অসুবিধা হচ্ছে, একটু মানিয়ে নেবেন প্লিজ। জানেনই তো হস্টেলে থাকি, সামাজিকতা থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছি।’‘আরে এসব নিয়ে নো টেনশন। আমিও তো বছর পাঁচেক আগে হস্টেলেই থাকতাম না কি! কোনও অসুবিধা হবেনা।’ বলেই চট করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন দিগন্তবাবু, ‘যাবে নাকি জায়গাটায় একবার?’উৎসাহ আমারও ছিল, যদিও ব্যাপারটা আতঙ্কের। রাজী হয়েই গেলাম। মাঠ দেখতে যাচ্ছি এমন হাবভাব নিয়ে রওনা দিলাম দুজনে। খেলার মাঠটা থেকে অনতিদূরেই আমাদের বিঘা পাঁচেক জমি। সেখানটা একবার ঘুরে এসেই খেলার মাঠে যাব ঠিক করলাম।‘শোনা যায় আমার প্রপিতামহ এই জায়গাগুলো কিনেছিলেন খুব অল্প দামে। চাষাবাদের পক্ষে বেশ উঁচু আর রুক্ষ, পাহাড়ের মত ছিল এখানটা তখন। কিন্তু একটা গোপন অভিসন্ধি ছিল তাঁর। সেটা হল গুপ্তধন। তিনি বেশ আশাবাদী ছিলেন এই জায়গাটাতেই লুকিয়ে রাখা আছে চৌধুরী পরিবারের গুপ্ত ধনসম্ভার।’ আমি বেশ ঐতিহাসিক ভঙ্গীমায় বললাম।‘তারপর কিছু বেরিয়েছিল?’‘হ্যাঁ শয়ে শয়ে সাপ। আর পাহাড় কেটে যে মাটি পাওয়া গেল তা দিয়ে একটা সাময়িক ইঁটের কারখানা করা হল। সেটাও বেশিদিন টিকলনা। অবশেষে এই জায়গাটায় চাষবাস করাই ঠিক হল। তারপর এখানে ফলল স্বর্ণালী শস্য। এটাই তো গুপ্তধন, বলুন।’‘তা যা বলেছ। এবার চলো ওদিকটায় যাওয়া যাক।’ উনি পা বাড়ালেন। আমিও পিছু নিলাম।কার্তিকের সকাল। শ্রাবণীর দুপাশে রাশি রাশি কাশের বুকে ঝরে যাওয়ার ব্যাথা। ধানের জমিগুলোতে একটু একটু করে স্বর্ণালী আভা লাগতে শুরু করেছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় মনে পরিয়ে দিচ্ছে সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের দিনগুলো। এই হাওয়ায় একটা আতঙ্কের পরশ বয়ে যেত শিরদাঁড়া বেয়ে, খালি মনে হত কিছুই তো পড়া হয়নি। স্যারকে এপার থেকেই সবকিছু দেখালাম পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সহ। আসলে ওপারে যাওয়ার মত সাহস তখনও করে উঠতে পারিনি।কবি সম্মেলনে যাওয়ার জন্য বিকেল থেকেই আগ্রহ বাড়ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই আরম্ভ হয়ে যাবে সেই অনুষ্ঠান। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের থেকেও বেশী আকর্ষণীয় নতুন নতুন কবিদের কবিতাপাঠ। তাড়াতাড়ি পৌঁছে সামনের দিকে চট পাতলাম। শহরের মানুষ উনি, হয়ত একটু অসুবিধা হবে, তাও মানিয়ে নিতে হবে আর কি। এই সভাতেই প্রথমবার নিশীথবাবুর কবিতা শুনলাম। আসলে উনি তো লিটল ম্যাগাজিনে লিখতেন, সেগুলো কিনে পড়ার খুব একটা সুযোগ হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় কবির কবিতা পাঠের সময় গ্রামের প্রবীণ গোছের মানুষ শ্যামচরণবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও কিছু বলতে চাই ওনার সম্পর্কে। একেতো তিনি লুঙ্গি পরে এসেছেন, তার উপর খালি গা। তাই ওনাকে উঠতে দেওয়া হলনা।যাইহোক, অনুষ্ঠানের বেশিরভাগটা জুড়েই তাঁর স্মৃতিচারণ আর কবিতাপাঠ। তাঁর কবিতার ছত্রে-ছত্রে ফুটে ওঠে গ্রামের প্রতি প্রেম, নিবিড় টানের কথা। সবার শেষে তাঁরই ছেলে পা করলেন তাঁর লেখা একটা কবিতা যার লাইনগুলো বেশ মন টানল। কয়েকটা লাইন যেমন,পা ধুয়ে নিই প্রবাহমানা জলে,ছলাৎ ঢেউ উথলে উঠে বলেঃশুনবি নাকি আমার কথা চুপে?কেমনে বাঁচি ইতিহাসের স্তুপে?এই রকমের আরও কতকগুলি কথা যা সহজ সরল, কিন্তু মন কেড়ে নেয়।ফেরার সময় দিগন্তবাবু বললেন, ‘চলো, একবার থানাটা ঘুরে আসি।’‘এখন, মানে এই রাত্রে?’ আমি অবাক হলাম।‘হ্যাঁ, সাইকেল দুটো বের করো।’এই দুদিনে স্যারের উপর বেশ খানিকটা ভরসা জন্মেছে। মনে হচ্ছে এই ঘটনার কিছু কিনারা করতে উনিই পারবেন। অতএব বিনা বাক্যব্যয়ে সাইকেলে রওনা হলাম থানার উদ্দেশ্যে। থানার যত কাছে এগিয়ে আসি, বুক ঢিপঢিপ ভাবটা ততই যেন বাড়তে থাকে। মনে হয় একদিন এই ভূতের খপ্পরে নাহলে পুলিশের খপ্পরে ঠিকই আমি মারা পরব।‘কি দরকার?’ বাইরের চেয়ারে বসে থাকা খাঁকি পোষাকের ভদ্রলোক বললেন।‘একটু বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।’ স্যারের উত্তর।ভদ্রলোক শাণিত দৃষ্টিতে একটু মেপে নিয়ে বললেন, ‘অ্যাপয়নমেন্ট নিয়েছেন?’‘সেটা কিভাবে নিতে হয়? ভিতরে গিয়ে?’ স্যারের এই প্রশ্নে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললাম, ‘বলুন ওই শ্রাবণীর পারের কেসটা নিয়ে কিছু বলতে চায়, একজন প্রত্যক্ষদর্শী এসেছেন।’এরপরে আর কেইবা আপত্তি করে! তবুও রাগত স্বরে ভদ্রলোক বললেন, ‘ফোনে কথা বলে আসতে হয় আগে থেকে। দাঁড়ান এখানে, জিজ্ঞেস করে আসছি।’ভদ্রলোক ফিরে এলে জানা গেল বড়বাবু ডেকেছেন।‘আসুন, বলে ফেলুন কি চাই? আপনি নিশীথবাবুর মার্ডারটা সামনে থেকে দেখেছেন?’ বড়বাবু সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন দিগন্তবাবুকে।‘আমি। নিশীথবাবুর নয়, দুবছর আগের গোবিন্দবাবুর সময়ে আমরাই দেহটা প্রথম দেখেছিলাম স্যার। তারপরই তো বিনু... মানে ওই ছোট্ট ছেলেটার ওইরকম...’ আমি তোতলাতে থাকি।‘এই গল্প আমার অনেকবার শোনা, নতুন কিছু থাকলে বলো।’ বড়বাবুর কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি।এবার হাল ধরলেন দিগন্তবাবু, ‘আসলে আমরা এই মৃত্যুটার প্যাটার্ন সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি। যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি এই তদন্তে খানিকটা সাহায্য করতে পারি।’‘পুলিশ নিজের মত করে তদন্ত করছে, তুমি আবার নতুন কি করবে?’‘দেখুন স্যার ভুল বুঝবেন না, তবে আমি হলফ করে বলতে পারি ওই তন্ময় ভচচায নির্দোষ। শুধুমাত্র কিছু তথ্য জানার অপেক্ষা। আমি কলেজে পড়াই, এই দেখুন আমার কার্ড। কথা দিচ্ছি কোনওরকম অসুবিধার সৃষ্টি করবনা আপনাদের। শুধুমাত্র একটা সাহায্য চাই আপনার কাছে।’‘বলে ফেলুন, আমি তো দানছত্র খুলেই বসে আছি।’ বিরক্তি হতাশা সবকিছু মিলেমিশে একাকার বড়বাবুর গলায়।‘মৃত নিশীথবাবুর কাছ থেকে সন্দেহজনক কিছু কি পাওয়া গিয়েছিল? জাস্ট এমনি জিজ্ঞাসা আর কি।’‘কিসব হিজিবিজি কাটা ভাঁজ করা কাগজ। দেখে তো মনে হয় বেশ পুরনো দিনের একটা চিঠি, বাংলা হরফে লেখা। কিন্তু এরকমের লেখা এতবছরের চাকরিজীবনে কখনও দেখিনি। মানেও বোঝা যায়না। ভদ্রলোক হয় পাগল ছিলেন নাহয় গোপনে ডাকাতদলে ভিড়েছিলেন, বুঝলেন?’ বলতে বলতে ফাইল থেকে একজোড়া কাগজ বের করে দেখালেন।প্রথম কাগজটাতে একটু চোখ বোলালাম, একটা চিঠি বলেই মনে হল। শুরুটা অনেকটা এরকম,“য়উ ঐমঐড় চএড়এজএড়কঔ চড়এদএনমএ,............................................................ইত্যাদি”বাপরে, এমন দাঁতভাঙা বাংলায় কোনওকালে মানুষ কথা বলত নাকি, মনে মনে ভাবলাম। তবুও হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। এখানে বোধগম্য কিছুই নেই, এই ভেবে পরের পাতায় গেলাম। পরের পাতার একদম শেষে খুব ছোট্ট হরফে একটা ছড়া, ছড়া না বলে ধাঁধাঁ বলাই ভাল, কারণ শেষের লাইনে তার উল্লেখ আছে।‘শ্রাবণীর বাঁকে বাঁকে বর্ণ পরিচয়চন্দ্রকে গ্রহ করে পঞ্চাশে তাই রয়।বলবৎ বল ছেড়ে বাদ দিয়ে দেবেতাহলেই এ ধাঁধার মানে খুজে পাবে।।’অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়ে কাগজদুটোর জেরক্স নিয়ে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। অবশ্য আমাদের পরিচয় এবং ছবি সবকিছুই থানায় রেখে তবেই আমাদের ছাড়া হল।দিগন্তবাবু কাগজদুটো পেয়ে অব্দি ওদিকেই আটকে রইলেন। রাত বারোটা নাগাদ রান্না শেষ হল। ভাত, ডালসিদ্ধ, আলুসিদ্ধ, আর ডিম ভাজা। সঙ্গে বাড়ির ঘি। খেতে খেতে ওনার প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, শ্রাবণী নদীটার কোনও ম্যাপ আছে তোমাদের বাড়িতে?’‘তা হয়ত দলিলের বাক্সে থাকবে, কিন্তু সে দিয়ে কি হবে?’‘এই দেখেছিস, এখানে বলেছে, শ্রাবণীর বাঁকে বাঁকে... তারমানে নিশ্চয়ই... থাক, কাল সকালেই দেখব।’ এই বলে লম্বমান হলেন তিনি।হঠাৎ স্যারের মুখে ‘তুই’ ডাকটা কেমন যেন ভালো লাগতে শুরু করল, মনে হল উনি তো আমাকে ‘তুই’ বলতেই পারেন। ‘তুমি’ ডাকটা কেমন যেন কৃত্রিম।পরদিন সেকথা বেমালুম ভুলে গেলাম ওনার একের পর এক দাবীতে। চা খেতে খেতে প্রথম প্রশ্নই হল, ‘মনে আছে, সেদিন যে লোকটাকে স্টেজে উঠতে দেওয়া হলনা? ওনার কাছে একবার যেতে হবে।’‘হঠাৎ? ওখানে কিন্তু স্যার কিছুই জানা যাবেনা।’‘কেন?’‘উনি বড় ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু ছেলে আর বৌয়ের অত্যাচারে, এখন কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে তেড়ে আসেন। কিছুটা বিকারগ্রস্তও বলা যেতে পারে।’স্যারের চাপে রাজী হতেই হল। এদিকে বিয়েবাড়িতে ফোন করে জানলাম, ওদের জোড়াজুড়িতে মা-বাবা আরও একদিন থেকে যেতে রাজী হয়েছেন, অর্থাৎ রবিবারে ফিরবেন। আমাদের হাতে স্বাধীন আরও একটা দিন পাওয়া গেল।হাজির হলাম সেই বৃদ্ধ অর্থাৎ শ্যামচরণ চক্রবর্তীর বাড়ি। খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট ঘর, ছোট্ট বারান্দায় মশারি টাঙানো। ভদ্রলোক সম্ভবত বেরিয়েছেন কোথাও।পাশেই দোতলা দালান ঘর। তাঁর ছেলের। সকালের মিষ্টি হাওয়া আর নরম আলোয় পুকুর পারের বাড়িটাকে সবে ভালো লাগতে শুরু করেছে এমন সময়ে শ্যামবাবু নিমের দাঁতন করতে করতে ফিরলেন।‘নমস্কার। আমরা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।’‘আপনারা? পুলিশের লোক তো নন মনে হচ্ছে।’ তারপর একটু অন্যমনস্ক হয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। দুটো চাটাই হাতে বেরিয়ে এলেন। আমাদের বসতে নিয়ে মশারিটা গোছাতে গোছাতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘আমি জানতাম একদিন কেউ না কেউ আসবে, আসবেই। আমাকে কেউ পাত্তা দেয়না জানেন। দিলে আমি কিছুটা উপকারে লাগলেও লাগতে পারতাম। কিন্তু...’‘আমরা পুলিশের লোক নই। শুধু জানতে এসেছি আপনি ওই মৃত্যুগুলোর ব্যাপারে যদি কিছু জানেন আর কি। বুঝতেই তো পারছেন, ভচচায বাড়ির ছেলে, তন্ময়, বিনা অপরাধে জেল খাটছে।’‘বিনা অপরাধে। হ্যাঁ সেই বটে। ওরা সবাই পূর্বপুরুষদের কর্মফল ভোগ করছে। তোমরা কিন্তু সাবধান। ওই লোভের ফাঁদে কখনও পা দেবে না।’‘কিসের লোভ?’ আমি প্রশ্ন করলাম।‘তোমরা এটার জন্যই এসেছ তো?’ শ্যামবাবুর চোখে শাণিত চাহনি, হাতে একটা পুরনো দিনের জরাজীর্ণ ম্যাপ। নিচে লেখা শ্রাবণী-লিপি। ‘নিশীথবাবুও এসেছিলেন। কিচ্ছু উদ্ধার করে উঠতে পারেননি। শুধুমুধু প্রেতের হাতে প্রাণটা খোয়ালেন।’‘আপনি নিশ্চিত, এটা প্রেতেরই কাজ? মানুষের নয়?’‘হ্যাঁ, আর এও জানি একমাত্র আমিই পারব কিছু একটা সমাধান বের করতে।’‘তাহলে করছেন না কেন?’ সন্দেহের স্পষ্ট ছাপ দিগন্তবাবুর কণ্ঠে।‘সেদিন স্টেজে আমাকে উঠতেই দেওয়া হলনা। এরকমই আরও কত কি হয় আমার উপর, তোমরা তার কোনও খবর রাখো? বরং এবার এসো তোমরা, নিজেরা যদি কিছুটা এগোতে পারো, তাহলে আবার এসো।’‘কিছু যদি মনে না করেন, এর একটা ছবি তুলতে পারি?’‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ মোবাইলটা বের করে ছবি তুললেন উনি।তারপর সেই ছবির বেশ কয়েকটা প্রিন্ট করানো হল। দিগন্তবাবু এক-একটা প্রিন্ট নেন আর বিভিন্ন রকম আঁক কাটেন। স্কেল দিয়ে নানান মাপ করেন আবার রেখে দেন। এভাবেই দুপুরটা কেটে গেল। বিকেলের দিকে বললেন, এই দেখো বুঝতে পারছ কিছু?’কাগজটা হাতে নিলাম। বললাম, ‘কিছুটা। তার মানে এই হল আমাদের শ্রাবণী লিপি, তাইতো?’ জিজ্ঞেস করলাম।‘হ্যাঁ এই দিয়েই উন্মোচিত হবে যত রহস্য। কই সেই চিঠিটা দাও দেখি।’তাক থেকে চিঠিটা আনলাম।প্রথম লাইনটা এরকম,“য়উ ঐমঐড় চএড়এজএড়কঔ চড়এদএনমএ,”‘য়’ অর্থাৎ ৪৭ নম্বর, ওটার জায়গায় হবে ৪৪ নম্বর অর্থাৎ ‘হ’। তারপর কি আছে? ‘উ’ মানে হল গিয়ে ৫, তার জায়গায় হবে ৯ অর্থাৎ ‘এ’। এইভাবেই প্রথম লাইনটার মানে দাঁড়ালঃ‘হএ আমআর পঅরঅবঅরতঈ পরঅজঅনমঅ’অর্থাৎ‘হে আমার পরবর্তী প্রজন্ম’।‘ধুর এইভাবে কার্ভ দেখে দেখে হচ্ছেনা। একটা ছক করো দেখি যাতে সহজেই জিনিসটা ডিকোড করা যায়।’ স্যার বললেন।অতএব আমি পয়েন্টগুলো থেকে ছক বানাতে শুরু করলাম। ছকটা মোটামুটি এরকম দাঁড়ালঃ১ অ → ৯ এ২ আ → ১০ ঐ৩ ই → ১১ ও৪ ঈ → ১২ ঔ৫ উ → ১ অ৬ ঊ → ২ আ৭ ঋ → ৩ ই৮ ঌ → ৮ ঌ৯ এ → ৫ উ১০ ঐ → ৬ ঊ১১ ও → ৭ ঋ১২ ঔ → ৪ ঈ১৩ ক → ২৩ ট১৪ খ → ২৪ ঠ১৫ গ → ২৫ ড১৬ ঘ → ২৬ ঢ১৭ ঙ → ১৭ ঙ১৮ চ → ২৮ ত১৯ ছ → ২৯ থ২০ জ → ৩০ দ২১ ঝ → ৩১ ধ২২ ঞ → ২২ ঞ২৩ ট → ৩৩ প২৪ ঠ → ৩৪ ফ২৫ ড → ৩৫ ব২৬ ঢ → ৩৬ ভ২৭ ণ → ২৭ ণ২৮ ত → ১৩ ক২৯ থ → ১৪ খ৩০ দ → ১৫ গ৩১ ধ → ১৬ ঘ৩২ ন → ৩২ ন৩৩ প → ১৮ চ৩৪ ফ → ১৯ ছ৩৫ ব → ২০ জ৩৬ ভ → ২১ ঝ৩৭ ম → ৩৭ ম৩৮ য → ৪৪ হ৩৯ র → ৪৫ ড়৪০ ল → ৪৬ ঢ়৪১ শ → ৩৮ য৪২ ষ → ৩৯ র৪৩ স → ৪০ ল৪৪ হ → ৪৭ য়৪৫ ড় → ৪১ শ৪৬ ঢ় → ৪২ ষ৪৭ য় → ৪৩ স৪৮ ং → ৪৮ ং৪৯ ঃ → ৪৯ ঃ৫০ ঁ → ৫০ ঁএবার বেশ সহজ হয়ে গেল চিঠিটা পড়া। চিঠিতে পেলাম,“হে আমার পরবর্তী প্রজন্ম, ১৩ই মে, ১৯৩৩আমি অনন্তনারায়ণ চৌধুরী, পিতা ঁবসন্তনারায়ণ চৌধুরী, নিবাস মনোহরা, জমিদারবাটি। যে বিশেষ কারণে এই পত্রের অবতারণা তাহা হইল, আমাদের বংশ আজ অতি সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়া যাইতেছে। দেশের যে ভয়াবহ অবস্থা তাহাতে যেকোন মুহূর্তে আমাদের নিকট হইতে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইতে পারে, এই আশঙ্কা করিয়া পিতা যক্ষ কর্তৃক সম্পত্তি আগলাইবার ব্যবস্থা করিয়া যান। কুলপুরোহিত চক্রবর্তী মহাশয় তখন কোন এক অজ্ঞাত কারণে শহরে গিয়াছিলেন। অতএব ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আসিয়া সেই আয়োজন সম্পন্ন করেন। কথিত আছে, গরীবের সন্তানকে যক্ষ বানাইলে তাহার মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে, অথচ সেই যক্ষ সম্মান প্রদানের পূর্বেই বাগদী বালকটি প্রস্থান করিল সেই স্থান হইতে। সেই ক্ষণে আর একটি বালককে নদীতীরে দেখা যায় এবং তাহাকেই ভুলাইয়া নিবেদন করা হয় যক্ষ হিসেবে। উহাকে ভূতলে বন্দি করিবার পর দুই দিনকাল অতিবাহিত হয়। চক্রবর্তী মহাশয় আপন কার্য সমাধা করিয়া জানিতে পারেন উহার পুত্র নিখোঁজ। খোঁজ করিতে উনি জমিদার গৃহে আসিয়া উপস্থিত হন। তাঁহার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী সেই বালকটিই ছিল চক্রবর্তী মহাশয়ের সন্তান, যাহাকে যক্ষপুরীতে রাখিয়া আসা হইয়াছে। তাহাকে না বলা হইলেও কোনও এক তান্ত্রিক মারফৎ তিনি এই সংবাদ পান, এবং সন্তানের উদ্ধারে সেই স্থানে পৌঁছান। পিতার এক বাক্য, একবার যাহাকে যক্ষপুরীতে পাঠানো হইয়াছে, মৃত হউক বা জীবিত, উহাকে বাহিরে আনা যাইবেনা। বেগতিক দেখিয়া এবং ইংরাজ পুলিশদের নিকট খবর পৌঁছাইলে কি হইবে তাহা চিন্তা করিয়া লাঠিয়াল কর্তৃক চক্রবর্তী মহাশয়কেও হত্যা করিয়া যক্ষপুরী নিকটস্থ ভূমিতে প্রোথিত করা হয়। মৃত্যুপূর্বে উনি অভিসম্পাত করেন যে, এই বংশের শেষ রক্তবিন্দু দেখিয়া তবেই তিনি মুক্তি লইবেন। যদি আমাদের বংশের কেহ ওই ভূমির কাছাকাছি পৌঁছান তাহা হইলেই তাহার মৃত্যু হইবে।এক চতুর প্রেতবিশারদের শরণাপন্ন হইয়া পিতৃদেব উহার আত্মাকে স্মরণ করেন এবং ব্যক্ত করেন যে, সেক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীকে অর্থ প্রদান না করিয়া ওনার সন্তানের মুক্তি হইবে কিভাবে? অনেক অনুনয়ের ফলস্বরূপ ব্রাহ্মণ মহাশয়ের প্রেত নিয়ম কিছুটা শিথিল করেন। বলেন, যদি কেহ ঐ অর্থ ভোগের আশা না করিয়া, কোন জনকল্যানে ব্যয় করিবেন স্থির করেন তাহাকেই ঐ অর্থের উত্তরাধিকারী বলিয়া স্থির করা হইবে এবং তাহার উপর কোন অপঘাত ঘটিবে না।সুতরাং যেই আমার এই পত্রখানি পাইয়া থাকো, ভোগ সংবরণ করিয়া শুদ্ধচিত্তে ওই অর্থ লহিয়া জনকল্যানে ব্যয় করিবে এবং বংশকে অভিশাপমুক্ত করিবে, ইহাই আমার অভিপ্রায়। শ্রাবণীর উপরিস্থিত ত্রিভূজভূমি স-হ-ড় তে উহার সন্ধান পাওয়া যাইবে।”চিঠি শেষ করে আমার মনে হল শ্যামচরণবাবুর বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার। স্যারকে সে কথা বলতে দেখলাম উনি এককথায় রাজী। হয়ত উনিওএকই কথা
ভাবছিলেন।সন্ধ্যেবেলা। রাস্তায় যেতে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই ছড়াটার মানে কিভাবে বের করলেন একটু বলবেন। বেশ কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি, কিন্তু পুরোটা নয়।’স্যারের হালকা হাসির আভাস তাঁর কথাতেই পাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, ‘চিঠিটার তারিখ হয়ত খেয়াল করেছ। সাল ১৯৩৩। তারই আগের বছর অর্থাৎ ১৯৩২-এ বর্ণপরিচয়ের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সেখানে ছিল ১২ টি স্বরবর্ণ এবং ৪০ টি ব্যঞ্জন বর্ণ। তার মধ্যে দুটিকে বাদ দিতে হল, ‘ব’ আর ‘ৎ’, ‘বলবৎ’ এর ‘বল’ রেখে দিতে বলা হয়েছে নিশ্চয়ই দেখেছ। তার মানে একটা ‘ব’ থাকল আর একটা গেল বাদ। এবার আসি গ্রাফটার কথায়। এক-এ চন্দ্র, আবার এক-এ আসে প্রথম বর্ণ ‘অ’, নয়-এ নবগ্রহ আবার সেইসঙ্গে নয়-এ হয় নবম বর্ণ ‘এ’। অর্থাৎ শুরুর বিন্দুটি হল (১,৯)। শেষের বিন্দুটি ‘পঞ্চাশে তাই রয়’ অর্থাৎ (৫০,৫০)। এবার এক থেকে শুরু আর পঞ্চাশে শেষ হলে সমান ঊনপঞ্চাশ ভাগে ভাগ করতে হয় শ্রাবণীর গতিপথকে। সেটাই করলাম, আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তাই মিলে গেল উত্তর।’শ্য্যামবাবুর বাড়িতে কোনও দরজা নেই। দেখতে পেলাম একটা হ্যারিকেনের আলো-কে কমিয়ে রাখা হয়েছে, তার সামনে চোখ বুঝে বসে কি যেন সুর করে গাইছেন। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম। শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। চোখ খুলেই বলে উঠলেন, ‘চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।’এমন আকস্মিক দাবিদাওয়ার জন্য আমরা তৈরী ছিলাম না। তবুও বৃদ্ধের পথ ধরলাম। পথ ধীরে ধীরে পৌঁছচ্ছে শ্রাবণীর তীরে। নিশির টানে যেন আমরা এগিয়ে চলেছি রাত্রির বুক চিরে, আলপথ বেয়ে। ছোট্ট শিশু বিনুর সাথে যেমনটি হয়েছিল, ওর দেহে প্রবেশ করে কোন এক প্রেত সিদ্ধ করতে চেয়েছিল তার অভিপ্রায়, তেমনটি আমাদের সাথেও ঘটবে না তো। ওইরকম শিশু ছিটকে ফেলে দিয়েছিল দশজন তাগরা জোয়ানকে। তাও আবার যেমন তেমন ধাক্কা নয়, কারও হাতে যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল, কারও পায়ে, কেউ আবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল শ্রাবণীর জলে।কি মনে হতে নিজের হাতে প্রচণ্ড জোরে চিমটি কেটে নিজেই ‘আআআ’ করে উঠি। মানে এখনও সজ্ঞানেই আছি। আর এক সপ্তাহ পর কালীপূজো। আজ রাত্রের পর আর কোনও কালীপূজো আসবে কিনা সেই নিয়েই এখন দেখা দিয়েছে সংশয়। অমাবস্যা আসতে কয়েকদিন বাকী, তাই চাঁদের আলো এখনও পুরোটা নিভে যায়নি। দূরে অনবরত হুক্কাহুয়া স্বরে ডেকে চলেছে শিয়ালের দল। ঝিঁঝিরা গেয়েই চলেছে, এক সুরে। আর কি এক আদিম মোহে আমরা এগিয়ে চলেছি যক্ষপুরীর দিকে।ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। আমরা সেতু ধরেই নদী পেরোলাম। রাত্রে অন্ততঃ নদী সাঁতরাতে হলনা। একটা ফাঁড়া থেকে তো রেহাই পেলাম। তারপরই সাঁই করে পিছন দিকে কে যেন চলে গেল মনে হতেই চমকে উঠলাম। স্যার বললেন, ‘কুকুর টুকুর হবে বোধহয়।’আমরা পৌছে গেছি সেই জায়গায়, যেখানে বহু বছর ধরে বন্দি আছে এক ছোট্ট শিশুর আত্মা, অন্ধকারের গহবরে। এবার ঘটল আর এক ঘটনা, কাপড়ে জড়ানো একটা শাবল বের করে ফেললেন শ্যামবাবু। সেটা আমাকে দিয়ে একটা গাছের নিচে খুঁড়তে বললেন তিনি।‘তার মানে আপনি সবটা...’‘হ্যাঁ, আমি সবটাই জানতাম। বাবাকে খুন করে যখন পুঁতে ফেলে, আমি তখন মায়ের পেটে। মা লুকিয়ে গিয়ে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তারপর দীর্ঘ বারো বছরের সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর আমরা আবার গ্রামে ফিরে আসি অবশ্য। তখন জমিদারদের ক্ষমতাও অনেকখানি কমে গেছে। আর পূর্বপুরুষদের কুকীর্তির খবর ওরা নিজেরাই বুঝতে পারেনি হয়ত। নাহলে সেদিন গোবিন্দবাবু যখন ওই লেখাটা নিয়ে আমার কাছে এল, আমি কি আর অভিশাপের কথাটা বেমালুম চেপে গিয়ে ওকে এখানে পাঠাতে পারতাম? চৌধুরী বংশের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমার বাবার মুক্তি দেখে যেতে পারতাম?’‘আর নিশীথবাবুর ব্যাপারটা? তাকেও কি আপনিই...’‘নিশীথবাবুও আমার কাছে এসেছিলেন এই একই প্রশ্ন নিয়ে। আমি ওকে পুরো ঘটনাটা বলি এবং অনুরোধ করি যাতে উনি না আসেন এখানে। নিজের জেদ আর লোভের কাছে পুরোপুরি হেরে গিয়েছিলেন অত ভালো মানুষটা। হয়ত ওনার দুর্বল হৃদয় বাবার আত্মাকে দেখে ফেলেছিল, আর ওনার লোভকে দেখে ফেলেছিলেন আমার বাবার আত্মা। অতএব...’বুক ঢিপঢিপ করছে, ইতিমধ্যে হাঁটুসমান খোঁড়া হয়ে গেছে। এরপর মাটিতে শাবলের আঘাত পরতেই ধাতব ঝঙ্কার শোনা গেল। সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন শোনা গেল এক শিশুর গগনবিদারী অট্টহাসি। স্যারের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। ওনারও যে হাত কাঁপছে বোঝা গেল। দুজনেই তাকালাম শ্যামচরণ বাবুর দিকে। ওনার মুখে প্রসন্ন হাসি, ‘ও কিছু নয়। অনেকদিন পর মুক্তির আশায় শিশুমনে খুশীর জোয়ার এসেছে। হাত চালাও তাড়াতাড়ি।’একে তো ঘামে ভিজে গেছে সারা গা ভয়ে আর ক্লান্তিতে, তার উপর বৃদ্ধের এরকম আচরণ। আর হাত চালাতে পারলাম না। দেখলাম এইবার স্যার শাবলটা নিয়ে খুঁড়তে শুরু করলেন। একটু পরেই পাওয়া গেল লোহার একটা ঢাকনা। প্রচণ্ড শক্তিতে দুজনে মিলে খুলে ফেললাম সেটা। টর্চ লাইট জ্বেলে দেখা গেল ভিতরে একটা সিড়ি। হ্যাঁ, চলো নামা যাক। সামনে শ্যামবাবু, তারপর আমি আর সবশেষে দিগন্তবাবু, এইভাবে নামতে শুরু করলাম। হাসির শব্দটা থেমেছে। অনেক মাকড়সার ঝুল, বাদুড়ের আক্রমণ পেরিয়ে নিচে পৌঁছে যা দেখলাম তা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। ছোট্ট একটা শিশু, অনেকদিনের না আঁচড়ানো জটবাঁধা চুল, দীর্ঘদিনের না খেতে পাওয়া হাড়সর্বস্ব শরীর, একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। চোখের পাতা পড়ছেনা একটুও, শুধু অবাক চাহনি তার দুচোখে।‘দাদা... আমার দাদাটাকে ওরা এভাবে চাপা দিয়ে মারলে... না জানি কতদিন খেতে পায়নি, অন্ধকারে খিদের জ্বালায় ছটফট করেছে।’ কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধের গলা ধরে এল।শিশুটির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সেই গোপন কুঠুরীতেই আমাদের ঈশারা করে নিয়ে চলল কোন অজানার উদ্দেশ্যে। আমরাও সম্মোহিতের মত চললাম তার পিছু পিছু। একটু এগিয়ে গিয়ে উইয়ের ঢিবির মত জায়গায় পৌঁছে সেখানে উঠে গিয়ে শিশু অদৃশ্য হল। আন্দাজ যদি খুব একটা ভুল না হয়, হয়ত শিশুটির ইহজগতের কাজের এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু কপাল তো আর সবসময় আন্দাজমত চলে না। এদিকে লক্ষ্য করে দেখলাম শ্যামবাবু আমাদের সঙ্গে আসেননি। সিড়িতেই বসে আছেন হয়ত। আবার শাবলের কাজ শুরু হল। দুর্বল ঢিবি গুঁড়িয়ে ঝরে ঝরে পড়ল। এবং বেরিয়ে এল একটা পিতলের বাক্স। তালা ছিল না, তাই সহজেই খোলা গেল। ভিতরে যা দেখলাম... এত সোনা জীবনে কখনো দেখিনি। কিন্তু না। এ আমার নয়, এ আমাদের। গ্রামের স্বার্থে খরচ করতে পারলে তবেই এতগুলো মানুষের আত্মবলি সার্থক হবে। হঠাৎ সিড়ির দিক থেকে শব্দ এলো, ‘ইউ আর আণ্ডার আরেস্ট মিস্টার চক্রবর্তী। আজ তোমার সব গল্প আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছি। এবার মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অপরাধে বুড়ো বয়সে যে তোমায় জেলের ঘানি টানতে হবে বাছা।’ এরকম একজন বয়স্ক মানুষকে বাছা বলার প্রতিবাদ করতে যাব ততক্ষণে ওনার ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে ফেলেছেন বড়বাবু। কিন্তু ঘুরে তাকানোর বদলে বন্দুকের সামান্য স্পর্শেই শ্যামবাবুর নিথর দেহটা উপুড় হয়ে সিড়ি থেকে পড়ে গেল। এবার বন্দুকের নল ঘুরল আমাদের দিকে। শ্যামচরণ ভট্টাচার্যকে খুন করে গুপ্তধন হাতানোর অপরাধে তোমাদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি... বলতে বলতেই চোখ পাকিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন বড়বাবু।‘ইনিও কি তাহলে টপকে গেলেন নাকি?’ বললাম আমি।‘পুলিশের হার্ট এত দুর্বল নয়। এত সহজে টপকাবে না। বাইরে নিয়ে গিয়ে জলের ঝাপটা দাও ঠিক হয়ে যাবে।’ শ্যামবাবুর গলা শুনে দুজনেই চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। শুধু একরাশ আদিম গন্ধ নাকের উপর আক্রমণ হানিয়ে জানিয়ে যায় তার অব্যক্ত যন্ত্রণা।জ্ঞান ফেরার পর বড়বাবু নিজের উদ্যোগে গ্রামের উন্নতিকল্পে কিভাবে সেই গুপ্তধন ব্যয় করা যায় তার উপদেশ দিতে শুরু করলেন। আমরাও ওনার এহেন পরিবর্তনে হতবাক। শুধু শ্যামবাবুকে আর বাঁচানো গেল না। প্রতিশোধের আগুনে আর দাদার মুক্তির আশায় তিনি আশিটা বছর কাটিয়ে দিলেন। একেই বোধহয় বলে ভ্রার্তৃপ্রেম। হয়ত তাঁর পুত্র-পুত্রবধু এখন গভীর ঘুমে মগ্ন, জানতেও পারলনা বাবার এইভাবে মৃত্যুর কথা। কিন্তু পুলিশ আছে যখন, নিশ্চয়ই জানাবে। হাজার-হোক, রক্তের টান তো ওনাদের সাথেই। আমরা তো ওনার কাছে দুদিনের সহচর মাত্র।‘আচ্ছা সবই তো হল, আরও একটা খটকা...’ আমি বললাম।‘আবার!’ দিগন্তবাবু হাসতে হাসতে বললেন।‘হ্যাঁ, বলছিলাম ম্যাপে যে দেখাচ্ছে উল্লিখিত স্থানটি অর্থাৎ স-হ-ড় ত্রিভূজটি আমাদের গ্রামে অবস্থিত। এদিকে আমরা গুপ্তধন পেলাম স্বর্ণগ্রামে। ব্যাপারটা যদি একটু খোলসা করেন...’‘ভূগোলে নিশ্চয়ই পড়েছ যে নদীর এই ধরণের অতিরিক্ত বাঁক ধীরে ধীরে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে পরিণত হয়, আর নদী ধীরে ধীরে ঘুরপথ ছেড়ে সোজাপথে প্রবাহিত হতে শুরু করে। জঙ্গলের ওই পাশে জলাশয়টা খেয়াল করেছ?আচ্ছা এবার তোমাকে একটা টেকনিক্যাল প্রশ্ন করি।”‘নিশ্চয়ই’, আমি বললাম।‘আগের দিন ফ্লুইডের ক্লাসে লাগ্রেঞ্জিয়ান অ্যাপ্রোচ আর অয়লারিয়ান অ্যাপ্রোচ পড়িয়েছিলাম। বর্তমান ঘটনাটাকে তুমি এই দুটোর মধ্যে কোন শ্রেণীতে ফেলবে?’এই চ্যাপ্টারের প্রথমে থাকা এই দুটো জিনিসই মাত্র আমি পড়েছিলাম। তাই উত্তর দিতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলনা।‘নিঃসন্দেহে অয়লারিয়ান ভূত এগুলো। লাগ্রেঞ্জিয়ান হলে তো দেশে দেশে ঘুরে লোক মেরে বেড়াত।’‘একদম, প্রাক্টিক্যালে তোমার জন্য দশ নম্বর এক্সট্রা রইল।’আনন্দে মনে মনে নেচেনিলাম
খানিকটা।..........................................................................................রবিবার সকাল। বাড়ির সবাই আজ দুপুরে ফিরবে। আমরাও এসপ্তাহের ছুটি শেষ করে ফিরে যাব কলেজ জীবনে। তার আগে একবার খেলার মাঠটা দেখতে এলাম। শ্রাবণীর ধারে বসে দিগন্তবাবু গুনগুন করে কি যেন বলছেন। ভালো করে কান পেতে শুনলাম, এ যে নিশীথবাবুর সেই কবিতাঃ‘পা ধুয়ে নিই প্রবাহমানা জলে,ছলাৎ ঢেউ উথলে উঠে বলেঃশুনবি নাকি আমার কথা চুপে?কেমনে বাঁচি ইতিহাসের স্তুপে?’আমিও গলা মেলালাম তাঁর সাথে,‘কতটা পথ পেরিয়ে এসেছো তুমি,আরও কতক পেরিয়ে যাওয়া বাকী;আমার ঘড়ি তোমার জলস্রোত,ইতিহাসের পরোয়া করে নাকি!’ হপ্তা দুইয়ের গদ্য দেশের ডায়েরি- ৪আমাদের ছোটবেলায় কল্যাণী একটি প্রায়-গ্রামদেশ ছিল । আম, জাম, তেঁতুল, নিমের বৃক্ষ ছিল অগুনতি। দিগন্ত বিস্তৃত (তখন সেইরকমই লাগত) মাঠ আর নানাপ্রকারের সবুজের হাল্কা ঘন শেডের ফাঁকে ফোকরে কোলকাতা শহর থেকে দুদিনের জন্য হাঁপ ছাড়তে আসা শৌখিন মানুষদের বাড়ি ছিল গোনাগুনতি। সুন্দর সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। কোনো বাড়ির ভিত কাটা হলেই কেমন করে যেন আমরা খবর পেয়ে যেতাম। যতক্ষণ না ইঁট, বালি, সুরকি, সিমেন্ট পড়ছে, ততক্ষণ সেই কাটা ভিতে, মাথা সমান মাটির গভীরে ঢুকে আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলতো সারা বিকেল। মাঝে মাঝে বাড়ির মালিকেরা কলকাতা থেকে এসে গাছের তলায় মাদুর পেতে বসে স্বপ্ন বিধুর চোখে, তদগত চিত্তে সেই খালি জমির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কখনো পুরোনো বাসিন্দাদের সাথে বাড়ি সংক্রান্ত আলাপ আলোচনায় মেতে উঠতেন। আমরা ছোট ছিলাম কিন্তু তবুও বুঝতে অসুবিধে হতনা যে বাড়ি ঘিরে তাঁদের কত শত স্বপ্ন! সামনে কেয়ারি করা এক চিলতে ফুলের বাগান হবে। পাঁচিলের পাশ ঘেঁষে সারি সারি দেবদারু গাছ বিকেলের রোদ মেখে লেকের থেকে আসা মিষ্টি হাওয়ায় পাতা নাড়বে মুহুর্মুহু। একদিকে শক্ত পোক্ত কোনো গাছের ডাল বেয়ে দোলনা ঝুলবে। বাড়ির গেট খুললেই লালচে সুরকি বেছানো পথের পাশে সম্ভ্রম জাগানো তুলসী মঞ্চ থাকবে। আর তাতে একটি বাচ্চা তুলসীগাছের ছোট্ট শীর্ষ দীপ্ত ভঙ্গিতে আকাশ ছুঁতে চাইবে। পেছনে কেয়ারটেকারের ঘরের ছাদের অ্যাসবেসটারের চাল বেয়ে লাউ, কুমড়োর লকলকে লতা লতিয়ে উঠবে একদিন। আর আজকের মধ্যবয়সের দ্বার ছুঁয়ে থাকা থাকা যুবক, কালকে প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে পৌঁছে, ধুলো ধোঁয়ার শহরের পাট চুকিয়ে সবুজের সমারোহে, সতেজ আবহাওয়ায় অবসরপ্রাপ্ত অলস জীবন কাটাবার স্বপ্ন সাকার করতে এসে পৌঁছবে এই ঠিকানায়। যদিও তাঁদের স্বপ্নালু চোখ বিরক্তিকর কুঁচকে উঠতো যখন তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যত স্বপ্নপ্রতীম বাসস্থানে আমাদের হুটোপাটা করতে দেখতেন। তবুও সত্যিই বকাঝকা খাইনি বিশেষ। হয়ত ভবিষ্যত অতি বিচ্ছু প্রতিবেশীদের বিগড়ে রাখবেন না এই সংকল্পে মুখখানা পেঁচোপনা করে নিজেদের বিরক্তি-ক্রোধ কোনক্রমে গিলে নিতেন।সেই সব মায়াবী দিনগুলোতে তাদের আগমন ছিল নিয়মিত। কিন্তু কখনো তারা ঘরের চৌহদ্দির ভিতরে পা বাড়াত না। দূরে, বাগানে আচমকা ঘন সবুজ পাতার আড়ালে আবডালে তাদের পোড়া মুখ নজরে আসত। অনেক সময় কিছু দেখা না গেলেও যখন সজোরে আম-জামগাছের ডালগুলো আচমকা উত্তাল হয়ে উঠত, তখন বোঝা যেত যে তারা এসেছে। আজ সেইসব বৃক্ষের দল অন্তর্হিত। একসময় যে তেঁতুলগাছটির মস্ত গুঁড়ির আনাচে-কানাচে, মাটির ওপর তীব্রভাবে উঁচু হয়ে জেগে থাকা শিকড়ের গলি ঘুপচিতে আমাদের কাল্পনিক পাঠশালা ছিল, এখন সেখানে ঝাঁ চকচকে অ্যামাজনের অফিস। কালবৈশাখীর তুমুল ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে দৌড়ে সবার আগে পৌঁছনোর তীব্র উল্লাস মনে নিয়ে যে কাঁচামিঠে আম দিয়ে জামার কোঁচড় ভরাতাম, সেই আমগাছের জায়গা এখন নিয়ে নিয়েছে আধুনিক বিউটি পার্লার। পুজো পার্বনে একছুটে দুর্বা নিয়ে আসা ঘাস জমিতে শান বাঁধানো সিমেন্টের প্রলেপ। প্রতিবেশী দেশের বহু মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে, রাশি রাশি কাঁচা টাকা সহ এদেশে এসে কল্যাণীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিয়েছেন। অকাতরে গাছের পরে গাছ কেটে, বস্তা বস্তা সিমেন্ট ফেলে তাদের জন্য কংক্রিটের খুপরি তৈরী হচ্ছে। বিধান রায়ের সুপরিকল্পিত ছোট্ট শিল্পাঞ্চলটিতে এমস আসছে। শুনলাম এয়ারপোর্টও নাকি তৈরী হবে। প্রতিদিন জ্ঞাতে অজ্ঞাতে কত যে পাপকর্ম সাধিত হচ্ছে আমাদের দ্বারা! বাপ-ঠাকুর্দার বয়সী, মা-দিদিমার মত, যারা জন্ম থেকে শুধু দিয়েই এসেছে, উন্নয়নের লোভে তাদের ওপর কুঠারের আঘাত হানছি নির্মম হস্তে। বোবা, তাই তাদের বিলাপ আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছোয় না, আর আমরা এমন অন্ধ যে নিজেদের ভবিষ্যতও দেখতে চাইনা। নিজেরা খেয়ে পড়ে, ভালোভাবে শ্বাস নিয়ে এই জীবন হয়ত পার করে দেব। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম? সেই নিয়ে কথা বলতে একদিন দেখা করতে গেলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের সাথে। তাঁরাও যে ভাবছেন না তা নয়। এটা ওটা করছেন। তবে ভেবে আর আড্ডাপাতায় গদ্যরচনা করে তো কোনো লাভ নেই, কঠোর বাস্তবকে উপলব্ধি করে সুপরিকল্পিত কিছু ব্যবস্থাপনা চাই। এত বছরের পাপ ধুতে সামনের বহু বছরের একনিষ্ঠ কর্মযোগ চাই। দেখা যাক। যা বলছিলাম, এখনও হনুমানের দল মাঝে মাঝে আসে। আসলে আসে না, হানা দেয় বলাই সঙ্গত। পাঁচ সাতজনের মিলিত দল। মা হনুর কোঁখে সদ্যোজাত। চোখ ফোটা অবস্থা থেকেই তারা মায়ের বুকে লেগে থেকে থেকে দিব্যি চুরি- ছিনতাইয়ের থিওরিক্যাল অংশটি শেখে। উন্নয়নের জেরে তাদের খাদ্য সম্ভারে স্বাভাবিকভাবেই টান পড়েছে। তাই তারা এখন প্রচন্ড হিংস্র হয়ে উঠেছে। সোজাপথে খাবার না জুটলে, কেড়ে কামড়ে খাবার সংগ্রহ করতে একটুও দ্বিধা দেখায়না। ওদের দলনেতা প্রথম সুযোগেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে আসে। অপেক্ষারত বাকি সদস্যরা তখন পাঁচিলে ওপর সার সার বসে কিচকিচে ভাষায়, মুখ ভেঙচে একে অপরের সাথে আলাপচারিতায় মত্ত থাকে। আপনি হয়ত বারান্দায় বসে একমনে সকালের খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে গরমাগরম চায়ে গলা ভেজাচ্ছেন। হঠাৎ দেখতে পারেন, হনুনেতা খোলা সদর দরজা দিয়ে গটগট করে আপনার পাশ কাটিয়ে আপনারই ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল! আর খানিক পরে হতভম্ব আপনার দিকে দৃকপাতও না করে, ডাইনিংয়ের টেবিলের ওপরে রাখা ফল পাকুড় ছেড়ে ফ্রিজের ওপরে রাখা চকোলেটবা বিস্কুট নিয়ে ধীরে সুস্থে বেরিয়ে গেল। পছন্দের জিনিস তুলে ঘর থেকে বেরোবার পথে যদি আপনার প্রতিবাদের সম্মুখীন হয় তবে কি হতে পারে তার চাক্ষুষ প্রমাণও পেলাম।সত্যি মিথ্যা জানিনা, বাজারে দূর থেকে এক ভদ্রলোককে দেখানো হল। স্কার্ফ দিয়ে মাথা, মুখ পেঁচিয়ে ঢাকা। শুনলাম এক হনু তাঁর বাড়ির খাদ্যদ্রব্য ছিনতাই করে পালাবার পথে ভদ্রলোক তার সাথে সম্মুখ রণে অবতীর্ণ হন। ফল স্বরূপ হনুমানটি তাঁর ডানগালে এক মোক্ষম চাপাটি কষিয়ে এমন আঁচড় দিয়েছে যে তাঁর ডানগালে এখন নেই ভূমির মানচিত্র জ্বলজ্বল করছে। একটু পরে মাছ কিনতে গিয়ে তাঁর সাথে পাশাপাশি দেখা! ওজনে ঠকাচ্ছে সন্দেহে বয়স্ক মাছওয়ালাকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তুমুল বকাবকি করছেন। বুঝলাম, হনু শুধু গালে দাগ রেখে যায়নি, স্বভাবেও ছাপ ফেলে গেছে! বাইশ বেলা কোথা যে উধাও হলোপরস্বপর শ্রাবণ বায়োস্কোপঅপেক্ষায় আদুল গায় রাত কাটলোপথেসারা জনম বাইশ বেলাও মোর দরদিয়া .... https://www.youtube.com/watch?v=2TfkSI2WAqs&fbclid=IwAR3Oyr_B-EweQJA7uD26bRNnkFv_-i4sNb4yyIBiK5jkAGS1T5EpBuWlqYc ধারাবাহিক আড্ডাঘরের পুরনো ও নতুন ধারাবাহিক রচনাগুলো পড়ুন এখানে | লিখতে পারেন নিজেও| অচলায়তনের দেয়ালের ফোকর ও ভালবাসা ১২) নতুন নিয়ম হয়েছে। আমাদের হেডমাস্টার মশায় নিজের ছোটছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দোতলার দুটো ঘরে থাকবেন। ইউ -শেপের দোতলায় প্রায় পনেরটা ঘর। ওনার জন্যে ঘর ছেড়ে দেওয়া হল প্রথম সমকোণের ওপর ঘরটায়। আরে, ওর পাশ দিয়েই তো আমাদের ছোট ছাদে যাওয়ার জায়গা। তারমানে? --মানে খুব স্পষ্ট ; কোন শালা নতুন মহারাজদের কাছে গিয়ে দালালি করেছে যে ক্লাস টেনের ছেলেগুলো ওই ছোটছাদটিতে সিগ্রেট খাওয়া আর আড্ডা মারার ঠেক বানিয়েছে। আর গরমের দিনে ওরা খোলা ছাদে বিছানা করে ঘুমোয়! -- বেশ করি ঘুমোই, কার বাবার কি! একটা ঘরেও পাখার বন্দোবস্ত নেই, তো? গরমে সেদ্ধ হব? তারচেয়ে খোলা হাওয়ায় ছাদে শুলে কার কি ক্ষেতি? বরং ভোরের দিকে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে। --- বুঝলি না! এসব ওই ক্লাস এইটের বাঁদরগুলোর কাজ। ওরা সেবারের ঘটনার জন্যে আমাদের উপর খার পুষে রেখেছে। গুরু মুখ খোলে। -- ওদের পরে দেখে নেব। কিন্তু সবসময় নেগেটিভ ভাবিস কেন? খালি চুগলি আর ষড়যন্ত্রের ভূত! কারও আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। আসলে হেডস্যারের অসুখ সেরে গেছে, তাই। বিপ্লব আমাদের মত লোয়ার ক্লাসে হোস্টেলে আসেনি। ও জানে না। তাই বলে দিই। -- স্যারের হয়েছিল হাইড্রোসিল। অমন দোর্দন্ডপ্রতাপ লোক। শুধু ছাত্ররা নয়, কিছু স্যারও ভয় পেতেন। উনি কখনও হাসতেন না। 'বেরিয়ে যা শুয়ার'--ছিল ওনার বাঁধা বুলি। একবার ভুল করে একজন নতুন স্যারকে বলে ফেলেছিলেন, তিনি পরের দিন রিজাইন করেন। --উঃ প্রেসি কর। উনি দোতলায় কেন? -- আরে বলতে তো দে! তা অমন রাগী লোক হাইড্রোসিলে কাবু হলেন। সেইজন্যে ওঁকে একতলায় বাথরুমের পাশে একটি ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। তখন পায়খানায় জলের কল ছিল না। বাইরের চৌবাচ্চার থেকে ছোট একটা বালতি করে জল নিয়ে ঢুকতে হত। কিন্তু ওই ফোলা ধুতি নিয়ে পা ফাঁক করে হাঁটতে গিয়ে জল তোলা আর হয়ে উঠত না। তখন যে কোন বাচ্চাকে দেখলেই বলতেন --বৎস, আমায় এক বালতি জল এনে দাও তো! --- তোরা দিয়েছিস? '--সবাই । যে যখন সামনে পড়েছে আর কি। --তুই? -- একবার। ওই সামনে পড়ে গেছ্লাম। কিন্তু সেদিন ওই রাগী ভদ্রলোক অনুনয়ের গলায় বলেছিলেন--বাবা, একটু জল দিয়ে যাবে বাবা? বড় কষ্ট পাচ্ছি গো! সেই হেডস্যার এখন দোতলায় মানে উনি সেরে গেছেন। আর কাউকে জল টেনে দিতে হবে না। হঠাৎ গুরু চমকে ওঠে। --অ্যাই পোদো! শীগগির যা! নীচের বারান্দায় দেয়ালের গায়ে যে ম্যাগাজিনটা ঝুলছে ওটা নামিয়ে নিয়ে আয়। --কেন গুরু? --কেন কী রে ভোঁদাই? ওতে হেডস্যার নাম দিয়ে একটা কবিতা আছে না? স্যার দেখলে--! -- আরে গুরু! ভাল মনে করিয়েছ, ওটা পোদোর জিদেই ছাপা হয়েছিল। ওই খুলে আনুক। ছাপার কথাটা বাড়াবাড়ি। আসলে গত কয়েকমাস ধরে আমরা একটা হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করেছি--- নবীনসাথী। আমি সম্পাদক, কিন্তু তিনজনের কমিটি আছে। একেকবার একেক রঙের আর্ট পেপারে ক্লাস নাইনের সুব্রতর সুন্দর হাতের লেখায় ভরে দেওয়া হয়। এবারে ক্লাস ফোরে একটি বাচ্ছা ফ্রি-তে ভর্তি হয়েছে। ওর মা এই পাড়ায় কাজের মাসি। বাবা নেই। চকচকে চোখের বাচ্চাটা এবার ম্যাগাজিনের জন্যে একটা ছড়া লিখে জমা দিয়েছে। কবিতাটি পড়ে কমিটি খুব হাসল, কিন্তু ছাপতে চাইল না। আমি তখন সম্পাদকের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করে ছাপালাম। তর্ক দিয়েছিলাম-- ছন্দ ও অন্ত্যমিল নিখুঁত, সেন্স অফ হিউমার আর ছোট্ট বাচ্চাকে উৎসাহ দেওয়া। তাই বড় বড় অক্ষরে বেরোল এবং ছেলেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলঃ হেডশ্বর ========= আমাদের ইস্কুল দুই তিন তলা, টিফিনেতে খেতে দেয় পাউঁরুটি কলা। আমাদের হেডশ্বর এমে বিয়ে পাস, পড়া না পারলে মারে ঠাস ঠাস।। না, ওই দেয়ালপত্রিকা ঠিক সময়েই নামিয়ে আনা হয়েছিল। তারপর এক জরুরী মিটিং এ সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে সম্পাদকের পদ থেকে নামিয়ে শুধু কমিটি মেম্বার করে দেওয়া হল। নতুন সম্পাদক হবে প্রশান্ত। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা গেল। রাত্তিরে ওঁর ঘর ডিঙিয়ে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। সিগ্রেট খাওয়া তো দূর অস্ত্। উনি বর্ধমানের লোক। প্রতি শনিবার বা অন্ততঃ একবার বাদ দিয়ে পরের বার ট্রেন ধরে বাড়ি যান। সোমবারে দুপুরে ফিরে আসেন। ফলে আমাদের সেই দুদিন ১৫ ই আগস্ট আর ২৬ শে জানুয়ারী। ঘটা করেই পালন করা হয়। কিন্তু একদিন খবর ভুল ছিল। উনি বর্ধমান যান নি। শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় ঘরে শুয়ে ছিলেন। শুধু ওঁর ছেলে গেছল। সন্ধ্যের মুখে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার জুড়লেন। -- ও মহারাজ ! মহারাজ! ও সুনীল মহারাজ, এদিকে আসুন। সুনীলদা অবাক। ব্যস্তসমস্ত হয়ে একতলার থেকে দোতলায় এলেন। --কী হয়েছে মাস্টারমশাই? --আর বলবেন না। ক্লাস টেনের রমেনকে দেখি এমনি এমনি করে টেবিল বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছে-- আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে, আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে! এই বয়সেই যদি ওদের যৌবনজ্বালা জুড়িয়ে থাকে তা'লে পরে কী হবে গো! সেদিন আমরা ১৫ই আগস্টের বদলে ১৪ই আগস্ট দেখলাম। কিন্তু হেডস্যারের সঙ্গে ১৫ই অগাস্ট জুড়ে গেছে যে! কোথায়? আমার স্মৃতিতে। আমি তখনো প্রদ্যুম্ন থেকে পোদো হই নি। কচুরিপানায় ঢাকা পুকুরের ঘাটলায় শামুকপচা জলে থালাবাটি ধোয়া, কাপড় কাচা, আর স্নান করে করে হাত- পা খোস-পাঁচড়ায় ভরে যায় নি। ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া রোগা প্যাংলা ভীতু ছেলেটি তখনও মোটা ভাতের সঙ্গে আধসেদ্ধ ছরছরে ডাল, কারি পাউডারের ঝোল আর জলখাবারে ডালডা-চিনি-মুড়ি খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এমন সময় ঘনঘোর বর্ষার মধ্যে এসে গেল স্বাধীনতা দিবস। আশ্রমের আবহাওয়া বদলে গেল। চারদিকে সাজো সাজো রব। ১৪ অগাস্টের রাত্তির থেকে সবাইকে নিজেদের বিল্ডিং ছেড়ে ক্যাম্পে থাকতে হবে। সবাই নিজে নিজের বিছানা , দুদিনের মত জামাকাপড়, ডায়েরি, পেন সাবান, ব্রাশ ইতাদি নিয়ে চলে যাবে। ১৫ তারিখ ক্যাম্প ফায়ারের পর প্রাইজ দেওয়া হলে সবাই সে'রাত্তির ক্যাম্পে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে আবার পুরনো জীবনে ফিরে আসবে। প্রদ্যুম্ন দেখল এলাহি ব্যাপার। সমস্ত ছেলেগুলোকে আটটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ১৩ অগাস্ট ডাইনিং হলে তাদের নাম ও গ্রুপ ক্যাপ্টেনের নাম ঘোষণা করা হল। জানা গেল যে হাইস্কুল বিল্ডিং খালি করে ধুয়ে মুছে সেটাকে দু'দিনের জন্যে ক্যাম্প ঘোষণা করা হয়েছে। সামনের আঙিনা ঘিরে গেছে অস্থায়ী পোল ও তারের বেড়ায়। একটা গেট। সেই গেটে কাঠের রাইফেল নিয়ে পাহারা দেবে একজোড়া সেন্ট্রি। দু-দুঘন্টা মার্চ করে করে, বাই টার্ন, সব গ্রুপ থেকে। আর কাউকে ক্যাম্পে ঢুকতে হলে গেটপাস দেখাতে হবে--সেগুলো ক্যাপ্টেনরা জারি করবেন। গেটপাস দেখাতে না পারলে সুনীল মহারাজ , হেডস্যার কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না। আগের বছর একটি গ্রুপের জোড়া সেন্ট্রি, ক্লাস এইটের দুই ছোকরা, সুনীল মহারাজকে আটকে দিয়েছিল। উনি রেগে গিয়ে বরেনদাকে কম্প্লেন করায় জবাব পেলেন-- ওরা ওদের ডিউটি ঠিকমত করেছে।আর সেই গ্রুপটা এই পয়েন্টে বেশি নম্বর পেল। নম্বর অনেক কিছুতে, সেন্ট্রি দেওয়া , ঘর পরিষ্কার, কীর্তালি(কোন ভাষা?) --মানে আশ্রমের মাঠঘাট, পুকুর, নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, মার্চপাস্ট, ডাইরি লেখা, স্বাধীনতা দিবসের উপর রচনা, কবিতা লেখা, পাঁচ মিনিট এলোকুশন (মানে কী?), সন্ধ্যেয় ক্যাম্প ফায়ারের গান, নাটক ও ইম্প্রোভাইজড কোন স্কিট, মিমিক্রি --সবেতেই। আর সকালে জলখাবারে মগে করে গরম চা দেওয়া হবে, আর্মি স্টাইলে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে প্রীতি-ফুটবল--স্টাফ ভার্সাস স্টুডেন্ট্স। সন্ধ্যেয় অমূল্যদার ম্যাজিক লন্ঠন, অথবা কথা বলা পুতুলের কেরদানি! তারপর আমাদের ক্যাম্প ফায়ার। তাতে আবৃত্তি, মিমিক্রি, গান ও অভিনয়--সুকুমার রায় বা রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক/ব্যঙ্গকৌতুক থেকে--কী নেই? তা সেই আমার জীবনের প্রথম ক্যাম্পে হেডস্যার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মর্ম বোঝাতে গিয়ে বললেন-- মনে রেখ, আজ থেকে মাত্র ১৪ বছর আগে এই শহরে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। তোমাদের মধ্যে যাদের বয়েস ১৪ বছরের কম তারা নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও; পরাধীনতার অপমান তোমাদের ভুগতে হয় নি। এগার বছরের প্রদ্যুম্ন্ব ভাবল -- ইস্, মাত্তর ১৪ বছর আগে এখানে বৃটিশরা ছিল? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত? কী অন্যায় ! কী অন্যায়! ভগবানের একচোখোমি! ওকে যদি ভগবান আরও দুই দশক আগে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিত তো ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলত। সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ না হোক অন্ততঃ ১৪ বছরের ক্ষুদিরাম। কিন্তু কোথাও একটা হিসেবে ভুল হচ্ছে না? পাটিগণিতে কাঁচা শ্রীমান প্রদ্যুম্ন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারল না। ১৩) সম্পাদক পদ হইতে শ্রীমান প্রদ্যুম্নের অপসারণের পিছনে একটি গল্প আছে। এই গল্পের উৎস ওই শিশুসুলভ কবিতাটি, পোদোর সম্পাদকসুলভ আভিজাত্যবোধ ও ক্ষমতার অহংকার । এটাই কমিটির মিটিংয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। না, একটু ভুল হল। এব্যাপারে কমিটির সমর্থন ও সহানুভূতি আমার সঙ্গেই ছিল। আসল অভিযোগ হল আমি উপরোক্ত কারণের বশে , বিশেষতঃ ক্রোধ ও মাৎসর্য্য রিপুর দাস হইয়া ক্লাস এইটের বর্বর গুন্ডাপ্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে ,মারপিটে জড়াইয়া পড়িয়া উত্তমমধ্যম প্রাপ্ত হইয়া ক্লাস টেনের প্যাট্রিশিয়ানদের প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ঢালিয়া দিই। ফলে ক্লাস টেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিনিয়র ক্লাসের সমান রক্ষার্থে হা-রে -রে রবে ক্লাস এইটের সঙ্গে ক্লাস-ওয়ারে জড়াইয়া পড়ে। অগত্যা ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে সিজ-ফায়ার ঘোষণা হয়, কিন্তু ক্লাস এইট ও সেভেন আমাদের দেওয়াল পত্রিকায় কোন লেখা দিবে না ঘোষণা করায় সিনিয়রদের কূটনৈতিক ও রণনীতিগত লোকসান হয়। শেষে আমাকে না জানাইয়া গুরু ও তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ক্লাস এইটের নেতাদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালায়। উহারা সমস্ত ঘটনা ভুলিয়া শেক হ্যান্ড করিতে রাজি হয় ও ম্যাগাজিন বয়কটের সিদ্ধান্ত বাতিল করে-- কিন্তু শর্ত রাখে যে নষ্টের গোড়া শ্রীমান পোদোকে পত্রপাঠ সম্পাদকের পদ হইতে নামাইতে হইবে। ব্যাপারটা এই রকম। ক্লাস এইটের কতগুলো বখা ছেলের গ্রুপ ধীরে ধীরে আমাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠছিল। নাইনের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছিল, কয়েকজন ব্যক্তিগত বন্ধু হল। পড়াশুনো, লাইব্রেরির বই পড়া , নাটক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। ওরাও আমাদের মতই প্রথম ও ফিফথ পিরিয়ডে ব্যাক বেঞ্চে বসে ঘুমোত। স্যারেদের ও ডে-স্কলার ছেলেদের হাসির ও বিদ্রূপের খোরাক হত । আবার অ্যানুয়াল পরীক্ষায় মেরিট লিস্টে উপরের দিকে থাকত। কিন্তু ক্লাস এইটের ব্যাচটা একটা ব্যাচ বটে! এদের মধ্যে বেশ কজন আমাদের ও নাইনের ব্যাচের থেকে ফেল করে ভিড় জমিয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল, য্খন তখন কড়কড়ে নোট বের করে। এও সহ্য হচ্ছিল। জানা গেল এদের পালের গোদা দুজনের হরমোন অত্যধিক ক্ষরণের কারণে প্রায়ই বেশ কিছু বাচ্চা এদের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে এরা বেশ গর্বিত। এমনকি লুকোনোর চেষ্টাও করে না। আমদের পাঁচজনের টিম এদের ব্যুহ ভেদ করতে ব্যর্থ হল। যে তিনজন মুখ খুলতে রাজি হল তারা স্বামীজির সামনে গিয়ে বেঁকে বসল। মারের ভয়! পরে সেই মাফিয়ারাই ওই বাচ্চাদের নিয়ে মেজমহারাজের কাছে (প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ) নালিশ করাল যে ক্লাস টেনের আমরা ক'জন নাকি ওদের ভয় দেখিয়ে মিথ্যে অভিযোগ করাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বোধহয় আমাদের অন্য কোন ব্যক্তিগত ইস্যু আছে। মেজ মহারাজ চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজিতে আমাদের যা বললেন তা দুটো লাইনে বলা যায়ঃ ডক্টর, কিওর দাইসেল্প্ফ! অয়েল ইন ইয়োর ওন মেশিন! ওই ঘটনার পর থেকে ‘ওরা –আমরা’ সৃষ্টি হল; আমরা একে অপরের ক্লাস-এনিমি হয়ে গেলাম। এই অবস্থায় একদিন ওদের ক্লাসের দুজন বাচ্চামত ছেলে হাতে করে দুটো কবিতা নিয়ে আমাদের ঘরে এল। দেয়াল পত্রিকায় ছাপতে হবে। ওদের দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সেই দুটো বাচ্চা! যারা বয়ান বদলে আমাদের মুর্গী করেছিল! তবু বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে বসলে জাজমেন্ট দেওয়ার আগে পূর্বাগ্রহ মুক্ত থাকাই আদর্শ আচরণ বিধি। আমি ও বিপ্লব লেখাগুলো পড়তে লাগলাম। তারপর গম্ভীর মুখে বললাম-- এটা কী লিখেছ? --কবিতা। --কোথায় কবিতা? ও অবাক হয়ে মিনমিন করে বলল--কেন, পোদোদা? আপনার হাতেই তো ধরা রয়েছে। দেখুন না--বর্ষাকাল। পোদোদা! হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। গম্ভীর মুখে বললাম, - হুঁ, বর্ষাকালই বটে! বর্ষা আসিল, ডাকিয়া উঠিল আকাশের যত মেঘ? এটা কবিতা হয় নি, শুধু অন্ত্যমিল মিলিয়ে একটা গোদা বাহ্যিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটা ছাপা যাবে না। পরেরবার চেষ্টা কর। অন্য বাচ্চাটা করুণ মুকেহ বিপ্লবকে বলল --আমারটা তো ঠিক আছে? বিপ্লব খেঁকিয়ে উঠল। -- এটা? এটা তো ডাহা চুরি! গতবারের স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন থেকে টুকলি! বাচ্চাটার চোখে হতাশা ও আতংক। --না, টুকলি নয়। বিপ্লব উঠে গিয়ে ওর তাক হাতড়ে একটা বিস্কিট রঙের ম্যাগাজিন বের করে এনে দ্রুত হাতে পাতা ওল্টাতে লাগল। --পেয়েছি; এই যে! শোন্। " ৩২ নম্বর বাসের তলায় ব্যাঙ রাজার মৃত্যু" ---------------------------------------------- হৈ চৈ পড়ে গেছে সারা বরানগরে, ব্যাঙেদের মহারাজা মারা গেছে আহা রে! ------ । একেবারে কমা-সেমিকোলন পর্য্যন্ত টোকা। না, না; এসব চালাকি চলবে না। -- বিপ্লবদা , একটু দেখুন। দুটো এক নয়। ওটা হল ৩২ নম্বর বাসের তলায়, আর আমি লিখেচি--৩৪ নম্বর বাসের তলায়। বিপ্লব খ্যা -খ্যা করে হাসতে লাগল। -- ওরে একটু চুপ কর। ৩২ নম্বরকে ৩৪ নম্বর করে দিলেই কবিতা আলাদা হয়ে গেল? -- দেখুন, দুটো বাসই তো এসপ্ল্যানেড থেকে বরানগর যায়, তবে? আমার আর সহ্য হল না। উঠে ঠেলতে ঠেলতে বাচ্চাদুটোকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। বললাম--কবিতা লেখা? কবি? খালি ২ কে ৪ করে লিখলি তো হয়ে গেল? ইয়ার্কিরও একটা সীমা আছে। তোদের গোটা ক্লাসটাই এইরকম গবেট নাকি? দুটো দিন কেটে গেল। বিকেলে ফুটবল পেটাতে না গিয়ে ম্যাগাজিনের লেখাগুলোর ফাইল খুলে বসেছিলাম, আমি আর বিপ্লব। নরেশ আর সুদীপ এল। ক্লাস এইটের সেই মাফিয়া টাইপের ছেলে গুলো। সুদীপের একটু রোমশ চেহারা। এই বয়সেই গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে। ওকে দেখা মাত্র আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। শুনেছিলাম নতুন ছেলেদের পেছনে লাগার সময় ওর দুটো চ্যালা অনিচ্ছুক বাচ্চাটার হাত ধরে রাখে। আর গত পূজোর সময় ওর বাড়ির লোক নিয়ে যেতে এসেছিল। ও নাকি তখন ঘরের মধ্যে একটি ছেলের সঙ্গে রাসলীলায় মত্ত ছিল। বন্ধ ঘরের মধ্য থেকে বাড়ির লোককে বলে -- একটু অপেক্ষা কর। প্যাকিং করছি, জামাকাপড় বদলাচ্ছি--সময় লাগবে। ওরা ঢুকল, একটু পেছনে আগের সেই বাচ্চা দুটো। -- এই যে, এডিটর! এদের কবিতাগুলো রিজেক্ট করলে কেন? -- একটা কবিতা হয় নি, অন্যটা টুকে লেখা--তাই। --কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, কে ঠিক করবে? তুমি? --আলবাৎ; এটাই আমার কাজ। আমাদের পত্রিকার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। ---- বেশ, কোনটা তোমার কাছে কবিতা? ওই ফালতু " টিফিনেতে খেতে দেয় পাঁউরুটি-কলা"? নরেশ দোহার দেয়,-- ওই কবিতাটার টাইটেল আবার "হেডশ্বর"! গুরুজনদের স্যারেদের নিয়ে ইয়ার্কি করলেও ম্যাগাজিনের স্ট্যান্ডার্ড থাকে, তাই না পোদো? বিপ্লব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে-- অ্যাই, নরেশ! মুখ সামলে। তোর দু'বছরের সিনিয়র, প্রদ্যুম্নদা বলবি। ওরা হেসে উঠল। তারপর বলল,-- দু'বছর আগে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম, তখন থেকেই ও আমাদের পোদো। কী রে , ঠিক বলেছি না? আমি কোন কথা বলি না। সুদীপ আবার বলে-- তাহলে আমাদের ক্লাসের দুটো কবিতা রিজেক্ট করছ? আমি ওদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাচ্চাদুটোকে দেখি--উকিল ধরে এনেছিস? লাভ হবে না। ঘরে ফিরে যা। ওরা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সুদীপদের বলি--শোন, ক্লাস -টাস নয়। একটু ভাল কবিতা নিয়ে এস, নিয়ে নেব। ওরা চোখে চোখে কথা বলে। তারপর সুদীপ বলে-- আধুনিক কবিতা চলবে? গদ্য কবিতা? --হ্যাঁ হ্যাঁ। নিয়ে এস। --অ্যাই নরেশ, তোর সেই আধুনিক কবিতাটা দেখা তো আমাদের সম্পাদককে, স্ট্যান্ডার্ডটা দেখে নিক। নরেশ ভালমানুষের মত মুখ করে একটা চোথা কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়। আমি ভাঁজ খুলে হতভম্ব , এটা কী? --কেন , আধুনিক কবিতা। আমার মুখের ভাব দেখে বিপ্লব কাগজটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে চোখ বোলায়, তারপর হা-হা করে হেসে ওঠে আমাকে ফেরৎ দেয়। কাগজটায় কয়েকটি রেলস্টেশনের নাম একটি বিশেষ অর্ডারে লেখা রয়েছে। " টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া--যাদবপুর। গড়িয়া-সোনারপুর, বজবজ-বজবজ।" আমি কিছু বলার আগে বিপ্লব হাসতে হাসতেই বলে-- সরি ! এইসব অশ্লীল লেখা ছাপতে পারব না। অশ্লীল লেখা! ওরা আকাশ থেকে পড়ে। -- ওতে কোন শব্দটা অশ্লীল? নাকি দু'ক্লাস উঁচুতে পড়েন বলে যা খুশি কমেন্ট করবেন? আমি রাগের চোটে কাগজটা নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়তে থাকি। ওরা হাঁ-হাঁ করে ওঠে। --এটা কী হল সম্পাদক মশাই? আপনার লেখা রিজেক্ট করার রাইট আছে; কিন্তু ছিঁড়ে ফেলা? --- পছন্দ না হয় ফেরৎ দিয়ে দে। ছিঁড়লি কী করে? --বেশ করব, এই সব অশ্লীল ইয়ার্কি আমার সঙ্গে নয়, অন্য কোথাও মারাবি! ওরা কাগজটা কেড়ে নেবার চেষ্টায় আমার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম চড় বোধহয় আমিই মেরেছিলাম। কিন্তু ওরা তৈরি হয়েই এসেছিল। আমি বা বিপ্লব কেউই মারামারিতে অভ্যস্ত নই, একটু লালুটাইপ। ফলে দুজনেই বেশ মার খেলাম। আমার বরাদ্দে একটু বেশি জুটল। তারপর ক্লাস-স্ট্রাগল, সিজফায়ার ইত্যাদি। ওরা চ্যালেঞ্জ করে মহারাজকে বলল-- আমি ব্যক্তিগত কারণে ওদের গ্রুপের কারও কবিতা ছাপতে চাই না। তাই ওদের একটি ভাল আধুনিক কবিতাও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। আমরা বললাল--যা তা অশ্লীল লেখা! --ওরা বলল বাজে কথা, পোদো কাগজটা দেখাক। কী করে দেখাব, ছিঁড়ে ফেলেছি যে! হেডস্যারকে দিয়ে তদন্ত করানো হল। উনি বললেন--প্রদ্যুম্ন, কাগজ নেই তো কি হয়েছে, তুমি মুখে বল বা লিখে দাও যে ওরা কী অশ্লীল শব্দ লিখেছে--মেনে নেব। ওরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আমার কাছ থেকে শুনে হেডস্যার সন্দিগ্ধ মুখে মাথা নাড়তে লাগলেন। এ তো ক'টা রেলস্টেশনের নাম-- অশ্লীল কোথায়? আমার মুখে বাক্যি নেই। আমার অভিযোগ খারিজ হয়ে গেল, বন্ধুরা বলল আমার বোকামি আর গোঁয়ার্তুমি আমাদের গোটা ব্যাচের হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিল। সেই থেকে আমরা ও ক্লাস এইটের ব্যাচ আশ্রমের বাকি জীবনে তীব্র জীবনমরণের শ্রেণীসংগ্রামে বৃত হইলাম। (চলবে) আশিয়ানা ঢুন্ডতা হ্যায়!! ১০ বিয়ের রাতে কত কি যে সব হল| কত নিয়ম-কানুন| কিছু নিজের চোখে দেখলাম আর কিছু দাদাদের কাছ থেকে জানলাম| আসলে কি করব! বিয়ে দেখতে বসলে খাওয়ার ওখানে কি চলছে সেটা দেখা হচ্ছে না আবার খাওয়ার ওখানে থাকলে বিয়ে দেখা হচ্ছে না| বিয়ে শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল| শেষ দিকটায় বড়রাই দিদি-জামাইবাবুর সাথে ছিল| আমরা ছোটরা শুতে চলে গেলাম| আর চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না‚ চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল| আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম| শুয়ে শুয়েই আমার জেঠুর আর বাবার সব কথা মনে পড়ে গেল| মা কি সত্যি সত্যি বাবার সাথে চলে যাবে? নাহ‚ মা আমাকে একলা ফেলে নিশ্চয় যাবে না‚ যেতেই পারে না| কিছু মাস পরেই তো ফাইনাল এক্সাম| মা ‚ না পড়ালে তো লাড্ডু পাব| এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি|এদিকে একটা ব্যাপার আমার একদম ভালো লাগছে না‚ শুনলাম দিদির নাম পালটে যাবে| দিদি যেমন এখন শ্রেয়শী সেন আছে বিয়ের পর দিদি শ্রেয়শী দাশগুপ্ত হয়ে যাবে| কেন হবে? নামটা পালটে গেলে কি আমার দিদি আর আমার দিদি থাকবে না আর? তা কি করে হয়? আমি বিয়ে করলে ‚ আমার বৌকে একদম নাম বদলাতে দেব না| যা নাম আগে ছিল‚ বিয়ের পর সেই নামই থাকবে| ভাবছি আগের থেকেই মা-বাবাকে বলে দেব| বিয়ে তো করতেই হবে‚ কত যে গিফট পাওয়া যায়‚ উফ একটা ঘর তো পুরো ভরে গেছে গিফটে| কোনটাই খোলা হয়নি‚ দিদি বলল‚ আবার যখন আসবে তখন আমার সাথে বসে এগুলো খুলবে| বেশ মজা হবে‚ আমরা প্যাকেট না খুলেই গেস করব প্যাকেটের মধ্যে কি আছে‚ যে জিতবে তার পয়েন্ট|সকাল থেকেই দিদি‚ জামাইবাবু আর জামাইবাবুর বাড়ির লোকেরা রেডি হয়ে গেছে বেরোবার জন্য| সবাই বলল‚ এখান থেকে বরযাত্রীরা বেলা এগারোটার মধ্যে বেড়িয়ে যাবে| ওঁনাদের গুরুজী বলেছেন‚ বেলা একটার মধ্যে বর-কনেকে বাড়িতে ঢুকে যেতে হবে| না হলে তারপর আর আর বাড়িতে ঢুকতে পারবে না| এই নিয়ে বাড়িতে সবাই আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করেছে‚ যাতে বরযাত্রীদের কেউ শুনতে না পায়| দিদির বিদাইয়ের সব নিয়ম-কানুন চলছে| আমরা বসে আছি দিদি কখন কাঁদা শুরু করবে বলে| বাবলুদা বলল‚ - দেখিস‚ ঠিক আর্শীবাদের সময় কাঁদবে|- মনে হয় না‚ খোকনদা বিঞ্জভাবে বলল|আমারও কেন জানি মনে হচ্ছিল‚ দিদি কাঁদবে না| আমি জানি তো দিদির কান্না শুরুর আগের লক্ষণগুলো| আগে পাঁচবার গুনে গুনে নাক টানবে| তারপর তিনবার আলতো করে হাঁচি| এগুলোর কোনটাই এখনো হয়নি‚ তার মানে চান্স নেই‚ পক্কা|- এই শ্রী একটু কাঁদ| লোকে কি বলবে? মনে হয় ছোটমা আস্তে করে দিদির কানে কানে বলল| আমি শুনতে পেলাম|- কেন কাঁদবো ? দিদি বেশ জোরেই বলে ফেলল|ছোটমা দিদির এই কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বড়মার পিছনে চলে এল|- আমি কাঁদব কেন? ও তো কাঁদছে না| বলে দিদি ইশারা করে জামাইবাবুকে দেখালো| সবাই দিদির কথায় হেসে উঠল| বড়মা অবশ্য অনেকক্ষণ থেকেই ফোঁপাচ্ছিল| কিন্তু দিদির বকা খেয়ে এখন চুপ করে গেছে| আস্তে করে বলল‚ কাঁদবে কেন? দজ্জাল মেয়ে কি আর সাধে বলি? দেখলাম জামাইবাবুও হেসে ফেলেছে বড়মার কথা শুনে |একটু পরে আশীর্বাদ সারা হলে দিদি শ্বশুরবাড়ি চলে গেল| বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগছে| বাইরে পার্কে গিয়ে দেখলাম পন্ডাল খোলা হচ্ছে| চারিদিকে কেমন যেন একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে| কিসের গন্ধ জানি না| বাসি ফুল‚ বাসি খাবার সব মিলিয়ে একটা গন্ধ মনে হল| তবে গন্ধটা যে মনখারাপ করে দেবার সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে| কথা না বলে কোথাও চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে| কিছুই ভালো লাগছে না| আজ অনেকেই চলে যাবে‚ শুধু পিসিরা থাকছে| আর বাকি কয়েকজন মানে‚ মামারা‚ দাদারা কাল বিকেলের গাড়িতেই কলকাতা চলে যাবে|বিকেল হতে হতে বাড়ি একদম খালি হয়ে গেল| বাড়ি খালি হতেই বোঝা গেল বাড়ির হালত একদম বিগড়ে গেছে| চারিদিক আগোছালো হয়ে আছে| বাবা‚ জেঠু‚ ছোটকা বসার ঘরে টেন্টওয়ালা আর কাদের কাদের যেন টাকা মেটাচ্ছে| সাথে সব কাজের লোককেই জাম-কাপড় দিচ্ছে| আমি জেঠুর পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরেই এইসব দেখছি| মাথাটা কিরকম খালি খালি লাগছে| এবার মনে পড়ল ‚ আরে মায়ের তো বাবার সাথে চলে যাবার কথা| মাকে নিয়ে বাবা চলে যাবে নাকি মা এখানেই থাকবে এসব নিয়ে আলোচনা করতেই তো বাবা জেঠুর সাথে মিনা অঙ্কলের বাড়ি গেছিল| কি হল? দৌড়ে ঘরে গিয়ে দেখি মা খাটের ওপর হাতের ওপর হাত রেখে চুপ করে বসে আছে| আমি যে ঘরে ঢুকলাম মা বুঝতেই পারল না|- মা কি করছ? বলে আমি মায়ের গা ঘেঁষে বসে পড়লাম|- হুম এতক্ষণে মায়ের কথা মনে পড়ল তাই না? মা আলতো করে পিঠে চাপড় মেরে বলল|- কি করব? কত কাজ ছিল না আমার! এখন তো চান্স পেলাম|- ওহহ‚ আমার বুড়ো ..- ছাড় না মা‚ আচ্ছা বলো না‚ তুমি কি সত্যি বাবার সাথে যাচ্ছো?- হ্যাঁ রে যাচ্ছিই তো| মিনা ভাইসাবও তাই বলেছেন| কি যে হবে জানি না| তোমার বাবা কি ফ্রি হয়েছে নিচে? একটু ডেকে নিয়ে এসো তো| তারপর তোমাকে বলছি সব|আমি দৌড়ে নিচে গেলাম| ওখানে তখন সব কাজ হয়ে গিয়েছে| বাড়ির বাকি সবাই ঘরেই বসে আছে| কি যেন কথা নিজেদের মধ্যে চলছে| আমি ঘরে ঢুকতেই জেঠু বলল‚ - যাও তো বেটা একবার মাকে নিচে ডেকে নিয়ে এসো তো|আমি কোন কথা না বলে নিজের বাইকটা আবার ঘুরিয়ে নিলাম ওপরের ঘরে যাওয়ার জন্য| এই বাইকটা আমি মনে মনে চালাই| এটা চালালে আমি দেখেছি সিঁড়ি দিয়ে উপর-নিচ করতে আমার অসুবিধা হয় না| তাড়া থাকলেই আমি বাইকটা ব্যবহার করি|- মা তোমাকে নিচে ডাকছে| সবাই বসে আছে| বলেই আমি আবার টার্ণ নিলাম‚ সোজা নিচে‚ জেঠুর পাশে গিয়ে বাইকটা পার্ক করে দিলাম|- এখানে সবাই এখন আছে‚ তাই সবারই জানা দরকার ব্যাপারটা| বলে জেঠু শুরু করল| সংক্ষেপে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে‚ যা যা কথা হয়েছে সেইসব জেঠু সবাইকে জানালো| সেই সঙ্গে মা'কে যে বাবার সাথে চলে যেতে হবে সেটাও জানালো|- আজ আমি আর জগু মিনার কাছে গেছিলাম| মিনাও মনে করে আপাততঃ কুনুকে‚ জগুর সাথে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো| অন্তত পরিস্থিতি যতদিন না আয়ত্তে আসছে ততদিন কুনুর এখানে থাকা নিরাপদ নয়| অন্য স্টেট হলে এই ধরে নিয়ে যাওয়া বা জেলে পুরে দেওয়ার ব্যাপারটা এড়ানো যাবে| কারণ এটা তো কোনো ক্রিমিনাল কেস নয় যে অন্য স্টেটের পুলিশ হেল্প করবে| পরে সব ঠিক হয়ে গেলে না হয়‚ কুনু এখানে চলে আসবে| তবে একটাই চিন্তা কবে সব ঠিক হবে?বড়মা তো কেঁদেই ফেলল|- এ সব আবার কি শুরু হল এই বাড়িতে? সব তো ঠিকই ছিল‚ কার নজর লাগল কে জানে?- তুমি চুপ করবে একটু!! জেঠু ধমকে উঠল|- আমি তো চুপই থাকি| আমার কথা কে আর শোনে? ইত্যাদি ইত্যাদি বড়মা বলেই চলল|কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে বাবা বলল‚- বৌদি তেমন কিছুই হয়নি‚ তুমি ঘাবড়ে যেও না তো| সব ঠিক হয়ে যাবে| এবার শোন যা বলছি‚ যে কাল সকালের কালকা মেলে আমি কুনুকে নিয়ে যাচ্ছি| ওখানে আমরা রাতেই পৌঁছে যাব| এখন যেটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার সেটা হল গোরাকে নিয়ে| গোরা বেটা‚ তুমি জেঠু-বড়মা‚ ছোটকা-ছোটমা'র সাথে থাকতে পারবে তো? কি বল আমার ব্রেভ বয়? - হ্যাঁ পারব তো| মা'কে নিয়ে যাও| আমি একদম ঠিক থাকব| মুখে বললাম বটে কিন্তু মন তো ঠিক মানছে না! মা'কে ছেড়ে তো কখনও থাকিনি| কিন্তু এখন যখন বাড়িতে অসুবিধা আছে তখন তো মা'কে ছেড়ে থাকতেই হবে| কাল ছোটকার সাথে বসে মন দিয়ে একবার হনুমান চালিশা পড়ে নেব| মনে সাহস আসবে তা হলে| ঘরের মধ্যে তখনও কথা হচ্ছে‚ কিন্তু কারও কথাই আমার কানে আর আসছে না| একটা মিলাজুলা ভাষা কানে আসছে শুধু যেটার কোন মানেই ধরতে পারছি না| আমি বরং বাইরে যাই‚ এখানে আর ভালো লাগছে না| বাইরে এসে দাঁড়াতেই টের পেলাম আকাশে অনেক মেঘ করেছে| বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে ঘন ঘন| চুপচাপ একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম| বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে| একটু পরেই বৃষ্টি নামবে‚ এখন ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে| কি আরাম! নিজের থেকেই বারান্দা থেকে নেমে আস্তে আস্তে সামনের পার্কে চলে এলাম| পার্কের কোনায় সিমেন্ট দিয়ে একটা ছাতা মত বানানো আছে আর তার নিচে সিমেন্টের গোল করে বাঁধান চাতাল| এটাও আমার খুব প্রিয় জায়গা| ধুলো জমে আছে অনেক‚ জোরে ফুঁ দিয়ে ধুলো সরিয়ে বসে পড়লাম| টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল| খুব মশা এখানে‚ মা জানলে খুব বকবে| ওখান থেকেই দেখলাম সবাই এখনো কথা বলে যাচ্ছে| আকাশের দিকে আবার দেখতে লাগলাম| হঠাৎ কাঁধে কার একটা হাত‚ পিছন ফিরে দেখি প্রিতি|- তু য়ঁহা? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম|- হ্যাঁ তো‚ মম্মি উপর থেকে দেখল‚ তুই এখানে বসে আছিস| ঝড় - বৃষ্টি আসছে| আমকে বলল তোকে ডেকে নিয়ে আসতে‚ তাই এলাম| চল বাড়িতে| আমার হাত ধরে বলল|- না রে ‚ বাড়িতে ভালো লাগছিল না‚ তাই এখানে এসে বসেছি| তুইও বস না| - দাঁড়া মম্মিকে বলে আসছি| বলে দৌড়ে পার্কের বাইরে চলে গেল আর রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে বলে দিল| তারপর ফিরে এসে আমার পাশে বসল|ততক্ষণে বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হয়ে গেছে| ও আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল‚ - কি হয়েছে রে তোর? দিদির জন্য মনখারাপ লাগছে?- একটু তো লাগছে‚ তবে বেশি মনখারাপ লাগছে মায়ের জন্য| তুই জানিস‚ মা না বাবার সাথে চলে যাচ্ছে‚ যেখানে বাবা থাকে|- কিঁউ? ও তো অবাক| নিশ্চয় ঘুরতে যাচ্ছে| আবার চলে আসবে| - হয়ত তাই! জানিনা‚ আমার কিছু ঠিক লাগছে না| মনে হচ্ছে কুছ হোনেওয়ালা হ্যায়| প্রিতি আমার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরল|- তু য়ে সব কিঁউ শোচ রহা হ্যায়? তোর হালত দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু ঘটেছে| বল না আমায় কি হয়েছে?এই কদিনে আমি অনুভব করেছি প্রিতি আমার অনেক কাছের হয়ে গেছে| ও‚ মা যেভাবে আমাকে নজরে রাখে ও ঠিক সেইভাবেই আমার সব কিছু নোটিশ করে| মনে হয় একে সব বলতে পারা যাবে|- এক প্রমিস কর‚ কাউকে বলবি না|- পক্কা‚ তেরি কসম| কাউকে বলব না|আমি যতটা জানি‚ যতটা বুঝেছি ওকে সবই বললাম| আমি তো আমার অভ্যাসমত মাথা নিচু করে সব বলে যাচ্ছিলাম| তাই খেয়ালই করিনি‚ ও কখন উঠে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে| আমার কথা শেষ হতেই ও আমার দুটো গাল ওর ছোট দুহাতের মধ্যে ধরে ঠিক মায়ের মত| - তু ইতনা পরেশান থা!! আমাকে আগে বলিস নি কেন বচ্চু?আমি কিছু বললাম না‚ চুপ করেই থাকলাম| কি আর বলব? একটাই চিন্তা হচ্ছে আরও কি হতে পারে|- গোরা বাড়ি এসো| বৃষ্টিতে বেশি ভিজো না| প্রিতি আজা বেটা| মা জানালা থেকেই আমাদের ডাক দিল|- আই অ্যান্টি| চল অন্দর চলতে হ্যায়|আমরা দৌড়ে পার্কের গেট পেরিয়ে বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়লাম| কিন্তু বৃষ্টির ছাঁট থেকে খুব বেশি বাঁচা গেল না| মা একটা টাওয়েল নিয়ে এসে আমার আর প্রিতির মাথা মুছে দিল যত্ন করে|- ভেতরে চল| তোমাদের গরম দুধ দিচ্ছি আর সাথে পকোড়াও আছে|দুধের নাম শুনেই প্রিতি উলটা পা!- অ্যান্টি মুঝে ঘর যানা হ্যয়| মা চিন্তা করবে না হলে| বলেই একলাফে বারান্দা পেরিয়ে রাস্তায়| প্রিতি একদম দুধ খেতে চায় না| এই নিয়ে রোজ স্কুলে যাবার সময় ওর সাথে ওর মায়ের লড়াই রাস্তা থেকেই শোনা যায়|ঘরে সবাই বসে আছে‚ কিন্তু কিরকম একটা থমথমে আবহাওয়া| কেউ কেউ দু-একটা কথা বলছে বটে‚ কিন্তু অন্যান্য দিন যেটা হয় হইচই ‚ সেই ব্যাপারটা একদমই নেই|- আমার মতে কিন্তু গোরারও যাওয়া উচিত| হঠাৎ করেও ছোটকা ঘরের মধ্যে যেন একটা বোমা ফেলল|- কেন রে? সবাই প্রায় একসাথেই বলে উঠল|- না মানে বলছি‚ ছোটকা আমতা আমতা করে বলল|- না‚ তুই কিছু একটা ভেবেই বলছিস নিশ্চয়| জেঠু উত্তেজিত হয় উঠল আবার| কি ভেবে কথাটা বললি বল?ছোটকা সবার ছোট বলেই জেঠু ঐভাবেই ছোটকার সাথে কথা বলে| খুব ভালো মানুষ ছোটকা| কথা কম বলে‚ কোন বিষয়ে তর্কেও যায় না| এবারেও জবাব দিল না|আমার এবার অবাক হবার পালা| মা চলে যাবে শুনে মনটা খারাপ ঠিকই কিন্তু তাই বলে আমি একবারও মায়ের সাথে চলে যাব ভাবিনি| আমি এখান থেকে চলে যাব? সেটা কি আদৌ সম্ভব? আমি তো এখানেই থাকব সবার সাথে‚ জেঠু‚ বড়মা‚ ছোটকা‚ ছোটমা'র সাথে| হ্যাঁ মাঝখান থেকে মা থাকবে না‚ সেটাই একটা খারাপ লাগা| কিন্তু মা নিশ্চয় কিছুদিন বাদেই ফিরে আসবে|- মা তো ফিরেই আসবে‚ তাহলে আমি যাব কেন? এতক্ষণ চুপ ছিলাম| কথাটা মনে হয় বেশ জোরেই বলে ফেলেছি|ঘরের ভিতর সবাই চমকে উঠল|- আমার কাছে আয় সোনা| বলে বড়মা আমাকে নিজের কাছে টেনে নিল| কে বলেছে তুমি যাবে? তুমি তো আমার সোনা বেটা‚ তুমি যাবে না‚ এই আমি বলে দিলাম| বড়মা আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল|কিন্তু সবাই চুপ কেন? কেউ কেন বলল না যে আমাকে যেতে হবে না| আমি বড়মার কাছ থেকে সরে মায়ের কাছে গেলাম|- মা আমার খুব ঘুম পেয়েছে| খেতে দিয়ে দাও আমায়| কাল স্কুল আছে না?- সে কি এই তো কতগুলো পকোড়া খেলে| এখনি কি তুমি খেতে পারবে? আচ্ছা চল তুমি খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়| আমি একটু পরে আসছি| মা সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলল|- না না‚ তুই এখানে থাক কুনু‚ আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে| তুই বরং এখানে কথা শেষ করে ওপরে গিয়ে গোছগাছ সেরে নে| কাল অনেক ভোরে তোদের ট্রেন| বলেই বড়মা তাড়াতাড়ি করে আমাকে খাওয়ার জায়গায় নিয়ে গেল| আমার তো খুব একটা খাবার ইচ্ছা ছিল না| আর ঘুম পাওয়াটাও একটা বাহানা| যাতে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া নিয়ে কোন কথা না হয় তাই তো এমনটা করলাম আমি| কোনরকমে একটু খেলাম| বড়মা সামনে বসে আমাকে খাওয়াচ্ছে আর নিজের মনেই বকে যাচ্ছে|- কি যে হল এই বাড়িতে‚ কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না| সাজানো-গোছানো সংসারে যেন আগুন লেগে গেছে| নিশ্চয় কারও নজর লেগেছে| একবার কমল পুরুতকে ডেকে বাড়িতে একটা শান্তি পা করাতে হবে| তাও ভালো মেয়েটার ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেল| এই বাপ-বেটার চক্করে পড়ে জীবনটা আমার কালি হয়ে গেল| আমিও চলে যাবে মেজো ঠাকুরপোর সাথে| তখন বুঝবে আমার দাম‚ ইত্যাদি কত কিছু বড়মা বলেই চলেছে আর মাঝে মাঝেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে|- বড়মা তুমি চিন্তা করো না| আমি আর একটু বড় হয় যাই‚ তারপর তোমাকে আমার কাছেই রাখবো| বললাম তো‚ কিন্তু আমি নিজেই কোথায় থাকব তারই তো ঠিক নেই| বড়মা আমার মাথায় হাত রেখে হাঁউ হাঁউ করে কেঁদে উঠল| এই সেরেছে‚ আমি কি কিছু ভুল বললাম? একটু পরেই বড়মা কাঁদা বন্ধ করতে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম|- যাও বাবা হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়| অনেক সকালে উঠতে হবে| কাল সকালে মায়ের ট্রেন ধরা আছে না? আবার তোমার স্কুলও আছে| স্কুল ড্রেস আমি বার করে রেখেছি| তুমি শুধু ব্যাগটা গুছিয়ে নিও|-হ্যাঁ হ্যাঁ বড়মা‚ এই যাচ্ছি বলে‚ উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলাম| বৃষ্টি থেমে গেছে‚ কিন্তু বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে বাইরে| জানালাটা খুলে দিতেই হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া এসে ঘরটা ভরিয়ে দিল| বিছানায় শুয়ে চাদরটা টেনে নিলাম| ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শে চোখ আর খুলে রাখা যাচ্ছে না| ঘুমের মধ্যে মনে হল‚ মা আমাকে অনেক অনেক আদর করছে আর সেই ছোট্টবেলার ঘুমপাড়ানী গানটা গাইছে.| 'খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে‚ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে‚ খাজনা দেব কিসে'|................. পর্ব - ইতি, গোরা ধান ফুরোলো, পান ফুরোলো খাজনার উপায় কি? আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি !!হটাৎ তন্দ্রাটা কেটে গেলো আমার |মাথার মধ্যে এখনো যেন গানের সুরটা গুনগুন করে ঘুরছে | একবার মাথাটা তুলে চারপাশটা দেখে নিলাম | সামনের বড় কাঁচের প্যানেল দিয়ে সামনের পার্কটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে | চোখটা যেন ঝাপসা মত লাগছে? তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে চোখটা একবার মুছে নিলাম | কেউ দেখে ফেলেনি তো ? নাহ, এখনো লোকজন তেমন আসে নি | ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু দেশি বিদেশী গেস্ট, টেবিল ঘিরে বসে ড্রিঙ্কস নিচ্ছে | মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম মাত্র আটটা বাজে | ঠিক মত হিসেবে করলে বোধহয় চল্লিশ বছর হয়ে গেলো এই বাড়িটা আমরা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম | ঠিক মনে নেই, তবে তারপর হয়তো দু একবার আমরা এসেছিলাম | এখন এই বাড়ি আর সেই বাড়ি নেই , এখন এর নাম বদলে হয়ে গিয়েছে ...... ৫১, শাহ্জহানাবাদ, হেরিটেজ রেস্টুরেন্ট কাম বার........ | নিচের উঠোনটা এখন একটা ছোটোখাটো থিয়েটারের রূপ নিয়েছে | একেক দিন একেক রকমের প্রোগ্রাম হয়ে | কোনোদিন কত্থক. কোনোদিন কাওয়ালি, কোনোদিন মুসায়ীরা ইত্যাদি হতেই থাকে পর্যটকদের জন্য | এই হোটেলের মালিক মিস্টার জগৎ মিত্তল একজন নামকরা আর্কিটেক্ট এন্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইনার |হেরিটেজ বিল্ডিং বা হভেলি কিনে তাকে নানা রূপে পেশ করা ওনার পেশা | ইতিহাসকে পণ্য করে বিজনেস কি করে করতে হয় উনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন | দেয়ালে বড় বড় পেইন্টিংস , বেশিরভাগই সিপাহী বিদ্রোহের সময়কার ছবি | তার সাথে প্রতি ছবির নিচে লেখা এ বাড়ির ইতিহাস , সেই আমার দাদির দাদুর গল্প | একটু রং চড়িয়েছেন গল্পে, তবে বেশি বাড়াবাড়ি করেননি, এই যা | বাইরের পার্কটাও অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছে | আমার সেই পুরানো চিলেকোঠা আর নেই , সেই জায়গায় পুরো ছাদ নিয়ে একটা রুফটপ বার, চারপাশটা গ্লাস প্যানেল দিয়ে ঘেরা | এখান থেকে ঝলমলে পার্কটা কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে দেখতে | সেই ছত্রীটা এখনো আছে, কিন্তু রং বদলে গিয়েছে | উপর থেকে দেখলে মনে হয় পার্কটা এই রেস্টুরেন্টেরই অঙ্গ | জগৎ মিত্তল এমন আর্কিটেক্ট যে ছোটোখাটো রদ-বদল করে উনি জায়গার চেহারায় পাল্টে দিতে পারেন, এইটা নিঃসন্দেহে বলা যায় | বাবার কাছে শুনেছিলাম যে সবাই, মানে বাবা , জেঠু , কাকা অনেক খুঁজে এমন একজন বায়ার পেয়েছিলেন যে এ বাড়ির আর্কিটেকচার কে পুরোপুরি বদলাবে না | এইটা জেঠুর একমাত্র কন্ডিশন ছিল আর কপাল গুনে পেয়েও গিয়েছিলেন এই জগৎ মিত্তল এন্ড সন্স কে | সম্ভবতঃ জেঠুর কোনো বন্ধুই এই যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল| স্কচের গ্লাসটা শেষ হয়ে গিয়েছিলো, বারের দিকে তাকাতেই ওয়েটার বুঝে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে এসে রিফিল করে দিয়ে গেল | আমি জানি এখানকার ম্যানেজার সুজাতা সরকারের চোখ ঠিক আমার দিকে রয়েছে, সেই মতই নির্দেশ আছে এখানকার মালিকের | কেনই বা হবে না, এই বাড়ির সূত্রে জগৎজি বলতে গেলে আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয় গিয়েছেন | উনি এখন অবসর নিয়েছেন , বিজনেস এখন দুই ছেলে দেখে | দুজনই বাপের উপযুক্ত ছেলে | তিন বছর আগে আমার রেকমেন্ডেশনে আমাদের মুম্বই অফিসের ইন্টেরিয়র ওরাই করেছিল , বলতে গেলে আমার মুখ রক্ষা করেছিল দুজনে |গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, উঠোনের দিকটা গিয়ে রেলিং থেকে ঝুঁকে দেখলাম , নিচের আসরে এখন ধীরে ধীরে গেস্টরা আসা শুরু করে দিয়েছে , মনে হয় আরও ঘন্টা খানেক পর এ প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে | তার মানে ততক্ষন আমি এখানে থাকতে পারি| এরপর ওই গান বাজনা শুরু হয় গেলে আর থাকা যাবে না | আমার ফ্লাইট অনেক সকালে | এখান থেকে দশটা নাগাদ বেরিয়ে হোটেল এ গিয়ে কিছু অফিসের কাজ সেরে নেবো, তারপর ফ্লাইট আরামসে ধরা যাবে | শরীরটা আবার সোফায় এলিয়ে দিলাম | মনটা আবার ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল | এটাই হয় এখানে আসলে |বিয়ের পর পর দিন গুলো যে কি ভাবে কেটেছে সেটা আজও ভোলা যায়নি বা ভুলতে পারবোও না কোনোদিন | ছোড়দির বৌভাত তো কলকাতাতেই হয়েছিল, তাই এখন থেকে কেউ যেতে পারেনি , যাবার অবস্থাতেও কেউ ছিল না তখন |তবে মামারা আর কিছু আত্মীয় স্বজন হয়তো গিয়েছিলো| চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকলে সেই সব ঘটনাগুলো চোখের পর্দায় ভাসতে থাকে| কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই না বাড়ির সবাই গিয়েছে সেই সময় | তখন সব কিছু বুঝতাম না কিন্তু এখন বুঝতে পারি সে সব | আজ অনুভব করি, মা সেদিন কি সত্যি সত্যি আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ওই ঘুমপাড়ানি গান, কান্নাভেজা গলায় গাইছিলো? কোনোদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি মাকে , হয়তো কষ্ট পাবে বলেই জিজ্ঞেস করতে পারি নি | মা ,বাবার কাছে যাবার ঠিক তিনদিন পর পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল ছোড়দা কে | বড়মা কত কান্নাকাটি করল, কত কাকুতি মিনতি করলো পুলিশগুলোর কাছে, কিন্তু কিছুতেই ওদের মন ভিজলো না | টানতে টানতে তুলে নিয়েছিল পুলিশ ভ্যানে | বাবার কাছে শুনেছিলাম মিনা আঙ্কল এর এক জুনিয়র খবরটা দিয়েছিলো যে ছোড়দা বাড়িতেই লুকিয়ে আছে | মিনা আঙ্কলের অজান্তেই পুলিশ ছোড়দা কে তুলে নিয়ে যায় | এক ধরনের সাবোটাজ আর কি | প্রোমোশনের ব্যাপার তো ছিলই এখানে | ওই সব ঘটনা যখন হচ্ছিলো তখন আমি স্কুলে ছিলাম | বাড়িতে রয়েছে বড়মা আর ছোটমা | জেঠু আর ছোটকা গিয়েছিলো মিনা আঙ্কলের কাছে | ঘরে ঢুকে দেখি বড়মা বিছানায় শুয়ে রয়েছে | আমি স্কুল ব্যাগটা নিজেদের ঘরে রেখে এসে ছোটমার কাছে গিয়ে বসলাম | বড়মা একবার চোখ খুলে আমাকে দেখে ছোটমাকে বললো ,- ওকে খেতে দাও তুমি , তেতেপুড়ে এসেছে বাচ্চাটা | আমার দিকে তাকিয়ে বললো , বাবুসোনা, তুমি বরং খেয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও দেখি | বলে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো | বাস, ওই টুকুনই বলল বড়মা | খেতে বসে ছোটমা আমাকে বললো সব কথা | সব শোনার পর আমার খাবার ইচ্ছে একদম চলে গেল | এবার কি হবে ? এই চিন্তা আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো | ইতিমধ্যে চার পাঁচদিনের মাথায় বাবাও চলে এলো দিল্লিতে | উদ্দেশ্য এক , সেই ছোড়দাকে খুঁজে পাওয়া | পাড়ার সবাই এ ব্যাপার আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল | যে যার নিজের সোর্স থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো | কিন্তু আশ্চর্য ভাবে ছোড়দা একদম উধাও হয়ে গেল | দিল্লি তো ছিলই, হরিয়ানা , উত্তরপ্রদেশের লাগোয়া কোনো থানা বাদ যায়নি খোঁজ নেওয়া থেকে | মিনা আঙ্কলের যত খবরি ছিল তারাও কোনো খবর দিতে পারলো না | বাবা আর জেঠু সন্তোষজির সাথেও দেখা করে খোঁজ নেবার চেষ্টা করে , কিন্তু উনিও কিছু করতে পারলেন না | বাবার কিন্তু সন্দেহ ছিল যে সন্তোষজি ঠিক জানতো যে কোথায় আছে ছোড়দা , কিন্তু বলে নি | এ কথাটা বাবা আজও বলে| হাতের কাছে সাইলেন্ট মোড এ রাখা ফোনটা কেঁপে উঠলো | কি জ্বালা, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট এসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি মিস্টার মেহেতার ফোন | অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা তুলতে হলো- হ্যালো , - স্যার, অসময়ে বিরক্ত করলাম না তো ? এক্সট্রিমলি সরি স্যার , - না না ঠিক আছে বলুন | বিরক্তিকর বিনয় আমার অপছন্দ |- স্যার আজকের অরেঞ্জমেন্টে কোনো কমি তো ছিল না ?- না, সে রকম কিছু তো নজরে আসেনি, তবে বাউন্ডারির বাইরে নিয়ন আর এল.ই.ডি ডিসপ্লেগুলোর কিছু কিছু জায়গায় ব্রোকেন ছিল |- সরি স্যার, আমিও সেটা নোটিশ করেছি, ওগুলো লাস্ট মোমেন্টে গন্ডগোল করলো, শুরুতে কিন্তু ঠিকই চলছিল |- কোনো ব্যাপার না | ওরকম হয়েই থাকে , নেভার মাইন্ড |- থ্যাংক্যু স্যার , আসলে স্যার সেমি ফাইনাল তো, তার উপর ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচ, কিছু গন্ডগোল যাতে না হয় তার দিকেই আমাদের বেশি নজর ছিল , তাও ভালো যে ইন্ডিয়া জিতে গিয়েছিলো না হলে এই মব সামলানো খুব মুশকিল হয়ে যেত |মনে মনে ভাবছি ইনি কখন মোদ্দা কোথায় আসবেন |- সরি মেহ্তাজি আমি একটু ব্যস্ত আছি এখন , আমরা কি কাল কথা বলতে পারি ?- নিশ্চই স্যার , কাল তো কথা বলবোই , আসলে স্যার আমার উপর প্রেশার আছে একটু , আপনি যদি আমাদের থার্টি পার্সেন্ট পেমেন্টটা একটু তাড়াতাড়ি করিয়ে দেন তাহলে খুব ভালো হয় স্যার , তাছাড়া এটাও জানবার ছিল যে ফাইনালে আপনিই আসছেন তো ?- দেখুন, আমি চেষ্টা করব যত তাড়াতাড়ি হয় আমি করিয়ে দেব | আর ফাইনালে মনে হয় কোরিয়া থেকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর আসবেন | সে আপনাদের আগে থেকেই জানিয়ে দেব , সে চিন্তা করবেন না |বিরক্তিকর আলোচনা থেকে পাস কাটানোর জন্য কথা শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি , কিন্তু বিধি বাম|- কিন্তু স্যার আরেকটা ব্যাপার ছিল তার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত | ওই সন্তোষ উপাধ্যায় স্যার , ওকে যে কে ইনভাইট করেছিল জানি না , ট্রফি তিনি নিজের হাতে দেবে বলে হাঙ্গামা শুরু করে দিলেন , অনেক কষ্টে ওকে আটকাতে পেরেছি | - হুম , নেক্সট টাইম থেকে আপনারা যদি এটা খেয়াল রাখেন তাহলে ভালো হয়|একটু কঠিন ভাবেই বললাম কথাটা | ঠিক আছে আজ রাখছি, বাই | বলে ফোনটা ডিসকানেক্ট করে দিলাম| এই ধরনের বত্তমিজি আমি সাধারণতঃ করি না | কিন্তু কি করব, মাথাটা গরম হয় গেল ওই বাস্টার্ডটার নাম শুনে |সুজাতা আমার কাছে এগিয়ে এলো ,- কিছু চাই স্যার? আমরা আজ একটা স্পেশাল মুঘলাই ডিশ করেছি , একবার টেস্ট করবেন ? আরেকটা কথা স্যার , আপনি চাইলে আপনার ফোনটা আমার কাছে দিতে পারেন , আপনার বাড়ির ফোন ছাড়া আর কারো ফোন এলে বলে দেব যে আপনি বিজি আছেন এখন ?ওর কথায় আমি হেসে ফেললাম ,- থ্যাঙ্কস সুজাতা, তার দরকার নেই , মনে হয় না আর কেও ফোন করবে | তা একটু দাও তোমাদের নতুন ডিশ| বেচারির খারাপ লাগবে তাই বললাম ওকে , খাবার ইচ্ছে এখন একদম নেই আমার |- ওকে স্যার , এক্ষুনি পাঠাচ্ছি| প্লিজ এনজয় ইওর ড্রিঙ্কস স্যার| বলে ওয়েটারকে নির্দেশ দিলো কিছু |যতদূর মনে পরে বাবা বোধহয় আট - দশদিন ছিল দিল্লিতে | বড়মা তো পুরো শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিল | দিনরাত শুধু কান্না আর কান্না | ঘুমের মধ্যেও আমি অনেক সময় কাঁদতে দেখেছি | আমি তো স্কুল থেকে ফিরেই বড়মার কাছে গিয়ে বসতাম | নিজের সাধ্য মত সান্ত্বনা দিতাম | ওষুধ , জল খাইয়ে দিতাম | মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম | নিজেকে যেন অনেক বড় ভাবতে লাগলাম | গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার দাবার গরম করতেও শিখে গেলাম | ছোটমা তো বাড়ির অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতো | যদিও একজন কাজের বাঈ ছিল | কিন্তু কিছু কাজ তো নিজেদের ও করতে হয় | একদিন দেখলাম নিচে জেঠু, বাবা আর ছোটকা কিছু জরুরি কথা বলছে | আমি তিনজনের জন্য চা বানিয়ে ঠিক মার মতো টি পটে চা ঢেলে, ট্রেতে করে সাজিয়ে ওদের সামনে টেবিলের উপর রাখলাম , মাথা নিচু করে বললাম ,- আমি চা বানিয়েছি জেঠু | বাবা অবাক হয় আমার দিকে তাকালো, তারপর উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো আর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে লাগলো |জেঠু কি রকম ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ , - বাচ্চা ছেলেটাকে আমরা টেনে বড় করে দিলাম রে জগু, বলে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো | আমি জেঠুর কাছে গিয়ে চেয়ারের হাতলে বসে বললাম, - জেঠু আমি তো এমনিই বড় হয়ে গিয়েছি , তুমি এমনি করে কেঁদোনা তো , শরীর খারাপ করবে এবার | বলে জেঠুর পিঠে হাত বোলাতে লাগলাম | জেঠু আমার হাতটা টেনে নিজের বুকের কাছে ধরে নিয়ে চুপ করে বসে রইলো | বাবা আর ছোটকা কি রকম ঝিম মেরে বসে রইল | ছোটো ছোটো ঘটনা, কিন্তু মনে হয় যেন কালই ঘটেছে সব | মনে গেঁথে রয়েছে প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা মুহূর্ত | মা তো সতেরো বছর হলো আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে | কিই বা বয়েস হয়ে ছিল মার | দিল্লি ছেড়ে আসার পর যতদিন বেঁচে ছিল মা শুধু নিজেকেই সব কিছুর জন্য দোষী মনে করে গেল | বেচারা বাবাকেই তো সব সামলাতে হয়েছিল | আমি তো পড়াশুনো আর কাজ নিয়ে অনেকটা সময় বাইরেই কাটিয়েছি | ওদিকে জেঠু বড়মা, এদিকে মা, তার উপর নিজের কাজ , কি না করেছে বাবা একা হাতে | তবে বৌমা, মানে আমার বৌ সুরেখা আর আমার দুই যমজ ছেলে মেয়ে কুশ আর লিপিকে পেয়ে বাবা মা নিজেদের অনেকটা সামলে নিয়ে ছিল | কিন্তু মা তো ভিতর থেকেই ক্ষয়ে গিয়েছিল | আর মন ভেঙে গেলে যে শরীরও ভেঙে যায়, সেটা মা কে দেখেই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম | দিল্লিতে সেই সময় একমাত্র সাথী প্রিতিই ছিল | খেলতে যাওয়া তো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলাম | বাড়িতেই এতো কাজ থাকতো | তাছাড়া ছোড়দার ব্যাপারে সবাই জিজ্ঞেস করতো বলে আমিও বন্ধুদের এড়িয়েই চলতাম , যদিও কোনো কারণ ছিল না | স্কুল থেকে ফিরেই প্রিতিই বাড়িতে চলে আসতো | আমার সাথে বসেই হোম ওয়ার্ক গুলো শেষ করতো | শুধু আমার সাথেই না, বাড়িতে সবার জন্য ও সময় দিতো | ও কাকিমা, বড়মা, জেঠু সবার সাথে বসেই কথা বলতো, স্কুলের গল্প, পাড়ার গল্প | এখন ভাবি, প্রিতিই তো আমার বয়েসিই ছিল , কিন্তু কত পরিণত ছিল আমার থেকে | বেশির ভাগ দিনই প্রিতির মা মানে সিং আন্টি প্রিতির সাথে আমার স্কুলের টিফিন পাঠিয়ে দিতেন | বাড়িতে তো রান্নার লোক রাখা হয়েছিল ওই সময়, কিন্তু তাও উনি পাঠাতেন | ছোটকার কথাই শেষ মত ঠিক বেরোলো | আমাকেও বাবা নিজের কর্মস্থানে নিয়ে এলো | নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে সময় তো লেগেই ছিল | একে বিহার, তার উপর ভাষা | কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি আমার সেই অসুবিধার কথা | কাকেই বা বলবো | এদিকে কয়েক মাস পর ইমার্জেন্সি শেষ হলো, দেশের অবস্থা অনেকটা ঠিক হয়ে এলো | সেই সময়কার রুলিং পার্টি আর নেই | নতুন করে ইলেকশন আবার হবে | সেই সময় সবাই আশা করে ছিল যে ছোড়দাকে এবার পাওয়া যাবে | কিছু মাস পর পাওয়াও গেল, কিন্তু কি অবস্থায় ? হরিয়ানার এক ছোট শহরের এক নাম না জানা হাসপাতালে | এক মুখ দাড়ি গোঁফ, বড় বড় চুল রোগা, চেনার কোনো উপায় ছিল না | জানা গেল কিছুদিন আগে রাস্তায় বেহুঁশ অবস্থায় পেয়ে লোকেরা হাসপাতালে দাখিল করে দিয়েছিল, এই ভেবে যে রাস্তায় মরে পরে থাকবে তাই | অবশ্য মিনা আঙ্কলই শেষ অবধি উদ্ধার করতে পারে ছোড়দাকে | আর কেউ হলে খুঁজেই পেতোনা | সেদিন ও একটা দিন ছিল আমার জীবনে | আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা কি রকম একটা জবুথবু হয়ে ঘরের এক কোণায় বসে আছে | কি হলো মার ? আমি কিছু না বলে স্কুল ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে রাখা খাবার খেতে বসলাম | কিন্তু মা তো এলো না ? আমি খেতে বসলেই তো মা এসে কাছে বসে ? আমি খাওয়া ছেড়ে মার্ কাছে গেলাম,- মা , কি হয়েছে তোমার ? শরীর ঠিক লাগছে না ? বাবা কে ডাকবো ? মা অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছে , আর আস্তে আস্তে কি যেন বলছে | আমি ভালো করে কাছে গিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম ,- আমার জন্যেই সব হলো, আমি দোষী সবার কাছে , ভগবান আমায় যেন ক্ষমা না করেন | আরও কি সব যেন বলে যাচ্ছিলো মা | আমি সত্যি এবার ঘাবড়ে গেলাম , জোরে জোরে মার কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম | - মা, মা কি হয়েছে মা তোমার ? হটাৎ মা যেন সম্বিত ফিরে পেল |- ওহ, তুমি এসে গিয়েছো ? আমায় ডাকোনি কেন আগে ? চলো খেতে চলো | বলে যেন কিছুই হয়নি সে ভাবে উঠে কিচেনের দিকে চলে গেল আমাকে খেতে দেবে বলে | কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির কাজের মেয়ে, সেই সব বললো ,- সাবজি আজ জলদি চলে এসেছিলো অফিস থেকে , দিল্লি সে ফুঁনওয়া আইল রহে না ! কি যেন একটা হয়েছে দিল্লি মে |- গোরা , খেতে এস তাড়াতাড়ি, খাবার ঠান্ডা হয় যাচ্ছে যে ,- হা মা , এই আসছি |খেতে খেতে মার দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম , এখন স্বাভাবিকই আছে মনে হলো, - মা , দিল্লি তে কি হয়েছে ? বাবা কেন দিল্লি চলে গেল তাড়াহুড়ো করে?মা ই আমাকে সব বললো যে ছোড়দাকে পাওয়া গিয়েছে আর কি অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে ইত্যাদি | বাবা তাই দিল্লি গিয়েছে | সব ঠিকঠাক করে শিগগিরই ফিরে আসবে |- মা, এ তো ভালোই হলো , ছোড়দাকে পাওয়া গিয়েছে | আর কিছুদিন হাসপাতালে থাকলে এমনিই ভালো হয় যাবে ছোড়দা, তাই না মা ? আমার সত্যি ভীষণ আনন্দ হলো , যাক এবার সব কিছুই ঠিক হয় যাবে | আমরা আবার সবাই বাড়ি ফিরে যাবো | মা অবশ্য আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না | মা আবার কি রকম চুপ করে গেল | আমার মনে হয়তো একটা ক্ষীণ আশা ছিল, কিন্তু না, তা আর হয়নি |বড়মা একটু ঠিক হতেই, বড়োরা সবাই ঠিক করে নিলো যে এ বাড়ি তারা বিক্রি করে দেবে | একটু চিন্তা ছিল যে, এই বাড়ি ক্লেইম করার আরও কেউ ওয়ারিস আছে কি না , কিন্তু অনেক খুঁজেও কাউকে পাওয়া গেল না | অনেক পুরোনো বাড়ি তো, হতেই পারতো কেউ না কেউ | একবার কেস ঠুকে দিলেই তো হয় গেল | তাছাড়া এতো বড় বাড়ি, কেনার লোকও তো চাই | ব্যাপারটা যত সহজ ভাবা হয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো বেশ ঝামেলা আছে | বাবা তো প্রতি মাসেই একবার করে দিল্লি যেত | একে তো বাড়ি বিক্রি, তার উপর ছোড়দার ট্রিটমেন্ট | এদিকে ছোড়দা প্রাণে তো বেঁচে গেলেও , কোমর থেকে নিচে পুরো অসার হয়ে গিয়েছিলো | ডাক্তার ও এ ব্যাপারে কোনো আশা দিতে পারলো না | মানে এ ভাবেই হুইল চেয়ার নিয়েই সারা জীবন কাটাতে হবে | সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে নি | সুরেখার সাথে আমার ম্যানেজমেন্ট কোর্স করার সময়ে আলাপ, তারপর বিয়ে | ও মারাঠি, কিন্তু আমাদের ফ্যামিলিতে খুব সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিয়েছিল | ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছোড়দা | বড়মা তো আমার বিয়ের আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন | বাড়ি বিক্রি হবার পর তো জেঠু আর ছোটকারা ভাড়া বাড়িতে চলে গিয়েছিলো | বড়মা মারা যাবার পর সত্যি এবার জেঠুদের অসুবিধা হতে লাগলো, বিশেষ করে ছোড়দাকে নিয়ে , ওর দেখাশুনোটাও একটা বড় কাজ | কাজের লোক রাখা সত্ত্বেও বাড়ির কেউ না থাকলে খুব অসুবিধা | অনেক কষ্টে জেঠু কে বোঝানো গেল এই অসুবিধার কথা | সেই মত ঠিক হলো যে জেঠু ছোড়দির কাছে আর ছোড়দা আর বাবা আমার কাছে থাকবে | কিন্তু বাবা বেশিরভাগ ছোড়দির কাছেই থাকতো | দিল্লি ছাড়া বাবা পক্ষে সম্ভব ছিল না | আমিও জোর দেয়নি কখনো বাবা কে | আবার ফোনটা বেজে উঠলো, বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুলতে গিয়ে দেখলাম সুরেখার ফোন |- হা বোলো সুরেখা ....- ও হো মামুজান, কি আদর করে কথা বোলো মামীজান কে সাথে ? - আরে নন্দিনী তুই ? কবে এলি রে ? আগে খবর দিলি না কেন রে যে তুই আসবি ?- আমরা তো সবাই ........- আরে চুপ চুপ...... ,আরও অনেকের গলা পেলাম মনে হলো ? বাবার আওয়াজও পেলাম মনে হলো ?- ছোড়ো না মামুজান, টিভি তে ট্রফি দেবার সময় কি ধানসু লাগছিলো তোমায় | চশমে বদদুর মামু | আমরা সবাই তাই বলছিলাম |- আমরা সবাই কে ?- আমরা মানে ......আরে ছাড়ো না | তোমার ফ্লাইট কখন ?- সকালেই, মুম্বাইতে নাইন থার্টি তে পৌঁছে যাবো |- ঠিক আছে ব্রেকফাস্ট এক সাথে করবো ওকে ?- নিশ্চই, বাই ‚- বাই ফোনটা হাতে ধরেই ভাবতে লাগলাম, কি ব্যাপার সবাই কেন এসেছে ? কিন্তু যাই হোক কিছু একটা মজা তো হবে পক্কা |ফোনটা আবার গোঁ গোঁ করে উঠলো, রিমাইন্ডার, আসলে আমি ভুলে যাই বলে সুরেখা দুনিয়ার সব আত্মীয় বন্ধুদের এনিভার্সারি, বার্থডের ডেট গুলো ফিড করে রাখে, আমিও সেই দেখে সবাই কে উইশ করে মেসেজ করে দি | এবার আমি নিজেই হো হো করে হেসে উঠলাম | আরে এতো আমারি ফিফটিয়েথ বার্থডে | এবার বুঝেছি সবাই কেন এসেছে | সত্যি মনটা খুব ভালো হয় গেল | ম্যানেজার সুজাতা কে ইশারা করলাম আমার পেমেন্টটা রেডি করার জন্য | ড্রাইভার আমাকে আসতে দেখে দরজা খুলে দাঁড়ালো | আমি গাড়িতে উঠতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম | পুরোনো অভ্যেস মতো দুটো বাড়ি ছাড়িয়ে তৃতীয় বাড়ির দিকে নজর চলে গেল | প্রিতিরা তো এখন আর ওখানে থাকে না | কোথায় আছে তাও জানা নেই | তবুও হাত তুলে বাই করলাম প্রিতিকে, যেমন আগে স্কুল থেকে একসাথে ফেরার পর করতাম | ছোটবেলায় মা বলতো যারা মারা যায় তারা আকাশের তারা হয়ে যায়, আমি আজও তাই বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করতে মন চায় | রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাথার উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে জেঠু, বড়মা আর মাকে মনে মনে প্রণাম করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম গাড়ির কাঁচ নামিয়ে আরেকবার হাত নাড়লাম, ....বাই ৫১, শাহ্জহানাবাদ ....ফির মিলেঙ্গে, ওয়াদা রহা!!!!.....শেষ
বাঙালবাড়ির কিস্যা (প্রথম ভাগ) এলেম আমি কোথা থেকে( ৮ম পর্ব) --------------------------------------------------- নাকতলার সেকন্ড স্কীমের ফুটবল মাঠে সেদিন হেব্বি হল্লা, বাওয়াল হয়েছে বাপ-ছেলেতে, হেসে মরছে পাড়াপড়শি, ছেলেছোকরারা। বাসস্টপে নেমে হরিদাস পাল রঞ্জন সেদিন হনহনিয়ে হাঁটছে, আজকে শেষ রিহার্সাল। পরশু ওয়ান অ্যাক্ট কম্পিটিশনে প্লে নামাবে ওরা, আঠারো বছর বয়সের ছয়জন বন্ধু। জজের প্যানেলে আছেন থিয়েটারে আলোকসম্পাতের জগতে বিপ্লব ঘটানো তাপস সেন ,থাকেন পাশের পাড়া রামগড়ে। ব্যস্, এই কম্পিটিশন জিততে পারলেই কেল্লা ফতে। পাব্লিক? " বুঝবে তখন বুঝবে!' তখন নিশ্চয়ই সবাই ঝুলোঝুলি করবে -- আমাদের ওখানে একটা শো' করুন না! ওদের যে কেউ ডাকে না, বিনিপয়সায় করতে চাইলেও না। কোন ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নাটক করার জন্যে তার সেক্রেটারিকে ধরে অনেক আমড়াগাছি করে শো করার অনুমতি পাওয়া গেল। তেড়ে একমাস রিহার্সাল দেয়া গেল। বাড়ির লোকজন, গার্লফ্রে¾ড সব্বাইকে বলা হয়ে গেছে-- অমুক তারিখ আমার শো'। তারপর ঠিক একদিন আগে জানা গেল ওদের নাম কেটে শো অন্য কোন সিনিয়র নাটকের দলকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু খেলার মাঠের পাশে আজকে কিসের বাওয়াল? ---- ওই হাফপ্যান্ট পরা ছোঁড়াটা কে র্যা? হাড়বজ্জাত ছেলে! ----- বেলেঘাটা থেইক্যা কয়মাস হইল আইছে, খালি মাজাকি করে! ----- আমাদের পাড়ার দারোগাবাবু, হেই যে বাদলার বাপ! উনার একটু কম্পলেক্স আছে। রোজই আফিস থেইক্যা আইস্যা লুঙি পইর্যা উনি পাড়ার ছেলেদের ইংরাজির পরীক্ষা নে'ন। যেমন,-- "" তিমির, তুমি তো ভাল ছাত্র, কও দেখি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়িতেছে, এর ইংরাজি কি অইব? হা:-হা:-হা:! পারলা না তো, জানতাম। আইজকাইল ইসকুলে কিস্যু শিখায় না। আচ্ছা, এইডা কও-- টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। এইডাও জান না? বেশ, এইবার একটা সহজ প্রশ্ন করি-?"" মস্মস্ করা নতুন জুতা''-- এর ইংরেজি কও? সব চুপ! কিন্তু হেই হারাম্জাদাটা কয় কি? ----- এরা কিস্যু জানে না, মেসোমশায়। আপনেই কন--" কচ্কচ্ করা নতুন বাল'' এর ইংরাজি কী? - হারামজাদা পোলা! আমি তর বাপের বয়সী, আমার লগে ইয়ার্কি! আইজই তর বাপেরে কমু, কি শিক্ষা দিছেন নিজের পোলারে? কিন্তু আজকে খেলার মাঠে দারোগাবাবুকে তো দেখছি না,ওই ছোঁড়াটা দৌড়ুচ্ছে , পেছনে ওর বাপ। ব্যাপারটা কি? ------- আর বলিস না। দারোগাবাবুর নালিশ শুনে বাপ তো ছেলেকে আচ্ছা করে কড়কে দিল। কিন্তু ছেলেটা এক্কেবারে যাকে বলে রেকটাম-রাইপ। আজ খেলার মাঠে বন্ধুদের তোল্লাই খেয়ে নিজের বাপকেই জিগ্যেস করেছে-- ' বাবা, আইজ ক্লাসে মাস্টারে জিগাইসে স্বাধীনতা সংগ্রামী ত্রয়ীর নাম। আমি দুইটা কইসি,--" লাল' আর" পাল '। আরেকটা নাম কি যেন? কী ""গঙ্গাধর তিলক''? ------ তারপর? ------- তারপর আর কি! বাপের তেলেভাজার দোকান, তাড়াহুড়ো করে ছেড়ে এসেছে, স্কুলের মাঠে এবারে নতুন প্লেয়ার শ্যাম থাপার খেলা দেখবে বলে।। রেগে গিয়ে বলেছে-- বানচোইৎ! জাননা কী গঙ্গাধর? ''বাল""! তারপর কী হচ্চে দেখতেই পাচ্ছিস। না, রনজন কিছুই দেখছে না। ওর কানে বাজছে ওই দু-অক্ষরের শব্দটি। কালকেই ওর দলের একটি ছেলে বলেছে--- এইসব বালের নাটক করে কী হবে? পাড়াতেও এরকম কিছু টিপ্পনী কানে এসেছে। কী হবে? ও নিজেও জানেনা কী হবে। খালি জানে ওকে নাটক করতেই হবে। আজ নয়তো কাল। হবে, একদিন হবে। বনৎ বনৎ বনি জাই, বিগড়ি বনৎ বনি জাই। দরকার একটা জেদ, একটা পাগল করা জেদ। কিন্তু, ও কি পারবে? ওর কি আছে সেই জেদ? ওর বাবা সলিলকুমারের ছিল। কিন্তু ও যে এক্কেবারে অন্যরকম, ভীতুর ডিম, বাবার মত নয়। দাদুর আদরের নাড়ুগোপাল। কিন্তু ওর ভুতের ভয়, আরশোলাকে দেখে ভয়,বহুরূপীকে দেখে ভয়, সাঁতার কাটতে ভয় , ইনজেকশন নিতে ভয়-- এইসব দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে দাদু সতীশচন্দ্র বলে উঠতেন-"' এইডা সিংহের ঘরে শিয়াল জন্ম নিছে''। হ্যাঁ, ওর বাবা সলিলকুমার চারদিকের খটাশ, ভোঁদড়, সজারু, নেকড়ে আর হায়েনার পালের মধ্যে সিংহ ছিলেন। মরেছেন ও সিংহের মত, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে। বলতেন-- আমি বিছানায় শুয়ে ভুগে ভুগে তোমাদের সেবা শুশ্রুষা নিয়ে কেঁদে ককিয়ে মরবো না। কাউকে বিরক্ত না করে তার আগেই চলে যাবো। যখন সময় হবে, মানে চিত্রগুপ্তের লেজারে আমার ব্যালান্স "জিরো' হবে, যমদূত নিতে আসবে, বলব-- একটু দাঁড়াও, জুতোর ফিতে বেঁধে পানামা সিগ্রেট ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে নি। ব্যস্, এবার চল। ভগবান বোধহয় ওঁর মনের ইচ্ছে শুনেছিলেন। তাই ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের কন্স্ট্রাকশন এরিয়ায় মেদিনীপুরের কাঁথি থেকে লেবারের কাজ করতে আসা ছেলেটির ওপর যখন সীমেন্স কোম্পানীর বানানো মোটর কন্টোল সেন্টারের বিশাল এম সি সি মেশিন স্লিপ হয়ে গড়িয়ে পরে পিষে ফেলছিল তখন উনি দৌড়ে এসে দুইহাতে ওই মেশিনটিকে ক্রেট শুদ্ধু ঠেলে ধরে রাখেন। ছেলেটি নীচের থেকে গড়িয়ে সরে গিয়ে বেঁচে গেল। কিন্তু সলিলকুমার আর পেছনে সরে যাওয়ার জায়গা পেলেন না। ফলে ওই মেশিন ক্রমশ: ওনাকে পিষতে লাগল, মাটিতে পেড়ে ফেললো। যখন সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ওনাকে নিয়ে গেল, তখন উনি পরিচিত ডাক্তারকে বল্লেন--- পা টা তো গেছে, মাত্র এক ইঞ্চি আটকে থেকে ঝুলছে। বুটজুতো খুলে দে। ব্যথা লাগছে। কিন্তু এসব কিছু না। আসল হল পেটের ওপর মেশিন পড়ে লিভারে চোট লেগেছে , বড্ড ব্যথা। একটা পেন কিলার ইনজেকশন দাও। তারপর চোখ বুজলেন, আর খুললেন না। পুলিশ ওয়্যারলেসে খবর পৌঁছলো কোরবা জেলার আদিবাসী এলাকায় ছুরি গাঁয়ে। রাত আটটায় খবর পেয়ে হরিদাস পাল তো বৌকে নিয়ে রাত জেগে ভীড়ের ট্রেনে চেপে পড়িমরি করে ভিলাই পৌঁছলো পরের দিন সকালে, বাবার বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে মর্গে ঘুমিয়ে থাকা শরীর থেকে বরফ জল মুছে পোস্টমর্টেম করাতে নিয়ে গেল। পাশের কামরায় ডোম যখন হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে সলিলকুমারের মাথার খুলি খুলে দেখছিল তখন হরিদাস পালের মনে হচ্ছিল যেন গ্যারেজে ট্রাক মেরামত চলছে। কিন্তু যখন চিতায় শুইয়ে সারা শরীরে , বিশেষ করে পেটে-বুকে ডোমের সেলাইয়ের ওপর ঘি মাখাচ্ছিল তখন হাত যেন আর চলে না। পরিচিত পুরুতঠাকুর ধমকে উঠলেন--- কী হল? তাড়াতাড়ি করুন। এমন অন্যমনস্ক হলে চলে! কিন্তু হরিদাস পাল করবে কী? ও যে দেখতে পাচ্ছে যে এই দু 'দিনের বাসি মড়া সলিলকুমার নয়। সলিলকুমার তো এখন মেঘনা নদীতে নৌকো ভাসিয়েছেন। গলুইয়ের পাশে বসে বিড়িতে টান দিয়ে ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে গান ধরেছেন--- মনপাগলা রে! কই হতি কই লইয়া যাও! এরপর উনি ডুব দিয়ে পাট তুলবেন বেশকিছু। তারপর সেই পাট মহাজনের কাছে বেচে বন্ধুদের সঙ্গে রসগোল্লা কিনে খাবেন। বাবা মাছ আনতে আট আনা দিলে ময়মনসিংহের বাড়ির চৌকাঠে সেই পয়সা নামিয়ে রাখছেন সলিলকুমার। না, পুরো একটাকাই চাই। সেটা দিয়ে অন্তত: দুইসেরি বা আড়াইসেরি রুই মাছ কিনবেন। বাড়ির চাকর সেটা পেছন পেছন নাকের থেকে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি আনবে, আর মাছের লেজ সারা রাস্তা পথের ধুলো সাফ করতে করতে আসবে। এই না হলে বাঙাল! দেশভাগের পর পার্কসার্কাসের বাড়িতে সামনের ধাঙড় বাজারের কিছু গুন্ডা আক্রমণ করল, সময়মত গুরুসদয় দত্ত রোডের ছাউনি থেকে কিছু গোরা সৈন্য ও কড়েয়া থানার পুলিশ এসে পড়ায় কোন জানমালের ক্ষতি হয়্নি। সলিলের বড়দি সেই গুন্ডাদের চিনিয়ে দিলেন। ওরা হাজতে রইল। তারপর পাড়ার একজন রাজনৈতিক নেতা গুন্ডাদের মুক্তির জন্য জনগণের সইসাবুদ সংগ্রহ করতে বেরোলেন। ক্রুদ্ধ সলিল ওই পিটিশনে সাইন করতে অস্বীকার করলেন। বল্লেন-- অরা ঠিক জায়গাতেই আছে, অদের উপযুক্ত জায়গায়। কিন্তু ভিলাইয়ে দাঙ্গাবাঁধার উপক্রম হলে সারারাত অফিসের জীপ নিয়ে উত্তেজনা যাতে না ছড়ায় তার জন্যে টহলদারি করেছেন। নিজের মুসলমান কর্মচারিদের সঙ্গে একসাথে বসে খেয়েছেন। হালাল ও ঝটকা মাংস নিয়ে কেউ কিছু বললে বলতেন -- নেতাজী সুভাষ বোস বর্মায় থাকার সময় খাবার লাইনে ঝটকা-হালাল নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেপাইদের দুই আলাদা পংক্তিতে খেতে বসা দেখে অবাক হয়ে দুইবাটির আলাদা মাংস একটি বালতিতে ঢেলে নিয়ে রেগুলেশন সোর্ড দিয়ে ঘেঁটে দিয়ে বলেছিলেন, এবার কোনটা ঝটকা আর কোনটা হালাল পদ্ধতিতে রান্না মাংস কেউ চিনিয়ে দিক তো। আর যে ছেলেটাকে আজ বাঁচাতে গেলেন বছর আগে সেই ছেলেটারইতো মে মাসের গরমে হিটস্ট্রোক হয়ে প্রচন্ড জ্বর আর বমি হয়েছিল। সবাই ধরাধরি করে গাড়িতে করে বাড়ি এনে ওকে মাটিতে শোয়ালো। স্ত্রী স্মৃতিকণা ঘাড়ের নীচে কাগজ দিয়ে মাথায় জল ঢালছেন। কিন্তু ঠিকমত হচ্ছে না।সলিল ভ্রূ কুঁচকে দেখছিলেন। এবার ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বল্লেন-- এবার ভাল করে মাথা ধুইয়ে দাও। সেইদিন হরিদাস পালের চোখে ওর বাবার হাইট অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সবার কাছে বাবা-মা রা রোল মডেল। কিন্তু হরিদাস পাল রনজনের রোল মডেল ওর বাবা নয়। ও জানে ও কোনদিন ওর বাবার মত হতে পারবে না। সলিলকুমার অন্য ধাতুতে গড়া। দেখতে কিঞ্চিৎ কাঠখোট্টা ভদ্রলোকের ভীষণ ম্যানলি পেটানো চেহারা। যখন মহিলাদের সামনে একটু ঝুঁকে বাও করে কাউকে বলেন----" ভাল আছেন? ভাল থাকুন' , তখন সেই "" অদা'' দেখে ওরা দু'ভাই বাবার শিভালরাস নাইট ইমেজের প্রতি ফিদা হয়ে যায়, কিন্তু ভীষণ জেলাস হয়। হরিদাস পাল মেয়েদের সামনে আজীবন দড়কচা মেরেই রইল। আবার সলিলকুমারের চোখে রোলমডেল তাঁর মাতৃভক্ত বাবা সতীশচন্দ্র ন'ন। যে ভদ্রলোক কোলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লি যাবার সময় মায়ের কথায় চাকরি ছেড়ে ময়মনসিংহ ফিরে যায় সে ঠিক পুরুষকারে বিশ্বাসী সলিলকুমারের শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে না। -----বিপ্লব করবি? বিপ্লবের মানে বুঝস্ ? বিপ্লব করতে অইলে নিজের নিজের ডেথ ওয়ারেন্টে নিজে সাইন কইর্যা তবে পথে নামতে হয়। তর আছে সে সাহস! -------তোমরা না সেই আনন্দমঠের যুগে পড়ে আছ। তোমাদের মেটাফরগুলো না!---- ----- আরে, তোদের যারা খেপাইতাছে সব ভীতুর ডিম। চিন ও ভীতু। দ্যাখ, বুড়া হো চি-মিন হাঁটুডুবা ধানের ক্ষেতে দাঁড়াইয়া এত মেন্নত কইর্যা ভিয়েতনামরে স্বাধীন করলো, এখন তাদের জমিতে চিন আর আমেরিকার প্রক্সি ওয়ার হইতাছে। যা শত্রু পরে পরে! হিম্মত থাকলে সামনাসামনি লড়াই করুক না। নেফায় লাদাখে খুঁচাখুঁচি করা এক আর নাপামবৃষ্টির সামনে দেশের লোকজনেরে আগাইয়া দেওয়া আর এক। মাও সে তুং ও ভীতু। আর তরা প্যাট ব্যাক্কল। ---কী ভীতু-ভীতু শুরু করেছ, গোলপোস্ট ঠিক কর। --- শোন, ভীতু লোকেরাই লোভী, কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী হয়। ভীতু লোকদের থেকে সতর্ক থাকবি, এরা তোষামুদে হয়। -----তুমি ভয় পাওনা? কোন ভয় নেই এমন কেউ আছে! --- ধ্যাৎ,কখনো ভয় পায় নাই এমুন হয় না। সবার চেয়ে বড় হইল মৃত্যুভয়। সবারই ভয়ের জায়গা আছে, রাজারও আছে, প্রজারও আছে। ছাগা যেমুন বাঘারে ডরায়, বাঘাও ছাগারে ডরায়। কিন্তু ভয় পাওয়া এক কথা আর ভীতু হওয়া এক কথা। --- মানে? -- মানে ভয় পাইলে তারে যুক্তি দিয়া বিচার কইর্যা সামনা করতে হইব। বুঝতে হইব বেশিডা কী আর হইব! মরতে হইব,এই ত? তার লেইগ্যা আইজ যদি চৌখ্যের সামনে মাইয়ামানুষের প্রতি অত্যাচার দেইখ্যা চুপ কইর্যা থাক,তা হইলে তুমি ভীতু। আরে, কাইল যদি সেই মাইয়া তুমার বইন হয়, বউ হয়, বেটি হয়! ----- অরা যদি সংখ্যায় বেশি হয়? ------- মেয়েদের বাঁচাইতে হইব, যেমনে পার, পলাইলে ওদের সঙ্গে নিয়া পলাইবা। না পারলে -- ---- হ, না পারলে কি করন? ------ না পারলে মরতে অইব, আর কোন বিকল্প নাই। (চলবে) ছত্তিশ্গড়ের কিসসা পর্ব-৪পুলিশ, ওরে পুলিশ!গৌরচন্দ্রিকাসাতসকালে রায়গড় স্টেশন থেকে মুম্বাই মেল চড়ে গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে সবে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছি, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।প্রথম পাতায় হেডলাইনঃ রানিবোদলি গ্রামে নকশাল আক্রমণে পঞ্চান্নজন পুলিশ নিহত।বস্তারের যে জায়গাটার কথা বলা হয়েছে বিশেষ বাহিনীতে ভর্তি হয়ে গত মাসে সেখানেই গেছে আমাদের নাটকের দলের সক্রিয় সদস্য অবিনাশ চোপড়ে।অবিনাশ হিন্দি সাহিত্যে এম এ পাশ করে একটি স্কুলে পড়াচ্ছিল। কোন মাসে মাইনে পেত, কোন মাসে হরিমটর।এর মধ্যে বিয়ে করল আমাদের দলেরই একটি মেয়েকে। মেয়েটি হাসপাতালের নার্স।তার কয়েক মাস পরেই স্ত্রীভাগ্যে ধনলাভ। জুটে গেল বিশেষ পুলিশ বাহিনীতে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি।নিহতদের তালিকায় নামগুলো আঁতিপাতি করে দেখি। তারপর একটা শ্বাস ছাড়ি। ততক্ষণে আড়মোড়া ভেঙে রেলের কামরা জেগে উঠেছে। চারদিকে উত্তেজিত কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে।: এ সরকার অপদার্থ, বস্তারকে মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ।:ছত্তিশগড়ের পান্তাভাতখেকো পুলিশ কোন কম্মের নয়।লড়াই না করে পালিয়ে গেছে।বিহার ইউপি থেকে শিক্ষিত বেকার ছেলেদের দলে দলে পুলিশে ভর্তি করে হাতে বন্দুক দিয়ে দেখুন, নকশালদের সোজা নকশালবাড়ি পাঠিয়ে দেবে।: মশাই, ট্রেনের কামরায় বসে এমন উড়ন ছুঁ কথাবার্তা বলা সহজ; যান তো দেখি অবুঝমাঢ় কি বাসাগুড়ায়!: ছত্তিশগড়ি পুলিশ ডরপোক? খালি পান্তাভাত খায় আর ঘুমোয়? হুঁ:!সেই ছকে বাঁধা কথাবার্তা; আমার একঘেয়ে লাগে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।আমার চেতনায় পুলিশ নির্মাণআরে আরে মারবি নাকি? দাঁড়া, একটা পুলিশ ডাকি!বাচ্চা রবীন্দ্রনাথকে ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ পুলিশ আসছে বলে ভয় দেখাতেন।পুলিশ মানে খাঁকি টুপি, বেল্ট, বুটজুতো! লাঠি, বন্দুক!বেশ, কিন্তু আমার ফোর্ট উইলিয়মে চাকরি করা ফৌজিবাবা?উনিও তো খাঁকি পরেন, বেল্ট বাঁধেন, বুটজুতো পরে খটখটিয়ে চলেন।তফাৎ কোথায়? মাকে জিজ্ঞেস করি।মার সরল সমাধানঃ পুলিশ নিজের দেশের লোককে মারে, মিলিটারি দেশের দুশমনকে। কাজেই মিলিটারি, মানে তোমার বাবা, ভাল। তাই মিলিটারি সম্মান পায়, পুলিশ পায় না।একটু বড় হয়ে কানে এলঃ পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশ বারো।অর্থাৎ পুলিশ শব্দটির সঙ্গে মারামারি ব্যাপারটা কেমন যেন জড়িয়ে রয়েছে।ময়দানে ফুটবল ম্যাচ নিয়মিত দেখতে যান, অথচ টিকিটের লাইনে ঘোড়সোয়ার পুলিশের তাড়া কিংবা ব্যাটনের গুঁতো খাননি এমন কেউ আছেন কি?কিন্তু দক্ষিণ কোলকাতার নাকতলায় লুঙ্গি পরে বাজার করা পুলিশ অনুকুলবাবুকে দেখে কোনদিনই ভয় পাইনি কেন?ষাটের দশকের শেষে বাংলাবন্ধের দিনগুলোতে খাঁকি হাফপ্যান্ট পরে শুকনো মুখে লাঠি ঘোরাতে দেখেও না।বরং নাদাপেটে অমন পোশাকে ওঁকে কমেডিয়ান জহর রায়ের মত লাগত।এল -সত্তরের দশক, মুক্তির দশক।কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে গলিতে, পুলিশ মরছে। মরছে আর মারছে, মারছে আর মরছে।তারপর?রক্তমাখা অস্ত্রহাতে যত রক্তআঁখি, শিশুপাঠ্য কাহিনিতে থাকে মুখ ঢাকি।শুনেছি, বিয়ের বাজারে জামাই হিসেবে পুলিশদের বাজারদর তখন বেশ পড়ে গিয়েছিল।ছত্তিশগড়ে এসে দেখি পুলিশজামাতা পেয়ে শ্বশুরের নাক বেশ উঁচু হচ্ছে। মাইনে যাই হোক উপরি টুপরি ভালই, মেয়ে সুখে থাকবে।উটের নুনু ঠিক কোনখানে?ট্রেনে করে আমরা কজন ভোপাল যাচ্ছি একটা ইন্টারভিউ দিতে। দুর্গ থেকে উঠলেন একজন পুলিশ অফিসার। কথায় কথায় বললেনঃ আজকাল যেসব ছেলেছোকরার দল নতুন নতুন গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হয়ে পুলিশের চাকরিতে আসছে এরা সব ভুষিমাল, কিস্যু জানে না।কত করে বোঝাই যে দিনকাল পাল্টেছে, হিসেব করে চল। পুরো মাইনেটাই ব্যাংকে জমা কর, আর এদিক সেদিক করে যা পাবে তাই দিয়ে সংসার চালাও। কিন্তু শোনে কে! এরা জানে শুধু ছুটি আর বদলির দরখাস্ত লিখতে। কোন্ও বাস্তববুদ্ধি নেই। জিজ্ঞেস করুন: উটের নুনু ঠিক কোনখানে? বলতে পারবে না।পশুর অ্যানাটমি নিয়ে অমন উচ্চস্তরের জ্ঞানলাভের কথা শোনাচ্ছিলাম কোরবা শহরের সদর থানা বা কোতোয়ালির থানেদার উত্তম সিং রনধাওয়াকে। উনি রবিশংকর ইউনিভার্সিটিতে আমার সিনিয়র ছিলেন।উত্তমজী হাসলেন না।গম্ভীর হয়ে বললেনঃ রায়, একটা কথা ভেবেছিস, আমরা পুলিশেরা কত একা? আমাদের সমাজ কেন এড়িয়ে চলে? সেদিন রকের আড্ডায় বসে হেসে গড়াচ্ছিলি। কিন্তু আমি গিয়ে যেই বললাম ক্যা চল রহা ভাই? হমে ভি বাতাও, আমি্ও তোমাদের সঙ্গে হেসে নিই; ব্যস্, তোদের মুখে কুলুপ এঁটে গেল। কেন? পুলিশের কি হাসি পেতে নেই?হোলির দিনের কথাই ধর। সবাই একে তাকে রং মাখাবে, কিন্তু পুলিশ বাদ। আমরা সেদিন ডিউটি দেব, শান্তিরক্ষা করব।আমাদের ছুটি পরের দিন।সেদিন পুলিশেরা খালি নিজেদের মধ্যে হোলি খেলবে।মানে, পুলিশেরা খালি খাঁকি বৌদিদের রং মাখাবে। কেন? আমাদের কি পাড়ার অন্য বৌদিদের রং মাখাতে ইচ্ছে করে না?আর দেখেছিস, হেড কোয়ার্টারে থাকলে আমাদের কোন ছুটি নেই!আমাকে যদি তোর মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে যেতে হয় তো রোজনামচায় তোদের পাড়ার কাছে কোথাও ইনস্পেকশনে বা ইনভেস্টিগেশনে যাচ্ছি দেখিয়ে রেজিস্টারে এন্ট্রি করে তবে যেতে পারব।আমাদের শালা রাতে ঘুম পেতে নেই। পরপর দুদিন না ঘুমোলেও কিছু হয় না!এসব তো সামান্য ব্যাপার। আমাদের বৌদের জন্যেই তোদের বাঙালী কবি লিখে গিয়েছেন: ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।এরপর কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেলে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বে মানবাধিকার কমিশন।ওদের হিসেবে চোরডাকাত, খুনি, টেররিস্ট সবারই হিউম্যান রাইটস্ আছে, নেই শুধু পুলিশের। আমরা তো হিউম্যান নই।ওরা শেখাবে: অপরাধিদের বাবাবাছা, আপনি আজ্ঞে করে কথা বলতে হবে।ওরা আমার মা বোন তুলে মুখখারাপ করলে্ আমাদের বাধ্য ছাত্রের মত সোনামুখ করে শুনতে হবে, ওদের পেঁদিয়ে বিন্দাবন দেখানো চলবে না।আমি বলিঃ আপনি দাদা হিউম্যান রাইটস্ এর ব্যাপারটা কিচ্ছু বোঝেন নি।তারপর ঝাড়ি একটা মাস্টারজি মার্কা লম্বা লেকচার। রাজা জন, ম্যাগনাকার্টা, রাষ্ট্রসংঘ, চার্টার অফ হিউম্যান রাইটস্ পেরিয়ে সোজা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে এসে দম নিই।রনধা্ওয়াজি আমাকে টেরচা চোখে দেখতে লাগলেন।আমার উৎসাহ কমে না। বলিঃ দোষ আপনার একার নয়, দোষ আপনাদের সিস্টেমের।ভাবটা হল যার একমাস পরে ফাঁসি হবে তার এখন থেকেই খাওয়া বন্ধ করে দাও।সরকারের খরচা বাঁচে।এখানেই মানবাধিকারের প্রশ্ন।আচ্ছা, আপনাকে দিয়েই শুরু করি। এই থানার লক আপে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা ব্যবস্থা আছে?: বিলকুল আছে; যা না, এগিয়ে গিয়ে দ্যাখ। দুধনাথ, রায়সাবকো ইঁহা কী ব্যবস্থা জরা দিখা দো।দুধনাথ বা থানার মুন্সীজির সঙ্গে ওঁর চোখে চোখে কিছু কথা হয়।ও আমাকে একটা লক আপের দিকে নিয়ে গিয়ে তালা খোলে।বলে, যান, দেখুন গে।চোখে পড়ে কোণের দিকে একটা গোটানো কম্বল আর একটা এলুমিনিয়ামের সানকি। কিন্তু বাথরুম পায়খানার ব্যবস্থা? কিছুই তো দেখছিনে!কানে আসে থানেদারের কণ্ঠস্বরঃ সবই আছে, আরেকটু এগিয়ে যা, ঠিক দেখতে পাবি।ভেতরে কোন বাল্ব নেই।তবু দু পা এগিয়ে যাই।এমন সময় পেছনে আওয়াজ, ঘড় ঘড় ঘড়াৎ।দুধনাথ লক আপের গেট বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। বলি: রনধাওয়াজি, এটা কি হচ্ছে? অ্যাই দুধনাথ, তালা খোল, এসব ইয়ার্কি ভাল লাগে না।দুধনাথ বোবা চোখে তাকায়, তালা খোলার কোন চেষ্টা করে না।থানেদার উবাচঃ এটা ইয়ার্কি কে বললে?আমার গলা শুকোতে থাকে, এর মানে? মামার বাড়ি নাকি!: মামার বাড়ি কি শ্বশুরবাড়ি ভাল করে বুঝবি যখন ভাবীজি এসে তোকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন।: আমার অপরাধ?: অপরাধ অনেক।এক, কোরবা বাজারের সব্জিওয়ালি জামুনবাঈকে যৌনসংসর্গের জন্য প্ররোচিত করা।দুই, উক্ত জামুনবাঈ অস্বীকূত হইলে তাহার সহিত জোরজবরদস্তি করা।তিন, প্রকাশ্য বাজারে তাহার গায়ে হাত তোলা।চার, উহার চিৎকার শুনিয়া বাজারে কর্তব্যরত পুলিশ সিপাহী দুধনাথ সিং শান্তিরক্ষা করিতে গেলে তাহাকে বাধা দেওয়া। পাঁচ, তাহাকে চপেটাঘাত করা। ছয়, তাহাকে মাতূগমনকারী নরাধম বলিয়া অভিহিত করা।দুধনাথ!এবার রায়জিকে এই ছয় অপরাধ পেনাল কোডের কোন কোন ধারায় দন্ডনীয় তা বুঝিয়ে দে।দুধনাথ বলির সময় পুরুতঠাকুরের মন্ত্র পড়ার মত কিছু অং বং চং বলে।আমার মাথা ঘুরতে থাকে, হাত পা কাঁপে। কাঁপা গলায় শেষ চেষ্টা করি।: এ সব ডাহা মিথ্যে। সব জানেন, শুধু শুধু ।: সত্যি মিথ্যে আদালত ঠিক করবে।:মানে? আপনি আমাকে কোর্টে তুলবেন!চালান পেশ করবেন?: আলবাৎ, আইন আইনের পথে চলবে।: প্রমাণ করতে পারবেন? তাছাড়া কে এই জামুনবাঈ? আমি চিনি না।আমি তো হাটবাজার করিনে, আমার স্ত্রী করে।কাজেই আপনার ওসব গুলপট্টি ওকে খাওয়াতে পারবেন না। ও আমাকে ভাল করে চেনে।: এগজ্যাক্টলি! বৌদি নিজে বাজার করেন। তাই তরকারিওয়ালি জামুনবাঈকে ভাল করে চেনেন।হার্ডকোর রেণ্ডি। আর ও হচ্ছে পুলিশের খবরি! গোপন খবর দেয়। মাসোহারা পায়। পুলিশের যেমনটি চাই তেমনই সাক্ষী দেবে।তারপর বৌদি তোকেও নতুন করে চিনবেন।চিন্তা করিসনে। যে কদিন জামিন না হয় তোর মানবাধিকারের হিসেবে সব সুবিধে পাবি।জামাকাপড়, টুথব্রাশ, খবরের কাগজ।বাড়ি থেকে খাবার আসবে। উকিলের সাথে কথা বলতে পারবি।আমার হাঁটু আর ভার সামলাতে পারে না, গরাদের ওপাশে মাটিতে বসে পড়ি।নিজের গলার স্বর চিনতে পারিনে।একটা ফ্যাঁসফেঁসে গলা বলেঃ আমায় ছেড়ে দিন, ঘাট হয়েছে।:দুধনাথ! লক আপের তালা খুলে দে। রায়কে বাইরে নিয়ে আয়। ও আর কোনদিন থানায় বসে মানবাধিকার নিয়ে লেকচার দেবে না।আরে! বেচারার হাত পা কাঁপছে।যা, ওকে মোটরবাইকে বসিয়ে বাসস্টপে ছেড়ে দে।দুধনাথ বলেঃ চলুন রায়জি, গাড়ি স্টার্ট করছি।________________________________________গিন্নি দেখি আরও এককাঠি সরেস। তৎক্ষণাৎ আলমারি খুলে একটা বাঁধানো খাতা বার করল, তাতে কোলাজের ঢংয়ে খবরের কাগজের নানান কাটিং আঠা দিয়ে সাঁটা।:পুলিশ কী পারে আর কী পারে না দেখে না্ও।না:, আমি হাল ছাড়িনি। পুলিশ সম্বন্ধে শেষ কথা বলার সময় এখন্ও আসে নি।মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন যে সংসদে একতূতীয়াংশ মহিলা হলে সেশন অনেক সংযত ও উন্নতমানের হবে।আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে ওখানে সনিয়া গান্ধী, রেণুকা চৌধুরি, সুষমা স্বরাজ, বূন্দা কারাতদের সংখ্যা বেড়ে গেলে অমুকভাইয়া বা তমুকউদ্দিনদের হাতের গুলি ফোলানো বা বিরোধীদের সংগে শকারবকার বিনিময়ে কিছুটা ভাটা পড়বে।মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।তাহলে পুলিশ কেন বাদ যায়?ইউরেকা! চাই পুলিশবাহিনীতে তেত্রিশ পার্সেন্ট মহিলা আরক্ষণ! তবেই পুলিশি বর্বরতা কমবে, পুলিশ আরও গণমুখী হবে।মার দিয়া কেল্লা! এই আইডিয়াটা লিখে পাঠাতে হবে।পাঠাবো দুজনকে, মাননীয়া কিরণ বেদী ও মাননীয়া মমতা ব্যানার্জীকে।কদিন পরে যেতে হল থানায়।রাতের অন্ধকারে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে। হামলাকারীরা পরিচিত। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক দলের চাপে পুলিশ ডায়েরি নিচ্ছে না। থানায় মুন্সীজি বললেন: দেখুন, আপনি যে ভাবে লিখে এনেছেন তাতে কেসটা উইক হয়ে যাবে।শব্দগুলো আর ঘটনার ক্রমপরম্পরা একটু বদলে নিলে এটাই অন্তত: হাজার চল্লিশের কেস, কী বুঝলেন? আর আপনি যেমন লিখে এনেছেন তাতে মাত্র দশহাজার, ক্যা সমঝে আপ?বলতে লজ্জা করছে, আমাদের এত বড় থানার স্টেশনারি খরচা বাবদ মাসিক বরাদ্দ মাত্র চল্লিশ টাকা! সেতো মাসের পহেলা হপ্তাতেই শেষ হয়ে যায়। এখন মাসের কুড়ি তারিখ। কাজেই কাগজ কার্বন পেপার ইত্যাদি কেনার জন্যে কিছু দিন, আর স্টাফদের জন্যে নাস্তা। তারপর দেখুন মজা!শালেলোগোকোঁ হাতকড়ি লগওয়াকে দোচার লাথমুক্কা লাগাতে হুয়ে ঘর সে খিঁচকর লায়েংগে। তব না উনকে ঘরওয়ালোঁ নে হাতকড়ি খুলওয়ানে কে লিয়ে অউর কুছ মালপানি দেঙ্গে?(ব্যাটাদের হাতকড়ি পরিয়ে ঠুঁসোলাথ মারতে মারতে ঘর থেকে টেনে আনা হবে, তবে তো ওদের ঘরের লোকজন কিছু মালপানি উপুড় করবে?) আমি পকেট থেকে দুটো নম্বরি নোট বের করে চা জলখাবারের নামে একজন সেপাইয়ের হাতে দিলাম।এমনসময় থানার ভেতরে শোনা গেল এক চাপা উল্লাসধ্বনি।তাকিয়ে দেখি একজন সেপাইয়ের পেছন পেছন সলজ্জমুখে ঢুকছেন দুই মহিলাপুলিশ।ভাবটা যেন দ্বিরাগমনের পর নতুন বৌ ছোটবোনকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরছে। তক্ষুণি চাওয়ালা এসে সবাইকে চায়ের গেলাস ধরিয়ে দিল।তারপর পাশের একটি কামরায় ছোটবোনপুলিশ একটু গড়িয়ে নিলে।আর পেছনের বারান্দায় জনতা স্টোভ জ্বেলে বৌপুলিশ সবার জন্যে খিচুড়ি চড়িয়ে দিল।আমি আলাপ জমাই।আপনারা কোন কেসের ব্যাপারে এসেছেন?: বড়সড় সিঁদেল চুরির কেস।কোরবা শহরে কেলো করে জবড়াপাড়ায় গা ঢাকা দিয়ে আছে।দলের লীডার একজন মেয়েছেলে, তাই আমরা এসেছি।: আপনার বেশ সাহস তো!:দূর! একা যাব নাকি?দুজন সেপাইয়ের মোটরবাইকের পেছনে বসে যাব।উনি শরীরে ঢেউ তুলে হাসলেন।মহিলাদের উপস্থিতি যে থানাকে একটু সভ্যভব্য করে তুলবে আমার এই বিশ্বাস দূঢ হল।বিকেলে হঠাৎ উদয় হলেন আমার কলেজ জীবনের দুই দোস্ত, বিজয় আর প্রসাদ।রাত্তিরে গিন্নির কূপায় খ্যাটন বেশ ভাল হল।মে মাস। গরমকাল।বেশ গরম হাওয়া দিচ্ছে, ঘুম আসছে না।তাই আমরা তিনবন্ধু রাস্তায় একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেরোলাম।পায়ে পায়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছি। রাত বারোটা, ফিরতে হবে।পাড়াটা একটু নির্জন,আলোগুলো প্রায় নিভে গেছে।হঠাৎ কেউ যেন কঁকিয়ে এল।কোথায়? কোনদিকে, নাকি মনের ভুল!এবার একটা আর্তনাদ, তারপর চাপা গোঙানি।কোথাও কোন ভুল নেই, আওয়াজটা আসছে সামনের কোতোয়ালি থানা থেকে।চারদিকের নিকষকালো অন্ধকারের মধ্যে প্রায় দেড়শো মিটার দূরের থানার আলোজ্বলা হলঘর টিভির পর্দার মত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুজন সেপাই একটা গেঁয়ো লোকের হাত টেনে ধরে রয়েছে আর একটা খেঁটে লাঠি দিয়ে তাকে মেরে পাটপাট করে দিচ্ছে সকালে আলাপ হওয়া সেই বৌপুলিশ!মারতে মারতে খুলে যাচ্ছে তার শাড়ি।হাঁফাতে হাঁফাতে কাপড়চোপড় সামলে নিয়ে জলটল খেয়ে আবার মার!না, মহিলা পুলিশমন্ত্রী ও শ্রীমতী কিরণ বেদীকে সেই চিঠি আজও পোষ্ট করা হয়ে ওঠেনি।ভয়ের রং খাঁকি!বর্ষশেষ।৩১ ডিসেম্বরের রাত।মোবাইল ও এসএমএস এর দৌলতে নিমন্ত্রণ পেয়ে গিন্নির ও বাচ্চাদের চোখ এড়িয়ে পৌঁছেচি আমার এক বন্ধু গজ্জুশেঠের হোটেলে।মধ্যরাতে নববর্ষ বরণ করতে হবে।জড়ো হয়েছি আমরা ক’জন্– কলেজজীবনের জনাদশেক বন্ধু।একটা হলঘরে মাটিতে গদি আঁটা বিছানা, তাকিয়া।সামনে প্লেটেসাজানো
ফিশফ্রাই,কাবাব,টিকিয়া ইত্যাদি পাকস্থলীকে বিরক্ত করার মত কিছু খাদ্যদ্রব্য।গেলাসে গেলাসে রঙিন জল।অদীক্ষিতদের জন্যে কোকস্।কিন্তু একি!একপাশে হাসিমুখে বসে জনাদুই খাঁকি পোশাক।কেন?এদের কে ভিসা দিয়েছে?আমার বাঁকা ভুরু দেখেই গজ্জুশেঠ সাফাই গাইল– ‘এরা দুজন আমার বিশেষ অতিথি’।আমি রাগ চাপতে পারলাম না।এখন এদের সামনে মেপে মেপে কথা বলতে হবে।খেয়াল রাখতে হবে আমিষ চুটকিগুলো পলিটিক্যালি কারেক্ট হচ্ছে কি না! কী চাপ!গজ্জু হেসে বলল–‘ শান্ত হয়ে বস দিকি!একটু পরে টের পাবি যে এঁরা লোকাল থানার কেউ ন’ন।বিলাসপুরেই বাড়ি, ছুটিতে এসেছেন।কাজেই বিশ্বাস করতে পারিস যে এঁরা আমার হোটেলে হপ্তা নিতে আসেননি।এসেছেন পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে’।লম্বাটে চেহারার তিওয়ারি বললেন– বুঝতে পারছি খাঁকি পোশাকে আপনার এলার্জি। বেশ, খুলে রাখলাম’। এই বলে তিনি গেঞ্জি গায়ে বসে পড়লেন।সবাই খেলার ক্রিকেট মাঠের ‘হাউজ দ্যাট’ এর মতন চেঁচিয়ে উঠল।চুটকি, পান–ভোজন, একে তাকে চিমটি কাটা–– এর মধ্যে কেউ গান ধরল।দু’পাত্তর চড়ানোর ফলে ওর গলা যেন ভুল স্পীডে চলা পঁচাত্তর আরপিএম এর গ্রামোফোন রেকর্ড।পাবলিক হেসে গড়াচ্ছে।কেউ বলছে গুলাম আলির গজল চাই তো কেউ বলছে সুফি শুনবো।এর মধ্যে দেখি গজ্জু ওই তিওয়ারির কানে কানে কী যেন গুজগুজ ফুসফুস করছে আর পুলিশ–তিওয়ারি নতুন কনেবৌটির মত সলজ্জ মাথা নাড়ছে।তারপর পাশের কামরা থেকে এসে গেল একটি হারমোনিয়াম। আর তাজ্জব কী বাৎ, গজব কী বাৎ, ওই বাদ্যযন্ত্রটি এসে নামল সোজা ওই পুলিশ ইনস্পেক্টরের সামনে!তাকিয়ে দেখি হারমোনিয়ামে হাত ছোঁয়াতে্ই ওর চেহারা বদলে গেছে।খানিকটা বেলো করে চাপা গলায় একটু আলাপ করে ধরল–‘তুম আপনি রঞ্জোগম, আপনি পরেশানি মুঝে দে দো।কুছ দিন কে লিয়ে ইয়ে নিগেবানি মুঝে দে দো’।আমরা ভুলে গেলাম গালগল্প। সুর চড়ছে।‘তোমার সব ব্যথার বোঝা, দু:খের ভার আমায় দাও’।গলা ছুঁয়ে যাচ্ছে তারার কোমলগান্ধার।‘ম্যায় দেখুঁ তো দুনিয়া তুমে ক্যায়সে সতাতী হ্যায়?কুছ দিনকে লিয়ে ইয়ে নিগেবানি মুঝে দে দো’।আমার বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে।‘দেখি তো তোমায় কে এত কষ্ট দেয়?ক’দিনের জন্যে তোমার সব ভার আমায় দাও’।কিসের এত কষ্ট?খাঁকি পোশাক তো দু:খ দেওয়ার জন্যে, পাওয়ার জন্যে তো নয়।সাতদিন পর সাতসকালে স্টেশন গেছি, কোলকাতা থেকে মা আসছেন।দেখি সেই তিওয়ারিজি।পরনে যথারীতি খাঁকি ধরাচূড়া। আমাকে দেখেও দেখলেন না প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কামরার জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে আদর করে যাচ্ছেন একটি ষোড়শীকে, আর কিমাশ্চর্য্যম!রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চলেছেন। কাঁধে চাপ পড়তেই দেখি গজ্জু শেঠ।বন্ধুর জন্যে নিয়ে এসেছে কিছু আপেল আর কমলালেবু।কী ব্যাপার রে? গজ্জু ইশারায় সরে আসতে বলে।তারপর ব্যাখ্যা করে:তিওয়ারির হয়েছে মাওবাদী বেল্টে ট্রান্সফার।অনেক ধরাধরি করেও আটকাতে পারেনি।এদিকে ওই একটি মেয়ে। ভিলাইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।বাপের সঙ্গে দেখা করে ফিরে যাচ্ছে।পরশুদিন । তি্ওয়ারি গিন্নি স্বামীর ললাটে তিলক লাগিয়ে ‘জয়যাত্রায় যাও গো’ বলে বস্তারের নারায়ণপুরের জন্যে টা–টা করবে আর প্রার্থনা করবে যেন জগদলপুরের দন্তেশ্বরীমাতা স্বামীকে ভালোয় ভালোয় বছরখানেকের মধ্যে বিলাসপুরে ফিরিয়ে দেন।আজকাল ছত্তিশগড়ে পুলিশের জীবনের কোন ভরসা নেই যে!আমি পুলিশকে আর ডরাইনে; তা সে ধরাচূড়া পরেই থাকুক বা না পরে।বুঝে গেছি যে খাঁকি হল পুলিশের সাপের খোলস, ওদের প্রোটেকশন।কিন্তু পুলিশ সামনে এলে মনে মনে প্রয়াত কবি তুষার রাযের দেওয়া মন্ত্রটি বিড়বিড় করি:‘পুলিশ!ওরে পুলিশ!কবির সামনে আসার আগে টুপিটা তোর খুলিস্’।============================*******====================================== ধারাবাহিক আড্ডাঘরের পুরনো ও নতুন ধারাবাহিক রচনাগুলো পড়ুন এখানে | লিখতে পারেন নিজেও| অচলায়তনের দেয়ালের ফোকর ও ভালবাসা ১২) নতুন নিয়ম হয়েছে। আমাদের হেডমাস্টার মশায় নিজের ছোটছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দোতলার দুটো ঘরে থাকবেন। ইউ -শেপের দোতলায় প্রায় পনেরটা ঘর। ওনার জন্যে ঘর ছেড়ে দেওয়া হল প্রথম সমকোণের ওপর ঘরটায়। আরে, ওর পাশ দিয়েই তো আমাদের ছোট ছাদে যাওয়ার জায়গা। তারমানে? --মানে খুব স্পষ্ট ; কোন শালা নতুন মহারাজদের কাছে গিয়ে দালালি করেছে যে ক্লাস টেনের ছেলেগুলো ওই ছোটছাদটিতে সিগ্রেট খাওয়া আর আড্ডা মারার ঠেক বানিয়েছে। আর গরমের দিনে ওরা খোলা ছাদে বিছানা করে ঘুমোয়! -- বেশ করি ঘুমোই, কার বাবার কি! একটা ঘরেও পাখার বন্দোবস্ত নেই, তো? গরমে সেদ্ধ হব? তারচেয়ে খোলা হাওয়ায় ছাদে শুলে কার কি ক্ষেতি? বরং ভোরের দিকে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে। --- বুঝলি না! এসব ওই ক্লাস এইটের বাঁদরগুলোর কাজ। ওরা সেবারের ঘটনার জন্যে আমাদের উপর খার পুষে রেখেছে। গুরু মুখ খোলে। -- ওদের পরে দেখে নেব। কিন্তু সবসময় নেগেটিভ ভাবিস কেন? খালি চুগলি আর ষড়যন্ত্রের ভূত! কারও আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। আসলে হেডস্যারের অসুখ সেরে গেছে, তাই। বিপ্লব আমাদের মত লোয়ার ক্লাসে হোস্টেলে আসেনি। ও জানে না। তাই বলে দিই। -- স্যারের হয়েছিল হাইড্রোসিল। অমন দোর্দন্ডপ্রতাপ লোক। শুধু ছাত্ররা নয়, কিছু স্যারও ভয় পেতেন। উনি কখনও হাসতেন না। 'বেরিয়ে যা শুয়ার'--ছিল ওনার বাঁধা বুলি। একবার ভুল করে একজন নতুন স্যারকে বলে ফেলেছিলেন, তিনি পরের দিন রিজাইন করেন। --উঃ প্রেসি কর। উনি দোতলায় কেন? -- আরে বলতে তো দে! তা অমন রাগী লোক হাইড্রোসিলে কাবু হলেন। সেইজন্যে ওঁকে একতলায় বাথরুমের পাশে একটি ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। তখন পায়খানায় জলের কল ছিল না। বাইরের চৌবাচ্চার থেকে ছোট একটা বালতি করে জল নিয়ে ঢুকতে হত। কিন্তু ওই ফোলা ধুতি নিয়ে পা ফাঁক করে হাঁটতে গিয়ে জল তোলা আর হয়ে উঠত না। তখন যে কোন বাচ্চাকে দেখলেই বলতেন --বৎস, আমায় এক বালতি জল এনে দাও তো! --- তোরা দিয়েছিস? '--সবাই । যে যখন সামনে পড়েছে আর কি। --তুই? -- একবার। ওই সামনে পড়ে গেছ্লাম। কিন্তু সেদিন ওই রাগী ভদ্রলোক অনুনয়ের গলায় বলেছিলেন--বাবা, একটু জল দিয়ে যাবে বাবা? বড় কষ্ট পাচ্ছি গো! সেই হেডস্যার এখন দোতলায় মানে উনি সেরে গেছেন। আর কাউকে জল টেনে দিতে হবে না। হঠাৎ গুরু চমকে ওঠে। --অ্যাই পোদো! শীগগির যা! নীচের বারান্দায় দেয়ালের গায়ে যে ম্যাগাজিনটা ঝুলছে ওটা নামিয়ে নিয়ে আয়। --কেন গুরু? --কেন কী রে ভোঁদাই? ওতে হেডস্যার নাম দিয়ে একটা কবিতা আছে না? স্যার দেখলে--! -- আরে গুরু! ভাল মনে করিয়েছ, ওটা পোদোর জিদেই ছাপা হয়েছিল। ওই খুলে আনুক। ছাপার কথাটা বাড়াবাড়ি। আসলে গত কয়েকমাস ধরে আমরা একটা হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করেছি--- নবীনসাথী। আমি সম্পাদক, কিন্তু তিনজনের কমিটি আছে। একেকবার একেক রঙের আর্ট পেপারে ক্লাস নাইনের সুব্রতর সুন্দর হাতের লেখায় ভরে দেওয়া হয়। এবারে ক্লাস ফোরে একটি বাচ্ছা ফ্রি-তে ভর্তি হয়েছে। ওর মা এই পাড়ায় কাজের মাসি। বাবা নেই। চকচকে চোখের বাচ্চাটা এবার ম্যাগাজিনের জন্যে একটা ছড়া লিখে জমা দিয়েছে। কবিতাটি পড়ে কমিটি খুব হাসল, কিন্তু ছাপতে চাইল না। আমি তখন সম্পাদকের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করে ছাপালাম। তর্ক দিয়েছিলাম-- ছন্দ ও অন্ত্যমিল নিখুঁত, সেন্স অফ হিউমার আর ছোট্ট বাচ্চাকে উৎসাহ দেওয়া। তাই বড় বড় অক্ষরে বেরোল এবং ছেলেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলঃ হেডশ্বর ========= আমাদের ইস্কুল দুই তিন তলা, টিফিনেতে খেতে দেয় পাউঁরুটি কলা। আমাদের হেডশ্বর এমে বিয়ে পাস, পড়া না পারলে মারে ঠাস ঠাস।। না, ওই দেয়ালপত্রিকা ঠিক সময়েই নামিয়ে আনা হয়েছিল। তারপর এক জরুরী মিটিং এ সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে সম্পাদকের পদ থেকে নামিয়ে শুধু কমিটি মেম্বার করে দেওয়া হল। নতুন সম্পাদক হবে প্রশান্ত। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা গেল। রাত্তিরে ওঁর ঘর ডিঙিয়ে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। সিগ্রেট খাওয়া তো দূর অস্ত্। উনি বর্ধমানের লোক। প্রতি শনিবার বা অন্ততঃ একবার বাদ দিয়ে পরের বার ট্রেন ধরে বাড়ি যান। সোমবারে দুপুরে ফিরে আসেন। ফলে আমাদের সেই দুদিন ১৫ ই আগস্ট আর ২৬ শে জানুয়ারী। ঘটা করেই পালন করা হয়। কিন্তু একদিন খবর ভুল ছিল। উনি বর্ধমান যান নি। শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় ঘরে শুয়ে ছিলেন। শুধু ওঁর ছেলে গেছল। সন্ধ্যের মুখে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার জুড়লেন। -- ও মহারাজ ! মহারাজ! ও সুনীল মহারাজ, এদিকে আসুন। সুনীলদা অবাক। ব্যস্তসমস্ত হয়ে একতলার থেকে দোতলায় এলেন। --কী হয়েছে মাস্টারমশাই? --আর বলবেন না। ক্লাস টেনের রমেনকে দেখি এমনি এমনি করে টেবিল বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছে-- আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে, আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে! এই বয়সেই যদি ওদের যৌবনজ্বালা জুড়িয়ে থাকে তা'লে পরে কী হবে গো! সেদিন আমরা ১৫ই আগস্টের বদলে ১৪ই আগস্ট দেখলাম। কিন্তু হেডস্যারের সঙ্গে ১৫ই অগাস্ট জুড়ে গেছে যে! কোথায়? আমার স্মৃতিতে। আমি তখনো প্রদ্যুম্ন থেকে পোদো হই নি। কচুরিপানায় ঢাকা পুকুরের ঘাটলায় শামুকপচা জলে থালাবাটি ধোয়া, কাপড় কাচা, আর স্নান করে করে হাত- পা খোস-পাঁচড়ায় ভরে যায় নি। ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া রোগা প্যাংলা ভীতু ছেলেটি তখনও মোটা ভাতের সঙ্গে আধসেদ্ধ ছরছরে ডাল, কারি পাউডারের ঝোল আর জলখাবারে ডালডা-চিনি-মুড়ি খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এমন সময় ঘনঘোর বর্ষার মধ্যে এসে গেল স্বাধীনতা দিবস। আশ্রমের আবহাওয়া বদলে গেল। চারদিকে সাজো সাজো রব। ১৪ অগাস্টের রাত্তির থেকে সবাইকে নিজেদের বিল্ডিং ছেড়ে ক্যাম্পে থাকতে হবে। সবাই নিজে নিজের বিছানা , দুদিনের মত জামাকাপড়, ডায়েরি, পেন সাবান, ব্রাশ ইতাদি নিয়ে চলে যাবে। ১৫ তারিখ ক্যাম্প ফায়ারের পর প্রাইজ দেওয়া হলে সবাই সে'রাত্তির ক্যাম্পে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে আবার পুরনো জীবনে ফিরে আসবে। প্রদ্যুম্ন দেখল এলাহি ব্যাপার। সমস্ত ছেলেগুলোকে আটটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ১৩ অগাস্ট ডাইনিং হলে তাদের নাম ও গ্রুপ ক্যাপ্টেনের নাম ঘোষণা করা হল। জানা গেল যে হাইস্কুল বিল্ডিং খালি করে ধুয়ে মুছে সেটাকে দু'দিনের জন্যে ক্যাম্প ঘোষণা করা হয়েছে। সামনের আঙিনা ঘিরে গেছে অস্থায়ী পোল ও তারের বেড়ায়। একটা গেট। সেই গেটে কাঠের রাইফেল নিয়ে পাহারা দেবে একজোড়া সেন্ট্রি। দু-দুঘন্টা মার্চ করে করে, বাই টার্ন, সব গ্রুপ থেকে। আর কাউকে ক্যাম্পে ঢুকতে হলে গেটপাস দেখাতে হবে--সেগুলো ক্যাপ্টেনরা জারি করবেন। গেটপাস দেখাতে না পারলে সুনীল মহারাজ , হেডস্যার কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না। আগের বছর একটি গ্রুপের জোড়া সেন্ট্রি, ক্লাস এইটের দুই ছোকরা, সুনীল মহারাজকে আটকে দিয়েছিল। উনি রেগে গিয়ে বরেনদাকে কম্প্লেন করায় জবাব পেলেন-- ওরা ওদের ডিউটি ঠিকমত করেছে।আর সেই গ্রুপটা এই পয়েন্টে বেশি নম্বর পেল। নম্বর অনেক কিছুতে, সেন্ট্রি দেওয়া , ঘর পরিষ্কার, কীর্তালি(কোন ভাষা?) --মানে আশ্রমের মাঠঘাট, পুকুর, নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, মার্চপাস্ট, ডাইরি লেখা, স্বাধীনতা দিবসের উপর রচনা, কবিতা লেখা, পাঁচ মিনিট এলোকুশন (মানে কী?), সন্ধ্যেয় ক্যাম্প ফায়ারের গান, নাটক ও ইম্প্রোভাইজড কোন স্কিট, মিমিক্রি --সবেতেই। আর সকালে জলখাবারে মগে করে গরম চা দেওয়া হবে, আর্মি স্টাইলে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে প্রীতি-ফুটবল--স্টাফ ভার্সাস স্টুডেন্ট্স। সন্ধ্যেয় অমূল্যদার ম্যাজিক লন্ঠন, অথবা কথা বলা পুতুলের কেরদানি! তারপর আমাদের ক্যাম্প ফায়ার। তাতে আবৃত্তি, মিমিক্রি, গান ও অভিনয়--সুকুমার রায় বা রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক/ব্যঙ্গকৌতুক থেকে--কী নেই? তা সেই আমার জীবনের প্রথম ক্যাম্পে হেডস্যার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মর্ম বোঝাতে গিয়ে বললেন-- মনে রেখ, আজ থেকে মাত্র ১৪ বছর আগে এই শহরে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। তোমাদের মধ্যে যাদের বয়েস ১৪ বছরের কম তারা নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও; পরাধীনতার অপমান তোমাদের ভুগতে হয় নি। এগার বছরের প্রদ্যুম্ন্ব ভাবল -- ইস্, মাত্তর ১৪ বছর আগে এখানে বৃটিশরা ছিল? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত? কী অন্যায় ! কী অন্যায়! ভগবানের একচোখোমি! ওকে যদি ভগবান আরও দুই দশক আগে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিত তো ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলত। সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ না হোক অন্ততঃ ১৪ বছরের ক্ষুদিরাম। কিন্তু কোথাও একটা হিসেবে ভুল হচ্ছে না? পাটিগণিতে কাঁচা শ্রীমান প্রদ্যুম্ন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারল না। ১৩) সম্পাদক পদ হইতে শ্রীমান প্রদ্যুম্নের অপসারণের পিছনে একটি গল্প আছে। এই গল্পের উৎস ওই শিশুসুলভ কবিতাটি, পোদোর সম্পাদকসুলভ আভিজাত্যবোধ ও ক্ষমতার অহংকার । এটাই কমিটির মিটিংয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। না, একটু ভুল হল। এব্যাপারে কমিটির সমর্থন ও সহানুভূতি আমার সঙ্গেই ছিল। আসল অভিযোগ হল আমি উপরোক্ত কারণের বশে , বিশেষতঃ ক্রোধ ও মাৎসর্য্য রিপুর দাস হইয়া ক্লাস এইটের বর্বর গুন্ডাপ্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে ,মারপিটে জড়াইয়া পড়িয়া উত্তমমধ্যম প্রাপ্ত হইয়া ক্লাস টেনের প্যাট্রিশিয়ানদের প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ঢালিয়া দিই। ফলে ক্লাস টেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিনিয়র ক্লাসের সমান রক্ষার্থে হা-রে -রে রবে ক্লাস এইটের সঙ্গে ক্লাস-ওয়ারে জড়াইয়া পড়ে। অগত্যা ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে সিজ-ফায়ার ঘোষণা হয়, কিন্তু ক্লাস এইট ও সেভেন আমাদের দেওয়াল পত্রিকায় কোন লেখা দিবে না ঘোষণা করায় সিনিয়রদের কূটনৈতিক ও রণনীতিগত লোকসান হয়। শেষে আমাকে না জানাইয়া গুরু ও তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ক্লাস এইটের নেতাদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালায়। উহারা সমস্ত ঘটনা ভুলিয়া শেক হ্যান্ড করিতে রাজি হয় ও ম্যাগাজিন বয়কটের সিদ্ধান্ত বাতিল করে-- কিন্তু শর্ত রাখে যে নষ্টের গোড়া শ্রীমান পোদোকে পত্রপাঠ সম্পাদকের পদ হইতে নামাইতে হইবে। ব্যাপারটা এই রকম। ক্লাস এইটের কতগুলো বখা ছেলের গ্রুপ ধীরে ধীরে আমাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠছিল। নাইনের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছিল, কয়েকজন ব্যক্তিগত বন্ধু হল। পড়াশুনো, লাইব্রেরির বই পড়া , নাটক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। ওরাও আমাদের মতই প্রথম ও ফিফথ পিরিয়ডে ব্যাক বেঞ্চে বসে ঘুমোত। স্যারেদের ও ডে-স্কলার ছেলেদের হাসির ও বিদ্রূপের খোরাক হত । আবার অ্যানুয়াল পরীক্ষায় মেরিট লিস্টে উপরের দিকে থাকত। কিন্তু ক্লাস এইটের ব্যাচটা একটা ব্যাচ বটে! এদের মধ্যে বেশ কজন আমাদের ও নাইনের ব্যাচের থেকে ফেল করে ভিড় জমিয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল, য্খন তখন কড়কড়ে নোট বের করে। এও সহ্য হচ্ছিল। জানা গেল এদের পালের গোদা দুজনের হরমোন অত্যধিক ক্ষরণের কারণে প্রায়ই বেশ কিছু বাচ্চা এদের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে এরা বেশ গর্বিত। এমনকি লুকোনোর চেষ্টাও করে না। আমদের পাঁচজনের টিম এদের ব্যুহ ভেদ করতে ব্যর্থ হল। যে তিনজন মুখ খুলতে রাজি হল তারা স্বামীজির সামনে গিয়ে বেঁকে বসল। মারের ভয়! পরে সেই মাফিয়ারাই ওই বাচ্চাদের নিয়ে মেজমহারাজের কাছে (প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ) নালিশ করাল যে ক্লাস টেনের আমরা ক'জন নাকি ওদের ভয় দেখিয়ে মিথ্যে অভিযোগ করাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বোধহয় আমাদের অন্য কোন ব্যক্তিগত ইস্যু আছে। মেজ মহারাজ চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজিতে আমাদের যা বললেন তা দুটো লাইনে বলা যায়ঃ ডক্টর, কিওর দাইসেল্প্ফ! অয়েল ইন ইয়োর ওন মেশিন! ওই ঘটনার পর থেকে ‘ওরা –আমরা’ সৃষ্টি হল; আমরা একে অপরের ক্লাস-এনিমি হয়ে গেলাম। এই অবস্থায় একদিন ওদের ক্লাসের দুজন বাচ্চামত ছেলে হাতে করে দুটো কবিতা নিয়ে আমাদের ঘরে এল। দেয়াল পত্রিকায় ছাপতে হবে। ওদের দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সেই দুটো বাচ্চা! যারা বয়ান বদলে আমাদের মুর্গী করেছিল! তবু বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে বসলে জাজমেন্ট দেওয়ার আগে পূর্বাগ্রহ মুক্ত থাকাই আদর্শ আচরণ বিধি। আমি ও বিপ্লব লেখাগুলো পড়তে লাগলাম। তারপর গম্ভীর মুখে বললাম-- এটা কী লিখেছ? --কবিতা। --কোথায় কবিতা? ও অবাক হয়ে মিনমিন করে বলল--কেন, পোদোদা? আপনার হাতেই তো ধরা রয়েছে। দেখুন না--বর্ষাকাল। পোদোদা! হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। গম্ভীর মুখে বললাম, - হুঁ, বর্ষাকালই বটে! বর্ষা আসিল, ডাকিয়া উঠিল আকাশের যত মেঘ? এটা কবিতা হয় নি, শুধু অন্ত্যমিল মিলিয়ে একটা গোদা বাহ্যিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটা ছাপা যাবে না। পরেরবার চেষ্টা কর। অন্য বাচ্চাটা করুণ মুকেহ বিপ্লবকে বলল --আমারটা তো ঠিক আছে? বিপ্লব খেঁকিয়ে উঠল। -- এটা? এটা তো ডাহা চুরি! গতবারের স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন থেকে টুকলি! বাচ্চাটার চোখে হতাশা ও আতংক। --না, টুকলি নয়। বিপ্লব উঠে গিয়ে ওর তাক হাতড়ে একটা বিস্কিট রঙের ম্যাগাজিন বের করে এনে দ্রুত হাতে পাতা ওল্টাতে লাগল। --পেয়েছি; এই যে! শোন্। " ৩২ নম্বর বাসের তলায় ব্যাঙ রাজার মৃত্যু" ---------------------------------------------- হৈ চৈ পড়ে গেছে সারা বরানগরে, ব্যাঙেদের মহারাজা মারা গেছে আহা রে! ------ । একেবারে কমা-সেমিকোলন পর্য্যন্ত টোকা। না, না; এসব চালাকি চলবে না। -- বিপ্লবদা , একটু দেখুন। দুটো এক নয়। ওটা হল ৩২ নম্বর বাসের তলায়, আর আমি লিখেচি--৩৪ নম্বর বাসের তলায়। বিপ্লব খ্যা -খ্যা করে হাসতে লাগল। -- ওরে একটু চুপ কর। ৩২ নম্বরকে ৩৪ নম্বর করে দিলেই কবিতা আলাদা হয়ে গেল? -- দেখুন, দুটো বাসই তো এসপ্ল্যানেড থেকে বরানগর যায়, তবে? আমার আর সহ্য হল না। উঠে ঠেলতে ঠেলতে বাচ্চাদুটোকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। বললাম--কবিতা লেখা? কবি? খালি ২ কে ৪ করে লিখলি তো হয়ে গেল? ইয়ার্কিরও একটা সীমা আছে। তোদের গোটা ক্লাসটাই এইরকম গবেট নাকি? দুটো দিন কেটে গেল। বিকেলে ফুটবল পেটাতে না গিয়ে ম্যাগাজিনের লেখাগুলোর ফাইল খুলে বসেছিলাম, আমি আর বিপ্লব। নরেশ আর সুদীপ এল। ক্লাস এইটের সেই মাফিয়া টাইপের ছেলে গুলো। সুদীপের একটু রোমশ চেহারা। এই বয়সেই গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে। ওকে দেখা মাত্র আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। শুনেছিলাম নতুন ছেলেদের পেছনে লাগার সময় ওর দুটো চ্যালা অনিচ্ছুক বাচ্চাটার হাত ধরে রাখে। আর গত পূজোর সময় ওর বাড়ির লোক নিয়ে যেতে এসেছিল। ও নাকি তখন ঘরের মধ্যে একটি ছেলের সঙ্গে রাসলীলায় মত্ত ছিল। বন্ধ ঘরের মধ্য থেকে বাড়ির লোককে বলে -- একটু অপেক্ষা কর। প্যাকিং করছি, জামাকাপড় বদলাচ্ছি--সময় লাগবে। ওরা ঢুকল, একটু পেছনে আগের সেই বাচ্চা দুটো। -- এই যে, এডিটর! এদের কবিতাগুলো রিজেক্ট করলে কেন? -- একটা কবিতা হয় নি, অন্যটা টুকে লেখা--তাই। --কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, কে ঠিক করবে? তুমি? --আলবাৎ; এটাই আমার কাজ। আমাদের পত্রিকার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। ---- বেশ, কোনটা তোমার কাছে কবিতা? ওই ফালতু " টিফিনেতে খেতে দেয় পাঁউরুটি-কলা"? নরেশ দোহার দেয়,-- ওই কবিতাটার টাইটেল আবার "হেডশ্বর"! গুরুজনদের স্যারেদের নিয়ে ইয়ার্কি করলেও ম্যাগাজিনের স্ট্যান্ডার্ড থাকে, তাই না পোদো? বিপ্লব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে-- অ্যাই, নরেশ! মুখ সামলে। তোর দু'বছরের সিনিয়র, প্রদ্যুম্নদা বলবি। ওরা হেসে উঠল। তারপর বলল,-- দু'বছর আগে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম, তখন থেকেই ও আমাদের পোদো। কী রে , ঠিক বলেছি না? আমি কোন কথা বলি না। সুদীপ আবার বলে-- তাহলে আমাদের ক্লাসের দুটো কবিতা রিজেক্ট করছ? আমি ওদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাচ্চাদুটোকে দেখি--উকিল ধরে এনেছিস? লাভ হবে না। ঘরে ফিরে যা। ওরা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সুদীপদের বলি--শোন, ক্লাস -টাস নয়। একটু ভাল কবিতা নিয়ে এস, নিয়ে নেব। ওরা চোখে চোখে কথা বলে। তারপর সুদীপ বলে-- আধুনিক কবিতা চলবে? গদ্য কবিতা? --হ্যাঁ হ্যাঁ। নিয়ে এস। --অ্যাই নরেশ, তোর সেই আধুনিক কবিতাটা দেখা তো আমাদের সম্পাদককে, স্ট্যান্ডার্ডটা দেখে নিক। নরেশ ভালমানুষের মত মুখ করে একটা চোথা কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়। আমি ভাঁজ খুলে হতভম্ব , এটা কী? --কেন , আধুনিক কবিতা। আমার মুখের ভাব দেখে বিপ্লব কাগজটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে চোখ বোলায়, তারপর হা-হা করে হেসে ওঠে আমাকে ফেরৎ দেয়। কাগজটায় কয়েকটি রেলস্টেশনের নাম একটি বিশেষ অর্ডারে লেখা রয়েছে। " টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া--যাদবপুর। গড়িয়া-সোনারপুর, বজবজ-বজবজ।" আমি কিছু বলার আগে বিপ্লব হাসতে হাসতেই বলে-- সরি ! এইসব অশ্লীল লেখা ছাপতে পারব না। অশ্লীল লেখা! ওরা আকাশ থেকে পড়ে। -- ওতে কোন শব্দটা অশ্লীল? নাকি দু'ক্লাস উঁচুতে পড়েন বলে যা খুশি কমেন্ট করবেন? আমি রাগের চোটে কাগজটা নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়তে থাকি। ওরা হাঁ-হাঁ করে ওঠে। --এটা কী হল সম্পাদক মশাই? আপনার লেখা রিজেক্ট করার রাইট আছে; কিন্তু ছিঁড়ে ফেলা? --- পছন্দ না হয় ফেরৎ দিয়ে দে। ছিঁড়লি কী করে? --বেশ করব, এই সব অশ্লীল ইয়ার্কি আমার সঙ্গে নয়, অন্য কোথাও মারাবি! ওরা কাগজটা কেড়ে নেবার চেষ্টায় আমার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম চড় বোধহয় আমিই মেরেছিলাম। কিন্তু ওরা তৈরি হয়েই এসেছিল। আমি বা বিপ্লব কেউই মারামারিতে অভ্যস্ত নই, একটু লালুটাইপ। ফলে দুজনেই বেশ মার খেলাম। আমার বরাদ্দে একটু বেশি জুটল। তারপর ক্লাস-স্ট্রাগল, সিজফায়ার ইত্যাদি। ওরা চ্যালেঞ্জ করে মহারাজকে বলল-- আমি ব্যক্তিগত কারণে ওদের গ্রুপের কারও কবিতা ছাপতে চাই না। তাই ওদের একটি ভাল আধুনিক কবিতাও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। আমরা বললাল--যা তা অশ্লীল লেখা! --ওরা বলল বাজে কথা, পোদো কাগজটা দেখাক। কী করে দেখাব, ছিঁড়ে ফেলেছি যে! হেডস্যারকে দিয়ে তদন্ত করানো হল। উনি বললেন--প্রদ্যুম্ন, কাগজ নেই তো কি হয়েছে, তুমি মুখে বল বা লিখে দাও যে ওরা কী অশ্লীল শব্দ লিখেছে--মেনে নেব। ওরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আমার কাছ থেকে শুনে হেডস্যার সন্দিগ্ধ মুখে মাথা নাড়তে লাগলেন। এ তো ক'টা রেলস্টেশনের নাম-- অশ্লীল কোথায়? আমার মুখে বাক্যি নেই। আমার অভিযোগ খারিজ হয়ে গেল, বন্ধুরা বলল আমার বোকামি আর গোঁয়ার্তুমি আমাদের গোটা ব্যাচের হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিল। সেই থেকে আমরা ও ক্লাস এইটের ব্যাচ আশ্রমের বাকি জীবনে তীব্র জীবনমরণের শ্রেণীসংগ্রামে বৃত হইলাম। (চলবে) আশিয়ানা ঢুন্ডতা হ্যায়!! ১০ বিয়ের রাতে কত কি যে সব হল| কত নিয়ম-কানুন| কিছু নিজের চোখে দেখলাম আর কিছু দাদাদের কাছ থেকে জানলাম| আসলে কি করব! বিয়ে দেখতে বসলে খাওয়ার ওখানে কি চলছে সেটা দেখা হচ্ছে না আবার খাওয়ার ওখানে থাকলে বিয়ে দেখা হচ্ছে না| বিয়ে শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল| শেষ দিকটায় বড়রাই দিদি-জামাইবাবুর সাথে ছিল| আমরা ছোটরা শুতে চলে গেলাম| আর চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না‚ চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল| আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম| শুয়ে শুয়েই আমার জেঠুর আর বাবার সব কথা মনে পড়ে গেল| মা কি সত্যি সত্যি বাবার সাথে চলে যাবে? নাহ‚ মা আমাকে একলা ফেলে নিশ্চয় যাবে না‚ যেতেই পারে না| কিছু মাস পরেই তো ফাইনাল এক্সাম| মা ‚ না পড়ালে তো লাড্ডু পাব| এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি|এদিকে একটা ব্যাপার আমার একদম ভালো লাগছে না‚ শুনলাম দিদির নাম পালটে যাবে| দিদি যেমন এখন শ্রেয়শী সেন আছে বিয়ের পর দিদি শ্রেয়শী দাশগুপ্ত হয়ে যাবে| কেন হবে? নামটা পালটে গেলে কি আমার দিদি আর আমার দিদি থাকবে না আর? তা কি করে হয়? আমি বিয়ে করলে ‚ আমার বৌকে একদম নাম বদলাতে দেব না| যা নাম আগে ছিল‚ বিয়ের পর সেই নামই থাকবে| ভাবছি আগের থেকেই মা-বাবাকে বলে দেব| বিয়ে তো করতেই হবে‚ কত যে গিফট পাওয়া যায়‚ উফ একটা ঘর তো পুরো ভরে গেছে গিফটে| কোনটাই খোলা হয়নি‚ দিদি বলল‚ আবার যখন আসবে তখন আমার সাথে বসে এগুলো খুলবে| বেশ মজা হবে‚ আমরা প্যাকেট না খুলেই গেস করব প্যাকেটের মধ্যে কি আছে‚ যে জিতবে তার পয়েন্ট|সকাল থেকেই দিদি‚ জামাইবাবু আর জামাইবাবুর বাড়ির লোকেরা রেডি হয়ে গেছে বেরোবার জন্য| সবাই বলল‚ এখান থেকে বরযাত্রীরা বেলা এগারোটার মধ্যে বেড়িয়ে যাবে| ওঁনাদের গুরুজী বলেছেন‚ বেলা একটার মধ্যে বর-কনেকে বাড়িতে ঢুকে যেতে হবে| না হলে তারপর আর আর বাড়িতে ঢুকতে পারবে না| এই নিয়ে বাড়িতে সবাই আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করেছে‚ যাতে বরযাত্রীদের কেউ শুনতে না পায়| দিদির বিদাইয়ের সব নিয়ম-কানুন চলছে| আমরা বসে আছি দিদি কখন কাঁদা শুরু করবে বলে| বাবলুদা বলল‚ - দেখিস‚ ঠিক আর্শীবাদের সময় কাঁদবে|- মনে হয় না‚ খোকনদা বিঞ্জভাবে বলল|আমারও কেন জানি মনে হচ্ছিল‚ দিদি কাঁদবে না| আমি জানি তো দিদির কান্না শুরুর আগের লক্ষণগুলো| আগে পাঁচবার গুনে গুনে নাক টানবে| তারপর তিনবার আলতো করে হাঁচি| এগুলোর কোনটাই এখনো হয়নি‚ তার মানে চান্স নেই‚ পক্কা|- এই শ্রী একটু কাঁদ| লোকে কি বলবে? মনে হয় ছোটমা আস্তে করে দিদির কানে কানে বলল| আমি শুনতে পেলাম|- কেন কাঁদবো ? দিদি বেশ জোরেই বলে ফেলল|ছোটমা দিদির এই কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বড়মার পিছনে চলে এল|- আমি কাঁদব কেন? ও তো কাঁদছে না| বলে দিদি ইশারা করে জামাইবাবুকে দেখালো| সবাই দিদির কথায় হেসে উঠল| বড়মা অবশ্য অনেকক্ষণ থেকেই ফোঁপাচ্ছিল| কিন্তু দিদির বকা খেয়ে এখন চুপ করে গেছে| আস্তে করে বলল‚ কাঁদবে কেন? দজ্জাল মেয়ে কি আর সাধে বলি? দেখলাম জামাইবাবুও হেসে ফেলেছে বড়মার কথা শুনে |একটু পরে আশীর্বাদ সারা হলে দিদি শ্বশুরবাড়ি চলে গেল| বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগছে| বাইরে পার্কে গিয়ে দেখলাম পন্ডাল খোলা হচ্ছে| চারিদিকে কেমন যেন একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে| কিসের গন্ধ জানি না| বাসি ফুল‚ বাসি খাবার সব মিলিয়ে একটা গন্ধ মনে হল| তবে গন্ধটা যে মনখারাপ করে দেবার সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে| কথা না বলে কোথাও চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে| কিছুই ভালো লাগছে না| আজ অনেকেই চলে যাবে‚ শুধু পিসিরা থাকছে| আর বাকি কয়েকজন মানে‚ মামারা‚ দাদারা কাল বিকেলের গাড়িতেই কলকাতা চলে যাবে|বিকেল হতে হতে বাড়ি একদম খালি হয়ে গেল| বাড়ি খালি হতেই বোঝা গেল বাড়ির হালত একদম বিগড়ে গেছে| চারিদিক আগোছালো হয়ে আছে| বাবা‚ জেঠু‚ ছোটকা বসার ঘরে টেন্টওয়ালা আর কাদের কাদের যেন টাকা মেটাচ্ছে| সাথে সব কাজের লোককেই জাম-কাপড় দিচ্ছে| আমি জেঠুর পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরেই এইসব দেখছি| মাথাটা কিরকম খালি খালি লাগছে| এবার মনে পড়ল ‚ আরে মায়ের তো বাবার সাথে চলে যাবার কথা| মাকে নিয়ে বাবা চলে যাবে নাকি মা এখানেই থাকবে এসব নিয়ে আলোচনা করতেই তো বাবা জেঠুর সাথে মিনা অঙ্কলের বাড়ি গেছিল| কি হল? দৌড়ে ঘরে গিয়ে দেখি মা খাটের ওপর হাতের ওপর হাত রেখে চুপ করে বসে আছে| আমি যে ঘরে ঢুকলাম মা বুঝতেই পারল না|- মা কি করছ? বলে আমি মায়ের গা ঘেঁষে বসে পড়লাম|- হুম এতক্ষণে মায়ের কথা মনে পড়ল তাই না? মা আলতো করে পিঠে চাপড় মেরে বলল|- কি করব? কত কাজ ছিল না আমার! এখন তো চান্স পেলাম|- ওহহ‚ আমার বুড়ো ..- ছাড় না মা‚ আচ্ছা বলো না‚ তুমি কি সত্যি বাবার সাথে যাচ্ছো?- হ্যাঁ রে যাচ্ছিই তো| মিনা ভাইসাবও তাই বলেছেন| কি যে হবে জানি না| তোমার বাবা কি ফ্রি হয়েছে নিচে? একটু ডেকে নিয়ে এসো তো| তারপর তোমাকে বলছি সব|আমি দৌড়ে নিচে গেলাম| ওখানে তখন সব কাজ হয়ে গিয়েছে| বাড়ির বাকি সবাই ঘরেই বসে আছে| কি যেন কথা নিজেদের মধ্যে চলছে| আমি ঘরে ঢুকতেই জেঠু বলল‚ - যাও তো বেটা একবার মাকে নিচে ডেকে নিয়ে এসো তো|আমি কোন কথা না বলে নিজের বাইকটা আবার ঘুরিয়ে নিলাম ওপরের ঘরে যাওয়ার জন্য| এই বাইকটা আমি মনে মনে চালাই| এটা চালালে আমি দেখেছি সিঁড়ি দিয়ে উপর-নিচ করতে আমার অসুবিধা হয় না| তাড়া থাকলেই আমি বাইকটা ব্যবহার করি|- মা তোমাকে নিচে ডাকছে| সবাই বসে আছে| বলেই আমি আবার টার্ণ নিলাম‚ সোজা নিচে‚ জেঠুর পাশে গিয়ে বাইকটা পার্ক করে দিলাম|- এখানে সবাই এখন আছে‚ তাই সবারই জানা দরকার ব্যাপারটা| বলে জেঠু শুরু করল| সংক্ষেপে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে‚ যা যা কথা হয়েছে সেইসব জেঠু সবাইকে জানালো| সেই সঙ্গে মা'কে যে বাবার সাথে চলে যেতে হবে সেটাও জানালো|- আজ আমি আর জগু মিনার কাছে গেছিলাম| মিনাও মনে করে আপাততঃ কুনুকে‚ জগুর সাথে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো| অন্তত পরিস্থিতি যতদিন না আয়ত্তে আসছে ততদিন কুনুর এখানে থাকা নিরাপদ নয়| অন্য স্টেট হলে এই ধরে নিয়ে যাওয়া বা জেলে পুরে দেওয়ার ব্যাপারটা এড়ানো যাবে| কারণ এটা তো কোনো ক্রিমিনাল কেস নয় যে অন্য স্টেটের পুলিশ হেল্প করবে| পরে সব ঠিক হয়ে গেলে না হয়‚ কুনু এখানে চলে আসবে| তবে একটাই চিন্তা কবে সব ঠিক হবে?বড়মা তো কেঁদেই ফেলল|- এ সব আবার কি শুরু হল এই বাড়িতে? সব তো ঠিকই ছিল‚ কার নজর লাগল কে জানে?- তুমি চুপ করবে একটু!! জেঠু ধমকে উঠল|- আমি তো চুপই থাকি| আমার কথা কে আর শোনে? ইত্যাদি ইত্যাদি বড়মা বলেই চলল|কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে বাবা বলল‚- বৌদি তেমন কিছুই হয়নি‚ তুমি ঘাবড়ে যেও না তো| সব ঠিক হয়ে যাবে| এবার শোন যা বলছি‚ যে কাল সকালের কালকা মেলে আমি কুনুকে নিয়ে যাচ্ছি| ওখানে আমরা রাতেই পৌঁছে যাব| এখন যেটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার সেটা হল গোরাকে নিয়ে| গোরা বেটা‚ তুমি জেঠু-বড়মা‚ ছোটকা-ছোটমা'র সাথে থাকতে পারবে তো? কি বল আমার ব্রেভ বয়? - হ্যাঁ পারব তো| মা'কে নিয়ে যাও| আমি একদম ঠিক থাকব| মুখে বললাম বটে কিন্তু মন তো ঠিক মানছে না! মা'কে ছেড়ে তো কখনও থাকিনি| কিন্তু এখন যখন বাড়িতে অসুবিধা আছে তখন তো মা'কে ছেড়ে থাকতেই হবে| কাল ছোটকার সাথে বসে মন দিয়ে একবার হনুমান চালিশা পড়ে নেব| মনে সাহস আসবে তা হলে| ঘরের মধ্যে তখনও কথা হচ্ছে‚ কিন্তু কারও কথাই আমার কানে আর আসছে না| একটা মিলাজুলা ভাষা কানে আসছে শুধু যেটার কোন মানেই ধরতে পারছি না| আমি বরং বাইরে যাই‚ এখানে আর ভালো লাগছে না| বাইরে এসে দাঁড়াতেই টের পেলাম আকাশে অনেক মেঘ করেছে| বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে ঘন ঘন| চুপচাপ একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম| বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে| একটু পরেই বৃষ্টি নামবে‚ এখন ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে| কি আরাম! নিজের থেকেই বারান্দা থেকে নেমে আস্তে আস্তে সামনের পার্কে চলে এলাম| পার্কের কোনায় সিমেন্ট দিয়ে একটা ছাতা মত বানানো আছে আর তার নিচে সিমেন্টের গোল করে বাঁধান চাতাল| এটাও আমার খুব প্রিয় জায়গা| ধুলো জমে আছে অনেক‚ জোরে ফুঁ দিয়ে ধুলো সরিয়ে বসে পড়লাম| টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল| খুব মশা এখানে‚ মা জানলে খুব বকবে| ওখান থেকেই দেখলাম সবাই এখনো কথা বলে যাচ্ছে| আকাশের দিকে আবার দেখতে লাগলাম| হঠাৎ কাঁধে কার একটা হাত‚ পিছন ফিরে দেখি প্রিতি|- তু য়ঁহা? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম|- হ্যাঁ তো‚ মম্মি উপর থেকে দেখল‚ তুই এখানে বসে আছিস| ঝড় - বৃষ্টি আসছে| আমকে বলল তোকে ডেকে নিয়ে আসতে‚ তাই এলাম| চল বাড়িতে| আমার হাত ধরে বলল|- না রে ‚ বাড়িতে ভালো লাগছিল না‚ তাই এখানে এসে বসেছি| তুইও বস না| - দাঁড়া মম্মিকে বলে আসছি| বলে দৌড়ে পার্কের বাইরে চলে গেল আর রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে বলে দিল| তারপর ফিরে এসে আমার পাশে বসল|ততক্ষণে বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হয়ে গেছে| ও আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল‚ - কি হয়েছে রে তোর? দিদির জন্য মনখারাপ লাগছে?- একটু তো লাগছে‚ তবে বেশি মনখারাপ লাগছে মায়ের জন্য| তুই জানিস‚ মা না বাবার সাথে চলে যাচ্ছে‚ যেখানে বাবা থাকে|- কিঁউ? ও তো অবাক| নিশ্চয় ঘুরতে যাচ্ছে| আবার চলে আসবে| - হয়ত তাই! জানিনা‚ আমার কিছু ঠিক লাগছে না| মনে হচ্ছে কুছ হোনেওয়ালা হ্যায়| প্রিতি আমার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরল|- তু য়ে সব কিঁউ শোচ রহা হ্যায়? তোর হালত দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু ঘটেছে| বল না আমায় কি হয়েছে?এই কদিনে আমি অনুভব করেছি প্রিতি আমার অনেক কাছের হয়ে গেছে| ও‚ মা যেভাবে আমাকে নজরে রাখে ও ঠিক সেইভাবেই আমার সব কিছু নোটিশ করে| মনে হয় একে সব বলতে পারা যাবে|- এক প্রমিস কর‚ কাউকে বলবি না|- পক্কা‚ তেরি কসম| কাউকে বলব না|আমি যতটা জানি‚ যতটা বুঝেছি ওকে সবই বললাম| আমি তো আমার অভ্যাসমত মাথা নিচু করে সব বলে যাচ্ছিলাম| তাই খেয়ালই করিনি‚ ও কখন উঠে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে| আমার কথা শেষ হতেই ও আমার দুটো গাল ওর ছোট দুহাতের মধ্যে ধরে ঠিক মায়ের মত| - তু ইতনা পরেশান থা!! আমাকে আগে বলিস নি কেন বচ্চু?আমি কিছু বললাম না‚ চুপ করেই থাকলাম| কি আর বলব? একটাই চিন্তা হচ্ছে আরও কি হতে পারে|- গোরা বাড়ি এসো| বৃষ্টিতে বেশি ভিজো না| প্রিতি আজা বেটা| মা জানালা থেকেই আমাদের ডাক দিল|- আই অ্যান্টি| চল অন্দর চলতে হ্যায়|আমরা দৌড়ে পার্কের গেট পেরিয়ে বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়লাম| কিন্তু বৃষ্টির ছাঁট থেকে খুব বেশি বাঁচা গেল না| মা একটা টাওয়েল নিয়ে এসে আমার আর প্রিতির মাথা মুছে দিল যত্ন করে|- ভেতরে চল| তোমাদের গরম দুধ দিচ্ছি আর সাথে পকোড়াও আছে|দুধের নাম শুনেই প্রিতি উলটা পা!- অ্যান্টি মুঝে ঘর যানা হ্যয়| মা চিন্তা করবে না হলে| বলেই একলাফে বারান্দা পেরিয়ে রাস্তায়| প্রিতি একদম দুধ খেতে চায় না| এই নিয়ে রোজ স্কুলে যাবার সময় ওর সাথে ওর মায়ের লড়াই রাস্তা থেকেই শোনা যায়|ঘরে সবাই বসে আছে‚ কিন্তু কিরকম একটা থমথমে আবহাওয়া| কেউ কেউ দু-একটা কথা বলছে বটে‚ কিন্তু অন্যান্য দিন যেটা হয় হইচই ‚ সেই ব্যাপারটা একদমই নেই|- আমার মতে কিন্তু গোরারও যাওয়া উচিত| হঠাৎ করেও ছোটকা ঘরের মধ্যে যেন একটা বোমা ফেলল|- কেন রে? সবাই প্রায় একসাথেই বলে উঠল|- না মানে বলছি‚ ছোটকা আমতা আমতা করে বলল|- না‚ তুই কিছু একটা ভেবেই বলছিস নিশ্চয়| জেঠু উত্তেজিত হয় উঠল আবার| কি ভেবে কথাটা বললি বল?ছোটকা সবার ছোট বলেই জেঠু ঐভাবেই ছোটকার সাথে কথা বলে| খুব ভালো মানুষ ছোটকা| কথা কম বলে‚ কোন বিষয়ে তর্কেও যায় না| এবারেও জবাব দিল না|আমার এবার অবাক হবার পালা| মা চলে যাবে শুনে মনটা খারাপ ঠিকই কিন্তু তাই বলে আমি একবারও মায়ের সাথে চলে যাব ভাবিনি| আমি এখান থেকে চলে যাব? সেটা কি আদৌ সম্ভব? আমি তো এখানেই থাকব সবার সাথে‚ জেঠু‚ বড়মা‚ ছোটকা‚ ছোটমা'র সাথে| হ্যাঁ মাঝখান থেকে মা থাকবে না‚ সেটাই একটা খারাপ লাগা| কিন্তু মা নিশ্চয় কিছুদিন বাদেই ফিরে আসবে|- মা তো ফিরেই আসবে‚ তাহলে আমি যাব কেন? এতক্ষণ চুপ ছিলাম| কথাটা মনে হয় বেশ জোরেই বলে ফেলেছি|ঘরের ভিতর সবাই চমকে উঠল|- আমার কাছে আয় সোনা| বলে বড়মা আমাকে নিজের কাছে টেনে নিল| কে বলেছে তুমি যাবে? তুমি তো আমার সোনা বেটা‚ তুমি যাবে না‚ এই আমি বলে দিলাম| বড়মা আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল|কিন্তু সবাই চুপ কেন? কেউ কেন বলল না যে আমাকে যেতে হবে না| আমি বড়মার কাছ থেকে সরে মায়ের কাছে গেলাম|- মা আমার খুব ঘুম পেয়েছে| খেতে দিয়ে দাও আমায়| কাল স্কুল আছে না?- সে কি এই তো কতগুলো পকোড়া খেলে| এখনি কি তুমি খেতে পারবে? আচ্ছা চল তুমি খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়| আমি একটু পরে আসছি| মা সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলল|- না না‚ তুই এখানে থাক কুনু‚ আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে| তুই বরং এখানে কথা শেষ করে ওপরে গিয়ে গোছগাছ সেরে নে| কাল অনেক ভোরে তোদের ট্রেন| বলেই বড়মা তাড়াতাড়ি করে আমাকে খাওয়ার জায়গায় নিয়ে গেল| আমার তো খুব একটা খাবার ইচ্ছা ছিল না| আর ঘুম পাওয়াটাও একটা বাহানা| যাতে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া নিয়ে কোন কথা না হয় তাই তো এমনটা করলাম আমি| কোনরকমে একটু খেলাম| বড়মা সামনে বসে আমাকে খাওয়াচ্ছে আর নিজের মনেই বকে যাচ্ছে|- কি যে হল এই বাড়িতে‚ কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে না| সাজানো-গোছানো সংসারে যেন আগুন লেগে গেছে| নিশ্চয় কারও নজর লেগেছে| একবার কমল পুরুতকে ডেকে বাড়িতে একটা শান্তি পা করাতে হবে| তাও ভালো মেয়েটার ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেল| এই বাপ-বেটার চক্করে পড়ে জীবনটা আমার কালি হয়ে গেল| আমিও চলে যাবে মেজো ঠাকুরপোর সাথে| তখন বুঝবে আমার দাম‚ ইত্যাদি কত কিছু বড়মা বলেই চলেছে আর মাঝে মাঝেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে|- বড়মা তুমি চিন্তা করো না| আমি আর একটু বড় হয় যাই‚ তারপর তোমাকে আমার কাছেই রাখবো| বললাম তো‚ কিন্তু আমি নিজেই কোথায় থাকব তারই তো ঠিক নেই| বড়মা আমার মাথায় হাত রেখে হাঁউ হাঁউ করে কেঁদে উঠল| এই সেরেছে‚ আমি কি কিছু ভুল বললাম? একটু পরেই বড়মা কাঁদা বন্ধ করতে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম|- যাও বাবা হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়| অনেক সকালে উঠতে হবে| কাল সকালে মায়ের ট্রেন ধরা আছে না? আবার তোমার স্কুলও আছে| স্কুল ড্রেস আমি বার করে রেখেছি| তুমি শুধু ব্যাগটা গুছিয়ে নিও|-হ্যাঁ হ্যাঁ বড়মা‚ এই যাচ্ছি বলে‚ উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলাম| বৃষ্টি থেমে গেছে‚ কিন্তু বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে বাইরে| জানালাটা খুলে দিতেই হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া এসে ঘরটা ভরিয়ে দিল| বিছানায় শুয়ে চাদরটা টেনে নিলাম| ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শে চোখ আর খুলে রাখা যাচ্ছে না| ঘুমের মধ্যে মনে হল‚ মা আমাকে অনেক অনেক আদর করছে আর সেই ছোট্টবেলার ঘুমপাড়ানী গানটা গাইছে.| 'খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে‚ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে‚ খাজনা দেব কিসে'|................. পর্ব - ইতি, গোরা ধান ফুরোলো, পান ফুরোলো খাজনার উপায় কি? আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি !!হটাৎ তন্দ্রাটা কেটে গেলো আমার |মাথার মধ্যে এখনো যেন গানের সুরটা গুনগুন করে ঘুরছে | একবার মাথাটা তুলে চারপাশটা দেখে নিলাম | সামনের বড় কাঁচের প্যানেল দিয়ে সামনের পার্কটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে | চোখটা যেন ঝাপসা মত লাগছে? তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে চোখটা একবার মুছে নিলাম | কেউ দেখে ফেলেনি তো ? নাহ, এখনো লোকজন তেমন আসে নি | ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু দেশি বিদেশী গেস্ট, টেবিল ঘিরে বসে ড্রিঙ্কস নিচ্ছে | মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম মাত্র আটটা বাজে | ঠিক মত হিসেবে করলে বোধহয় চল্লিশ বছর হয়ে গেলো এই বাড়িটা আমরা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম | ঠিক মনে নেই, তবে তারপর হয়তো দু একবার আমরা এসেছিলাম | এখন এই বাড়ি আর সেই বাড়ি নেই , এখন এর নাম বদলে হয়ে গিয়েছে ...... ৫১, শাহ্জহানাবাদ, হেরিটেজ রেস্টুরেন্ট কাম বার........ | নিচের উঠোনটা এখন একটা ছোটোখাটো থিয়েটারের রূপ নিয়েছে | একেক দিন একেক রকমের প্রোগ্রাম হয়ে | কোনোদিন কত্থক. কোনোদিন কাওয়ালি, কোনোদিন মুসায়ীরা ইত্যাদি হতেই থাকে পর্যটকদের জন্য | এই হোটেলের মালিক মিস্টার জগৎ মিত্তল একজন নামকরা আর্কিটেক্ট এন্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইনার |হেরিটেজ বিল্ডিং বা হভেলি কিনে তাকে নানা রূপে পেশ করা ওনার পেশা | ইতিহাসকে পণ্য করে বিজনেস কি করে করতে হয় উনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন | দেয়ালে বড় বড় পেইন্টিংস , বেশিরভাগই সিপাহী বিদ্রোহের সময়কার ছবি | তার সাথে প্রতি ছবির নিচে লেখা এ বাড়ির ইতিহাস , সেই আমার দাদির দাদুর গল্প | একটু রং চড়িয়েছেন গল্পে, তবে বেশি বাড়াবাড়ি করেননি, এই যা | বাইরের পার্কটাও অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছে | আমার সেই পুরানো চিলেকোঠা আর নেই , সেই জায়গায় পুরো ছাদ নিয়ে একটা রুফটপ বার, চারপাশটা গ্লাস প্যানেল দিয়ে ঘেরা | এখান থেকে ঝলমলে পার্কটা কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে দেখতে | সেই ছত্রীটা এখনো আছে, কিন্তু রং বদলে গিয়েছে | উপর থেকে দেখলে মনে হয় পার্কটা এই রেস্টুরেন্টেরই অঙ্গ | জগৎ মিত্তল এমন আর্কিটেক্ট যে ছোটোখাটো রদ-বদল করে উনি জায়গার চেহারায় পাল্টে দিতে পারেন, এইটা নিঃসন্দেহে বলা যায় | বাবার কাছে শুনেছিলাম যে সবাই, মানে বাবা , জেঠু , কাকা অনেক খুঁজে এমন একজন বায়ার পেয়েছিলেন যে এ বাড়ির আর্কিটেকচার কে পুরোপুরি বদলাবে না | এইটা জেঠুর একমাত্র কন্ডিশন ছিল আর কপাল গুনে পেয়েও গিয়েছিলেন এই জগৎ মিত্তল এন্ড সন্স কে | সম্ভবতঃ জেঠুর কোনো বন্ধুই এই যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল| স্কচের গ্লাসটা শেষ হয়ে গিয়েছিলো, বারের দিকে তাকাতেই ওয়েটার বুঝে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে এসে রিফিল করে দিয়ে গেল | আমি জানি এখানকার ম্যানেজার সুজাতা সরকারের চোখ ঠিক আমার দিকে রয়েছে, সেই মতই নির্দেশ আছে এখানকার মালিকের | কেনই বা হবে না, এই বাড়ির সূত্রে জগৎজি বলতে গেলে আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয় গিয়েছেন | উনি এখন অবসর নিয়েছেন , বিজনেস এখন দুই ছেলে দেখে | দুজনই বাপের উপযুক্ত ছেলে | তিন বছর আগে আমার রেকমেন্ডেশনে আমাদের মুম্বই অফিসের ইন্টেরিয়র ওরাই করেছিল , বলতে গেলে আমার মুখ রক্ষা করেছিল দুজনে |গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, উঠোনের দিকটা গিয়ে রেলিং থেকে ঝুঁকে দেখলাম , নিচের আসরে এখন ধীরে ধীরে গেস্টরা আসা শুরু করে দিয়েছে , মনে হয় আরও ঘন্টা খানেক পর এ প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে | তার মানে ততক্ষন আমি এখানে থাকতে পারি| এরপর ওই গান বাজনা শুরু হয় গেলে আর থাকা যাবে না | আমার ফ্লাইট অনেক সকালে | এখান থেকে দশটা নাগাদ বেরিয়ে হোটেল এ গিয়ে কিছু অফিসের কাজ সেরে নেবো, তারপর ফ্লাইট আরামসে ধরা যাবে | শরীরটা আবার সোফায় এলিয়ে দিলাম | মনটা আবার ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল | এটাই হয় এখানে আসলে |বিয়ের পর পর দিন গুলো যে কি ভাবে কেটেছে সেটা আজও ভোলা যায়নি বা ভুলতে পারবোও না কোনোদিন | ছোড়দির বৌভাত তো কলকাতাতেই হয়েছিল, তাই এখন থেকে কেউ যেতে পারেনি , যাবার অবস্থাতেও কেউ ছিল না তখন |তবে মামারা আর কিছু আত্মীয় স্বজন হয়তো গিয়েছিলো| চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকলে সেই সব ঘটনাগুলো চোখের পর্দায় ভাসতে থাকে| কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই না বাড়ির সবাই গিয়েছে সেই সময় | তখন সব কিছু বুঝতাম না কিন্তু এখন বুঝতে পারি সে সব | আজ অনুভব করি, মা সেদিন কি সত্যি সত্যি আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ওই ঘুমপাড়ানি গান, কান্নাভেজা গলায় গাইছিলো? কোনোদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি মাকে , হয়তো কষ্ট পাবে বলেই জিজ্ঞেস করতে পারি নি | মা ,বাবার কাছে যাবার ঠিক তিনদিন পর পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল ছোড়দা কে | বড়মা কত কান্নাকাটি করল, কত কাকুতি মিনতি করলো পুলিশগুলোর কাছে, কিন্তু কিছুতেই ওদের মন ভিজলো না | টানতে টানতে তুলে নিয়েছিল পুলিশ ভ্যানে | বাবার কাছে শুনেছিলাম মিনা আঙ্কল এর এক জুনিয়র খবরটা দিয়েছিলো যে ছোড়দা বাড়িতেই লুকিয়ে আছে | মিনা আঙ্কলের অজান্তেই পুলিশ ছোড়দা কে তুলে নিয়ে যায় | এক ধরনের সাবোটাজ আর কি | প্রোমোশনের ব্যাপার তো ছিলই এখানে | ওই সব ঘটনা যখন হচ্ছিলো তখন আমি স্কুলে ছিলাম | বাড়িতে রয়েছে বড়মা আর ছোটমা | জেঠু আর ছোটকা গিয়েছিলো মিনা আঙ্কলের কাছে | ঘরে ঢুকে দেখি বড়মা বিছানায় শুয়ে রয়েছে | আমি স্কুল ব্যাগটা নিজেদের ঘরে রেখে এসে ছোটমার কাছে গিয়ে বসলাম | বড়মা একবার চোখ খুলে আমাকে দেখে ছোটমাকে বললো ,- ওকে খেতে দাও তুমি , তেতেপুড়ে এসেছে বাচ্চাটা | আমার দিকে তাকিয়ে বললো , বাবুসোনা, তুমি বরং খেয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও দেখি | বলে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো | বাস, ওই টুকুনই বলল বড়মা | খেতে বসে ছোটমা আমাকে বললো সব কথা | সব শোনার পর আমার খাবার ইচ্ছে একদম চলে গেল | এবার কি হবে ? এই চিন্তা আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো | ইতিমধ্যে চার পাঁচদিনের মাথায় বাবাও চলে এলো দিল্লিতে | উদ্দেশ্য এক , সেই ছোড়দাকে খুঁজে পাওয়া | পাড়ার সবাই এ ব্যাপার আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল | যে যার নিজের সোর্স থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো | কিন্তু আশ্চর্য ভাবে ছোড়দা একদম উধাও হয়ে গেল | দিল্লি তো ছিলই, হরিয়ানা , উত্তরপ্রদেশের লাগোয়া কোনো থানা বাদ যায়নি খোঁজ নেওয়া থেকে | মিনা আঙ্কলের যত খবরি ছিল তারাও কোনো খবর দিতে পারলো না | বাবা আর জেঠু সন্তোষজির সাথেও দেখা করে খোঁজ নেবার চেষ্টা করে , কিন্তু উনিও কিছু করতে পারলেন না | বাবার কিন্তু সন্দেহ ছিল যে সন্তোষজি ঠিক জানতো যে কোথায় আছে ছোড়দা , কিন্তু বলে নি | এ কথাটা বাবা আজও বলে| হাতের কাছে সাইলেন্ট মোড এ রাখা ফোনটা কেঁপে উঠলো | কি জ্বালা, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট এসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি মিস্টার মেহেতার ফোন | অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা তুলতে হলো- হ্যালো , - স্যার, অসময়ে বিরক্ত করলাম না তো ? এক্সট্রিমলি সরি স্যার , - না না ঠিক আছে বলুন | বিরক্তিকর বিনয় আমার অপছন্দ |- স্যার আজকের অরেঞ্জমেন্টে কোনো কমি তো ছিল না ?- না, সে রকম কিছু তো নজরে আসেনি, তবে বাউন্ডারির বাইরে নিয়ন আর এল.ই.ডি ডিসপ্লেগুলোর কিছু কিছু জায়গায় ব্রোকেন ছিল |- সরি স্যার, আমিও সেটা নোটিশ করেছি, ওগুলো লাস্ট মোমেন্টে গন্ডগোল করলো, শুরুতে কিন্তু ঠিকই চলছিল |- কোনো ব্যাপার না | ওরকম হয়েই থাকে , নেভার মাইন্ড |- থ্যাংক্যু স্যার , আসলে স্যার সেমি ফাইনাল তো, তার উপর ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচ, কিছু গন্ডগোল যাতে না হয় তার দিকেই আমাদের বেশি নজর ছিল , তাও ভালো যে ইন্ডিয়া জিতে গিয়েছিলো না হলে এই মব সামলানো খুব মুশকিল হয়ে যেত |মনে মনে ভাবছি ইনি কখন মোদ্দা কোথায় আসবেন |- সরি মেহ্তাজি আমি একটু ব্যস্ত আছি এখন , আমরা কি কাল কথা বলতে পারি ?- নিশ্চই স্যার , কাল তো কথা বলবোই , আসলে স্যার আমার উপর প্রেশার আছে একটু , আপনি যদি আমাদের থার্টি পার্সেন্ট পেমেন্টটা একটু তাড়াতাড়ি করিয়ে দেন তাহলে খুব ভালো হয় স্যার , তাছাড়া এটাও জানবার ছিল যে ফাইনালে আপনিই আসছেন তো ?- দেখুন, আমি চেষ্টা করব যত তাড়াতাড়ি হয় আমি করিয়ে দেব | আর ফাইনালে মনে হয় কোরিয়া থেকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর আসবেন | সে আপনাদের আগে থেকেই জানিয়ে দেব , সে চিন্তা করবেন না |বিরক্তিকর আলোচনা থেকে পাস কাটানোর জন্য কথা শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি , কিন্তু বিধি বাম|- কিন্তু স্যার আরেকটা ব্যাপার ছিল তার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত | ওই সন্তোষ উপাধ্যায় স্যার , ওকে যে কে ইনভাইট করেছিল জানি না , ট্রফি তিনি নিজের হাতে দেবে বলে হাঙ্গামা শুরু করে দিলেন , অনেক কষ্টে ওকে আটকাতে পেরেছি | - হুম , নেক্সট টাইম থেকে আপনারা যদি এটা খেয়াল রাখেন তাহলে ভালো হয়|একটু কঠিন ভাবেই বললাম কথাটা | ঠিক আছে আজ রাখছি, বাই | বলে ফোনটা ডিসকানেক্ট করে দিলাম| এই ধরনের বত্তমিজি আমি সাধারণতঃ করি না | কিন্তু কি করব, মাথাটা গরম হয় গেল ওই বাস্টার্ডটার নাম শুনে |সুজাতা আমার কাছে এগিয়ে এলো ,- কিছু চাই স্যার? আমরা আজ একটা স্পেশাল মুঘলাই ডিশ করেছি , একবার টেস্ট করবেন ? আরেকটা কথা স্যার , আপনি চাইলে আপনার ফোনটা আমার কাছে দিতে পারেন , আপনার বাড়ির ফোন ছাড়া আর কারো ফোন এলে বলে দেব যে আপনি বিজি আছেন এখন ?ওর কথায় আমি হেসে ফেললাম ,- থ্যাঙ্কস সুজাতা, তার দরকার নেই , মনে হয় না আর কেও ফোন করবে | তা একটু দাও তোমাদের নতুন ডিশ| বেচারির খারাপ লাগবে তাই বললাম ওকে , খাবার ইচ্ছে এখন একদম নেই আমার |- ওকে স্যার , এক্ষুনি পাঠাচ্ছি| প্লিজ এনজয় ইওর ড্রিঙ্কস স্যার| বলে ওয়েটারকে নির্দেশ দিলো কিছু |যতদূর মনে পরে বাবা বোধহয় আট - দশদিন ছিল দিল্লিতে | বড়মা তো পুরো শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিল | দিনরাত শুধু কান্না আর কান্না | ঘুমের মধ্যেও আমি অনেক সময় কাঁদতে দেখেছি | আমি তো স্কুল থেকে ফিরেই বড়মার কাছে গিয়ে বসতাম | নিজের সাধ্য মত সান্ত্বনা দিতাম | ওষুধ , জল খাইয়ে দিতাম | মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম | নিজেকে যেন অনেক বড় ভাবতে লাগলাম | গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার দাবার গরম করতেও শিখে গেলাম | ছোটমা তো বাড়ির অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতো | যদিও একজন কাজের বাঈ ছিল | কিন্তু কিছু কাজ তো নিজেদের ও করতে হয় | একদিন দেখলাম নিচে জেঠু, বাবা আর ছোটকা কিছু জরুরি কথা বলছে | আমি তিনজনের জন্য চা বানিয়ে ঠিক মার মতো টি পটে চা ঢেলে, ট্রেতে করে সাজিয়ে ওদের সামনে টেবিলের উপর রাখলাম , মাথা নিচু করে বললাম ,- আমি চা বানিয়েছি জেঠু | বাবা অবাক হয় আমার দিকে তাকালো, তারপর উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো আর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে লাগলো |জেঠু কি রকম ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ , - বাচ্চা ছেলেটাকে আমরা টেনে বড় করে দিলাম রে জগু, বলে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো | আমি জেঠুর কাছে গিয়ে চেয়ারের হাতলে বসে বললাম, - জেঠু আমি তো এমনিই বড় হয়ে গিয়েছি , তুমি এমনি করে কেঁদোনা তো , শরীর খারাপ করবে এবার | বলে জেঠুর পিঠে হাত বোলাতে লাগলাম | জেঠু আমার হাতটা টেনে নিজের বুকের কাছে ধরে নিয়ে চুপ করে বসে রইলো | বাবা আর ছোটকা কি রকম ঝিম মেরে বসে রইল | ছোটো ছোটো ঘটনা, কিন্তু মনে হয় যেন কালই ঘটেছে সব | মনে গেঁথে রয়েছে প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা মুহূর্ত | মা তো সতেরো বছর হলো আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে | কিই বা বয়েস হয়ে ছিল মার | দিল্লি ছেড়ে আসার পর যতদিন বেঁচে ছিল মা শুধু নিজেকেই সব কিছুর জন্য দোষী মনে করে গেল | বেচারা বাবাকেই তো সব সামলাতে হয়েছিল | আমি তো পড়াশুনো আর কাজ নিয়ে অনেকটা সময় বাইরেই কাটিয়েছি | ওদিকে জেঠু বড়মা, এদিকে মা, তার উপর নিজের কাজ , কি না করেছে বাবা একা হাতে | তবে বৌমা, মানে আমার বৌ সুরেখা আর আমার দুই যমজ ছেলে মেয়ে কুশ আর লিপিকে পেয়ে বাবা মা নিজেদের অনেকটা সামলে নিয়ে ছিল | কিন্তু মা তো ভিতর থেকেই ক্ষয়ে গিয়েছিল | আর মন ভেঙে গেলে যে শরীরও ভেঙে যায়, সেটা মা কে দেখেই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম | দিল্লিতে সেই সময় একমাত্র সাথী প্রিতিই ছিল | খেলতে যাওয়া তো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলাম | বাড়িতেই এতো কাজ থাকতো | তাছাড়া ছোড়দার ব্যাপারে সবাই জিজ্ঞেস করতো বলে আমিও বন্ধুদের এড়িয়েই চলতাম , যদিও কোনো কারণ ছিল না | স্কুল থেকে ফিরেই প্রিতিই বাড়িতে চলে আসতো | আমার সাথে বসেই হোম ওয়ার্ক গুলো শেষ করতো | শুধু আমার সাথেই না, বাড়িতে সবার জন্য ও সময় দিতো | ও কাকিমা, বড়মা, জেঠু সবার সাথে বসেই কথা বলতো, স্কুলের গল্প, পাড়ার গল্প | এখন ভাবি, প্রিতিই তো আমার বয়েসিই ছিল , কিন্তু কত পরিণত ছিল আমার থেকে | বেশির ভাগ দিনই প্রিতির মা মানে সিং আন্টি প্রিতির সাথে আমার স্কুলের টিফিন পাঠিয়ে দিতেন | বাড়িতে তো রান্নার লোক রাখা হয়েছিল ওই সময়, কিন্তু তাও উনি পাঠাতেন | ছোটকার কথাই শেষ মত ঠিক বেরোলো | আমাকেও বাবা নিজের কর্মস্থানে নিয়ে এলো | নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে সময় তো লেগেই ছিল | একে বিহার, তার উপর ভাষা | কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি আমার সেই অসুবিধার কথা | কাকেই বা বলবো | এদিকে কয়েক মাস পর ইমার্জেন্সি শেষ হলো, দেশের অবস্থা অনেকটা ঠিক হয়ে এলো | সেই সময়কার রুলিং পার্টি আর নেই | নতুন করে ইলেকশন আবার হবে | সেই সময় সবাই আশা করে ছিল যে ছোড়দাকে এবার পাওয়া যাবে | কিছু মাস পর পাওয়াও গেল, কিন্তু কি অবস্থায় ? হরিয়ানার এক ছোট শহরের এক নাম না জানা হাসপাতালে | এক মুখ দাড়ি গোঁফ, বড় বড় চুল রোগা, চেনার কোনো উপায় ছিল না | জানা গেল কিছুদিন আগে রাস্তায় বেহুঁশ অবস্থায় পেয়ে লোকেরা হাসপাতালে দাখিল করে দিয়েছিল, এই ভেবে যে রাস্তায় মরে পরে থাকবে তাই | অবশ্য মিনা আঙ্কলই শেষ অবধি উদ্ধার করতে পারে ছোড়দাকে | আর কেউ হলে খুঁজেই পেতোনা | সেদিন ও একটা দিন ছিল আমার জীবনে | আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা কি রকম একটা জবুথবু হয়ে ঘরের এক কোণায় বসে আছে | কি হলো মার ? আমি কিছু না বলে স্কুল ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে রাখা খাবার খেতে বসলাম | কিন্তু মা তো এলো না ? আমি খেতে বসলেই তো মা এসে কাছে বসে ? আমি খাওয়া ছেড়ে মার্ কাছে গেলাম,- মা , কি হয়েছে তোমার ? শরীর ঠিক লাগছে না ? বাবা কে ডাকবো ? মা অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছে , আর আস্তে আস্তে কি যেন বলছে | আমি ভালো করে কাছে গিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম ,- আমার জন্যেই সব হলো, আমি দোষী সবার কাছে , ভগবান আমায় যেন ক্ষমা না করেন | আরও কি সব যেন বলে যাচ্ছিলো মা | আমি সত্যি এবার ঘাবড়ে গেলাম , জোরে জোরে মার কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম | - মা, মা কি হয়েছে মা তোমার ? হটাৎ মা যেন সম্বিত ফিরে পেল |- ওহ, তুমি এসে গিয়েছো ? আমায় ডাকোনি কেন আগে ? চলো খেতে চলো | বলে যেন কিছুই হয়নি সে ভাবে উঠে কিচেনের দিকে চলে গেল আমাকে খেতে দেবে বলে | কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির কাজের মেয়ে, সেই সব বললো ,- সাবজি আজ জলদি চলে এসেছিলো অফিস থেকে , দিল্লি সে ফুঁনওয়া আইল রহে না ! কি যেন একটা হয়েছে দিল্লি মে |- গোরা , খেতে এস তাড়াতাড়ি, খাবার ঠান্ডা হয় যাচ্ছে যে ,- হা মা , এই আসছি |খেতে খেতে মার দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম , এখন স্বাভাবিকই আছে মনে হলো, - মা , দিল্লি তে কি হয়েছে ? বাবা কেন দিল্লি চলে গেল তাড়াহুড়ো করে?মা ই আমাকে সব বললো যে ছোড়দাকে পাওয়া গিয়েছে আর কি অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে ইত্যাদি | বাবা তাই দিল্লি গিয়েছে | সব ঠিকঠাক করে শিগগিরই ফিরে আসবে |- মা, এ তো ভালোই হলো , ছোড়দাকে পাওয়া গিয়েছে | আর কিছুদিন হাসপাতালে থাকলে এমনিই ভালো হয় যাবে ছোড়দা, তাই না মা ? আমার সত্যি ভীষণ আনন্দ হলো , যাক এবার সব কিছুই ঠিক হয় যাবে | আমরা আবার সবাই বাড়ি ফিরে যাবো | মা অবশ্য আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না | মা আবার কি রকম চুপ করে গেল | আমার মনে হয়তো একটা ক্ষীণ আশা ছিল, কিন্তু না, তা আর হয়নি |বড়মা একটু ঠিক হতেই, বড়োরা সবাই ঠিক করে নিলো যে এ বাড়ি তারা বিক্রি করে দেবে | একটু চিন্তা ছিল যে, এই বাড়ি ক্লেইম করার আরও কেউ ওয়ারিস আছে কি না , কিন্তু অনেক খুঁজেও কাউকে পাওয়া গেল না | অনেক পুরোনো বাড়ি তো, হতেই পারতো কেউ না কেউ | একবার কেস ঠুকে দিলেই তো হয় গেল | তাছাড়া এতো বড় বাড়ি, কেনার লোকও তো চাই | ব্যাপারটা যত সহজ ভাবা হয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো বেশ ঝামেলা আছে | বাবা তো প্রতি মাসেই একবার করে দিল্লি যেত | একে তো বাড়ি বিক্রি, তার উপর ছোড়দার ট্রিটমেন্ট | এদিকে ছোড়দা প্রাণে তো বেঁচে গেলেও , কোমর থেকে নিচে পুরো অসার হয়ে গিয়েছিলো | ডাক্তার ও এ ব্যাপারে কোনো আশা দিতে পারলো না | মানে এ ভাবেই হুইল চেয়ার নিয়েই সারা জীবন কাটাতে হবে | সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে নি | সুরেখার সাথে আমার ম্যানেজমেন্ট কোর্স করার সময়ে আলাপ, তারপর বিয়ে | ও মারাঠি, কিন্তু আমাদের ফ্যামিলিতে খুব সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিয়েছিল | ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছোড়দা | বড়মা তো আমার বিয়ের আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন | বাড়ি বিক্রি হবার পর তো জেঠু আর ছোটকারা ভাড়া বাড়িতে চলে গিয়েছিলো | বড়মা মারা যাবার পর সত্যি এবার জেঠুদের অসুবিধা হতে লাগলো, বিশেষ করে ছোড়দাকে নিয়ে , ওর দেখাশুনোটাও একটা বড় কাজ | কাজের লোক রাখা সত্ত্বেও বাড়ির কেউ না থাকলে খুব অসুবিধা | অনেক কষ্টে জেঠু কে বোঝানো গেল এই অসুবিধার কথা | সেই মত ঠিক হলো যে জেঠু ছোড়দির কাছে আর ছোড়দা আর বাবা আমার কাছে থাকবে | কিন্তু বাবা বেশিরভাগ ছোড়দির কাছেই থাকতো | দিল্লি ছাড়া বাবা পক্ষে সম্ভব ছিল না | আমিও জোর দেয়নি কখনো বাবা কে | আবার ফোনটা বেজে উঠলো, বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুলতে গিয়ে দেখলাম সুরেখার ফোন |- হা বোলো সুরেখা ....- ও হো মামুজান, কি আদর করে কথা বোলো মামীজান কে সাথে ? - আরে নন্দিনী তুই ? কবে এলি রে ? আগে খবর দিলি না কেন রে যে তুই আসবি ?- আমরা তো সবাই ........- আরে চুপ চুপ...... ,আরও অনেকের গলা পেলাম মনে হলো ? বাবার আওয়াজও পেলাম মনে হলো ?- ছোড়ো না মামুজান, টিভি তে ট্রফি দেবার সময় কি ধানসু লাগছিলো তোমায় | চশমে বদদুর মামু | আমরা সবাই তাই বলছিলাম |- আমরা সবাই কে ?- আমরা মানে ......আরে ছাড়ো না | তোমার ফ্লাইট কখন ?- সকালেই, মুম্বাইতে নাইন থার্টি তে পৌঁছে যাবো |- ঠিক আছে ব্রেকফাস্ট এক সাথে করবো ওকে ?- নিশ্চই, বাই ‚- বাই ফোনটা হাতে ধরেই ভাবতে লাগলাম, কি ব্যাপার সবাই কেন এসেছে ? কিন্তু যাই হোক কিছু একটা মজা তো হবে পক্কা |ফোনটা আবার গোঁ গোঁ করে উঠলো, রিমাইন্ডার, আসলে আমি ভুলে যাই বলে সুরেখা দুনিয়ার সব আত্মীয় বন্ধুদের এনিভার্সারি, বার্থডের ডেট গুলো ফিড করে রাখে, আমিও সেই দেখে সবাই কে উইশ করে মেসেজ করে দি | এবার আমি নিজেই হো হো করে হেসে উঠলাম | আরে এতো আমারি ফিফটিয়েথ বার্থডে | এবার বুঝেছি সবাই কেন এসেছে | সত্যি মনটা খুব ভালো হয় গেল | ম্যানেজার সুজাতা কে ইশারা করলাম আমার পেমেন্টটা রেডি করার জন্য | ড্রাইভার আমাকে আসতে দেখে দরজা খুলে দাঁড়ালো | আমি গাড়িতে উঠতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম | পুরোনো অভ্যেস মতো দুটো বাড়ি ছাড়িয়ে তৃতীয় বাড়ির দিকে নজর চলে গেল | প্রিতিরা তো এখন আর ওখানে থাকে না | কোথায় আছে তাও জানা নেই | তবুও হাত তুলে বাই করলাম প্রিতিকে, যেমন আগে স্কুল থেকে একসাথে ফেরার পর করতাম | ছোটবেলায় মা বলতো যারা মারা যায় তারা আকাশের তারা হয়ে যায়, আমি আজও তাই বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করতে মন চায় | রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাথার উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে জেঠু, বড়মা আর মাকে মনে মনে প্রণাম করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম গাড়ির কাঁচ নামিয়ে আরেকবার হাত নাড়লাম, ....বাই ৫১, শাহ্জহানাবাদ ....ফির মিলেঙ্গে, ওয়াদা রহা!!!!.....শেষ
বাঙালবাড়ির কিস্যা (প্রথম ভাগ) এলেম আমি কোথা থেকে( ৮ম পর্ব) --------------------------------------------------- নাকতলার সেকন্ড স্কীমের ফুটবল মাঠে সেদিন হেব্বি হল্লা, বাওয়াল হয়েছে বাপ-ছেলেতে, হেসে মরছে পাড়াপড়শি, ছেলেছোকরারা। বাসস্টপে নেমে হরিদাস পাল রঞ্জন সেদিন হনহনিয়ে হাঁটছে, আজকে শেষ রিহার্সাল। পরশু ওয়ান অ্যাক্ট কম্পিটিশনে প্লে নামাবে ওরা, আঠারো বছর বয়সের ছয়জন বন্ধু। জজের প্যানেলে আছেন থিয়েটারে আলোকসম্পাতের জগতে বিপ্লব ঘটানো তাপস সেন ,থাকেন পাশের পাড়া রামগড়ে। ব্যস্, এই কম্পিটিশন জিততে পারলেই কেল্লা ফতে। পাব্লিক? " বুঝবে তখন বুঝবে!' তখন নিশ্চয়ই সবাই ঝুলোঝুলি করবে -- আমাদের ওখানে একটা শো' করুন না! ওদের যে কেউ ডাকে না, বিনিপয়সায় করতে চাইলেও না। কোন ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নাটক করার জন্যে তার সেক্রেটারিকে ধরে অনেক আমড়াগাছি করে শো করার অনুমতি পাওয়া গেল। তেড়ে একমাস রিহার্সাল দেয়া গেল। বাড়ির লোকজন, গার্লফ্রে¾ড সব্বাইকে বলা হয়ে গেছে-- অমুক তারিখ আমার শো'। তারপর ঠিক একদিন আগে জানা গেল ওদের নাম কেটে শো অন্য কোন সিনিয়র নাটকের দলকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু খেলার মাঠের পাশে আজকে কিসের বাওয়াল? ---- ওই হাফপ্যান্ট পরা ছোঁড়াটা কে র্যা? হাড়বজ্জাত ছেলে! ----- বেলেঘাটা থেইক্যা কয়মাস হইল আইছে, খালি মাজাকি করে! ----- আমাদের পাড়ার দারোগাবাবু, হেই যে বাদলার বাপ! উনার একটু কম্পলেক্স আছে। রোজই আফিস থেইক্যা আইস্যা লুঙি পইর্যা উনি পাড়ার ছেলেদের ইংরাজির পরীক্ষা নে'ন। যেমন,-- "" তিমির, তুমি তো ভাল ছাত্র, কও দেখি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়িতেছে, এর ইংরাজি কি অইব? হা:-হা:-হা:! পারলা না তো, জানতাম। আইজকাইল ইসকুলে কিস্যু শিখায় না। আচ্ছা, এইডা কও-- টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। এইডাও জান না? বেশ, এইবার একটা সহজ প্রশ্ন করি-?"" মস্মস্ করা নতুন জুতা''-- এর ইংরেজি কও? সব চুপ! কিন্তু হেই হারাম্জাদাটা কয় কি? ----- এরা কিস্যু জানে না, মেসোমশায়। আপনেই কন--" কচ্কচ্ করা নতুন বাল'' এর ইংরাজি কী? - হারামজাদা পোলা! আমি তর বাপের বয়সী, আমার লগে ইয়ার্কি! আইজই তর বাপেরে কমু, কি শিক্ষা দিছেন নিজের পোলারে? কিন্তু আজকে খেলার মাঠে দারোগাবাবুকে তো দেখছি না,ওই ছোঁড়াটা দৌড়ুচ্ছে , পেছনে ওর বাপ। ব্যাপারটা কি? ------- আর বলিস না। দারোগাবাবুর নালিশ শুনে বাপ তো ছেলেকে আচ্ছা করে কড়কে দিল। কিন্তু ছেলেটা এক্কেবারে যাকে বলে রেকটাম-রাইপ। আজ খেলার মাঠে বন্ধুদের তোল্লাই খেয়ে নিজের বাপকেই জিগ্যেস করেছে-- ' বাবা, আইজ ক্লাসে মাস্টারে জিগাইসে স্বাধীনতা সংগ্রামী ত্রয়ীর নাম। আমি দুইটা কইসি,--" লাল' আর" পাল '। আরেকটা নাম কি যেন? কী ""গঙ্গাধর তিলক''? ------ তারপর? ------- তারপর আর কি! বাপের তেলেভাজার দোকান, তাড়াহুড়ো করে ছেড়ে এসেছে, স্কুলের মাঠে এবারে নতুন প্লেয়ার শ্যাম থাপার খেলা দেখবে বলে।। রেগে গিয়ে বলেছে-- বানচোইৎ! জাননা কী গঙ্গাধর? ''বাল""! তারপর কী হচ্চে দেখতেই পাচ্ছিস। না, রনজন কিছুই দেখছে না। ওর কানে বাজছে ওই দু-অক্ষরের শব্দটি। কালকেই ওর দলের একটি ছেলে বলেছে--- এইসব বালের নাটক করে কী হবে? পাড়াতেও এরকম কিছু টিপ্পনী কানে এসেছে। কী হবে? ও নিজেও জানেনা কী হবে। খালি জানে ওকে নাটক করতেই হবে। আজ নয়তো কাল। হবে, একদিন হবে। বনৎ বনৎ বনি জাই, বিগড়ি বনৎ বনি জাই। দরকার একটা জেদ, একটা পাগল করা জেদ। কিন্তু, ও কি পারবে? ওর কি আছে সেই জেদ? ওর বাবা সলিলকুমারের ছিল। কিন্তু ও যে এক্কেবারে অন্যরকম, ভীতুর ডিম, বাবার মত নয়। দাদুর আদরের নাড়ুগোপাল। কিন্তু ওর ভুতের ভয়, আরশোলাকে দেখে ভয়,বহুরূপীকে দেখে ভয়, সাঁতার কাটতে ভয় , ইনজেকশন নিতে ভয়-- এইসব দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে দাদু সতীশচন্দ্র বলে উঠতেন-"' এইডা সিংহের ঘরে শিয়াল জন্ম নিছে''। হ্যাঁ, ওর বাবা সলিলকুমার চারদিকের খটাশ, ভোঁদড়, সজারু, নেকড়ে আর হায়েনার পালের মধ্যে সিংহ ছিলেন। মরেছেন ও সিংহের মত, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে। বলতেন-- আমি বিছানায় শুয়ে ভুগে ভুগে তোমাদের সেবা শুশ্রুষা নিয়ে কেঁদে ককিয়ে মরবো না। কাউকে বিরক্ত না করে তার আগেই চলে যাবো। যখন সময় হবে, মানে চিত্রগুপ্তের লেজারে আমার ব্যালান্স "জিরো' হবে, যমদূত নিতে আসবে, বলব-- একটু দাঁড়াও, জুতোর ফিতে বেঁধে পানামা সিগ্রেট ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে নি। ব্যস্, এবার চল। ভগবান বোধহয় ওঁর মনের ইচ্ছে শুনেছিলেন। তাই ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের কন্স্ট্রাকশন এরিয়ায় মেদিনীপুরের কাঁথি থেকে লেবারের কাজ করতে আসা ছেলেটির ওপর যখন সীমেন্স কোম্পানীর বানানো মোটর কন্টোল সেন্টারের বিশাল এম সি সি মেশিন স্লিপ হয়ে গড়িয়ে পরে পিষে ফেলছিল তখন উনি দৌড়ে এসে দুইহাতে ওই মেশিনটিকে ক্রেট শুদ্ধু ঠেলে ধরে রাখেন। ছেলেটি নীচের থেকে গড়িয়ে সরে গিয়ে বেঁচে গেল। কিন্তু সলিলকুমার আর পেছনে সরে যাওয়ার জায়গা পেলেন না। ফলে ওই মেশিন ক্রমশ: ওনাকে পিষতে লাগল, মাটিতে পেড়ে ফেললো। যখন সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ওনাকে নিয়ে গেল, তখন উনি পরিচিত ডাক্তারকে বল্লেন--- পা টা তো গেছে, মাত্র এক ইঞ্চি আটকে থেকে ঝুলছে। বুটজুতো খুলে দে। ব্যথা লাগছে। কিন্তু এসব কিছু না। আসল হল পেটের ওপর মেশিন পড়ে লিভারে চোট লেগেছে , বড্ড ব্যথা। একটা পেন কিলার ইনজেকশন দাও। তারপর চোখ বুজলেন, আর খুললেন না। পুলিশ ওয়্যারলেসে খবর পৌঁছলো কোরবা জেলার আদিবাসী এলাকায় ছুরি গাঁয়ে। রাত আটটায় খবর পেয়ে হরিদাস পাল তো বৌকে নিয়ে রাত জেগে ভীড়ের ট্রেনে চেপে পড়িমরি করে ভিলাই পৌঁছলো পরের দিন সকালে, বাবার বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে মর্গে ঘুমিয়ে থাকা শরীর থেকে বরফ জল মুছে পোস্টমর্টেম করাতে নিয়ে গেল। পাশের কামরায় ডোম যখন হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে সলিলকুমারের মাথার খুলি খুলে দেখছিল তখন হরিদাস পালের মনে হচ্ছিল যেন গ্যারেজে ট্রাক মেরামত চলছে। কিন্তু যখন চিতায় শুইয়ে সারা শরীরে , বিশেষ করে পেটে-বুকে ডোমের সেলাইয়ের ওপর ঘি মাখাচ্ছিল তখন হাত যেন আর চলে না। পরিচিত পুরুতঠাকুর ধমকে উঠলেন--- কী হল? তাড়াতাড়ি করুন। এমন অন্যমনস্ক হলে চলে! কিন্তু হরিদাস পাল করবে কী? ও যে দেখতে পাচ্ছে যে এই দু 'দিনের বাসি মড়া সলিলকুমার নয়। সলিলকুমার তো এখন মেঘনা নদীতে নৌকো ভাসিয়েছেন। গলুইয়ের পাশে বসে বিড়িতে টান দিয়ে ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে গান ধরেছেন--- মনপাগলা রে! কই হতি কই লইয়া যাও! এরপর উনি ডুব দিয়ে পাট তুলবেন বেশকিছু। তারপর সেই পাট মহাজনের কাছে বেচে বন্ধুদের সঙ্গে রসগোল্লা কিনে খাবেন। বাবা মাছ আনতে আট আনা দিলে ময়মনসিংহের বাড়ির চৌকাঠে সেই পয়সা নামিয়ে রাখছেন সলিলকুমার। না, পুরো একটাকাই চাই। সেটা দিয়ে অন্তত: দুইসেরি বা আড়াইসেরি রুই মাছ কিনবেন। বাড়ির চাকর সেটা পেছন পেছন নাকের থেকে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি আনবে, আর মাছের লেজ সারা রাস্তা পথের ধুলো সাফ করতে করতে আসবে। এই না হলে বাঙাল! দেশভাগের পর পার্কসার্কাসের বাড়িতে সামনের ধাঙড় বাজারের কিছু গুন্ডা আক্রমণ করল, সময়মত গুরুসদয় দত্ত রোডের ছাউনি থেকে কিছু গোরা সৈন্য ও কড়েয়া থানার পুলিশ এসে পড়ায় কোন জানমালের ক্ষতি হয়্নি। সলিলের বড়দি সেই গুন্ডাদের চিনিয়ে দিলেন। ওরা হাজতে রইল। তারপর পাড়ার একজন রাজনৈতিক নেতা গুন্ডাদের মুক্তির জন্য জনগণের সইসাবুদ সংগ্রহ করতে বেরোলেন। ক্রুদ্ধ সলিল ওই পিটিশনে সাইন করতে অস্বীকার করলেন। বল্লেন-- অরা ঠিক জায়গাতেই আছে, অদের উপযুক্ত জায়গায়। কিন্তু ভিলাইয়ে দাঙ্গাবাঁধার উপক্রম হলে সারারাত অফিসের জীপ নিয়ে উত্তেজনা যাতে না ছড়ায় তার জন্যে টহলদারি করেছেন। নিজের মুসলমান কর্মচারিদের সঙ্গে একসাথে বসে খেয়েছেন। হালাল ও ঝটকা মাংস নিয়ে কেউ কিছু বললে বলতেন -- নেতাজী সুভাষ বোস বর্মায় থাকার সময় খাবার লাইনে ঝটকা-হালাল নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেপাইদের দুই আলাদা পংক্তিতে খেতে বসা দেখে অবাক হয়ে দুইবাটির আলাদা মাংস একটি বালতিতে ঢেলে নিয়ে রেগুলেশন সোর্ড দিয়ে ঘেঁটে দিয়ে বলেছিলেন, এবার কোনটা ঝটকা আর কোনটা হালাল পদ্ধতিতে রান্না মাংস কেউ চিনিয়ে দিক তো। আর যে ছেলেটাকে আজ বাঁচাতে গেলেন বছর আগে সেই ছেলেটারইতো মে মাসের গরমে হিটস্ট্রোক হয়ে প্রচন্ড জ্বর আর বমি হয়েছিল। সবাই ধরাধরি করে গাড়িতে করে বাড়ি এনে ওকে মাটিতে শোয়ালো। স্ত্রী স্মৃতিকণা ঘাড়ের নীচে কাগজ দিয়ে মাথায় জল ঢালছেন। কিন্তু ঠিকমত হচ্ছে না।সলিল ভ্রূ কুঁচকে দেখছিলেন। এবার ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বল্লেন-- এবার ভাল করে মাথা ধুইয়ে দাও। সেইদিন হরিদাস পালের চোখে ওর বাবার হাইট অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সবার কাছে বাবা-মা রা রোল মডেল। কিন্তু হরিদাস পাল রনজনের রোল মডেল ওর বাবা নয়। ও জানে ও কোনদিন ওর বাবার মত হতে পারবে না। সলিলকুমার অন্য ধাতুতে গড়া। দেখতে কিঞ্চিৎ কাঠখোট্টা ভদ্রলোকের ভীষণ ম্যানলি পেটানো চেহারা। যখন মহিলাদের সামনে একটু ঝুঁকে বাও করে কাউকে বলেন----" ভাল আছেন? ভাল থাকুন' , তখন সেই "" অদা'' দেখে ওরা দু'ভাই বাবার শিভালরাস নাইট ইমেজের প্রতি ফিদা হয়ে যায়, কিন্তু ভীষণ জেলাস হয়। হরিদাস পাল মেয়েদের সামনে আজীবন দড়কচা মেরেই রইল। আবার সলিলকুমারের চোখে রোলমডেল তাঁর মাতৃভক্ত বাবা সতীশচন্দ্র ন'ন। যে ভদ্রলোক কোলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লি যাবার সময় মায়ের কথায় চাকরি ছেড়ে ময়মনসিংহ ফিরে যায় সে ঠিক পুরুষকারে বিশ্বাসী সলিলকুমারের শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে না। -----বিপ্লব করবি? বিপ্লবের মানে বুঝস্ ? বিপ্লব করতে অইলে নিজের নিজের ডেথ ওয়ারেন্টে নিজে সাইন কইর্যা তবে পথে নামতে হয়। তর আছে সে সাহস! -------তোমরা না সেই আনন্দমঠের যুগে পড়ে আছ। তোমাদের মেটাফরগুলো না!---- ----- আরে, তোদের যারা খেপাইতাছে সব ভীতুর ডিম। চিন ও ভীতু। দ্যাখ, বুড়া হো চি-মিন হাঁটুডুবা ধানের ক্ষেতে দাঁড়াইয়া এত মেন্নত কইর্যা ভিয়েতনামরে স্বাধীন করলো, এখন তাদের জমিতে চিন আর আমেরিকার প্রক্সি ওয়ার হইতাছে। যা শত্রু পরে পরে! হিম্মত থাকলে সামনাসামনি লড়াই করুক না। নেফায় লাদাখে খুঁচাখুঁচি করা এক আর নাপামবৃষ্টির সামনে দেশের লোকজনেরে আগাইয়া দেওয়া আর এক। মাও সে তুং ও ভীতু। আর তরা প্যাট ব্যাক্কল। ---কী ভীতু-ভীতু শুরু করেছ, গোলপোস্ট ঠিক কর। --- শোন, ভীতু লোকেরাই লোভী, কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী হয়। ভীতু লোকদের থেকে সতর্ক থাকবি, এরা তোষামুদে হয়। -----তুমি ভয় পাওনা? কোন ভয় নেই এমন কেউ আছে! --- ধ্যাৎ,কখনো ভয় পায় নাই এমুন হয় না। সবার চেয়ে বড় হইল মৃত্যুভয়। সবারই ভয়ের জায়গা আছে, রাজারও আছে, প্রজারও আছে। ছাগা যেমুন বাঘারে ডরায়, বাঘাও ছাগারে ডরায়। কিন্তু ভয় পাওয়া এক কথা আর ভীতু হওয়া এক কথা। --- মানে? -- মানে ভয় পাইলে তারে যুক্তি দিয়া বিচার কইর্যা সামনা করতে হইব। বুঝতে হইব বেশিডা কী আর হইব! মরতে হইব,এই ত? তার লেইগ্যা আইজ যদি চৌখ্যের সামনে মাইয়ামানুষের প্রতি অত্যাচার দেইখ্যা চুপ কইর্যা থাক,তা হইলে তুমি ভীতু। আরে, কাইল যদি সেই মাইয়া তুমার বইন হয়, বউ হয়, বেটি হয়! ----- অরা যদি সংখ্যায় বেশি হয়? ------- মেয়েদের বাঁচাইতে হইব, যেমনে পার, পলাইলে ওদের সঙ্গে নিয়া পলাইবা। না পারলে -- ---- হ, না পারলে কি করন? ------ না পারলে মরতে অইব, আর কোন বিকল্প নাই। (চলবে) ছত্তিশ্গড়ের কিসসা পর্ব-৪পুলিশ, ওরে পুলিশ!গৌরচন্দ্রিকাসাতসকালে রায়গড় স্টেশন থেকে মুম্বাই মেল চড়ে গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে সবে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছি, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।প্রথম পাতায় হেডলাইনঃ রানিবোদলি গ্রামে নকশাল আক্রমণে পঞ্চান্নজন পুলিশ নিহত।বস্তারের যে জায়গাটার কথা বলা হয়েছে বিশেষ বাহিনীতে ভর্তি হয়ে গত মাসে সেখানেই গেছে আমাদের নাটকের দলের সক্রিয় সদস্য অবিনাশ চোপড়ে।অবিনাশ হিন্দি সাহিত্যে এম এ পাশ করে একটি স্কুলে পড়াচ্ছিল। কোন মাসে মাইনে পেত, কোন মাসে হরিমটর।এর মধ্যে বিয়ে করল আমাদের দলেরই একটি মেয়েকে। মেয়েটি হাসপাতালের নার্স।তার কয়েক মাস পরেই স্ত্রীভাগ্যে ধনলাভ। জুটে গেল বিশেষ পুলিশ বাহিনীতে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি।নিহতদের তালিকায় নামগুলো আঁতিপাতি করে দেখি। তারপর একটা শ্বাস ছাড়ি। ততক্ষণে আড়মোড়া ভেঙে রেলের কামরা জেগে উঠেছে। চারদিকে উত্তেজিত কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে।: এ সরকার অপদার্থ, বস্তারকে মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ।:ছত্তিশগড়ের পান্তাভাতখেকো পুলিশ কোন কম্মের নয়।লড়াই না করে পালিয়ে গেছে।বিহার ইউপি থেকে শিক্ষিত বেকার ছেলেদের দলে দলে পুলিশে ভর্তি করে হাতে বন্দুক দিয়ে দেখুন, নকশালদের সোজা নকশালবাড়ি পাঠিয়ে দেবে।: মশাই, ট্রেনের কামরায় বসে এমন উড়ন ছুঁ কথাবার্তা বলা সহজ; যান তো দেখি অবুঝমাঢ় কি বাসাগুড়ায়!: ছত্তিশগড়ি পুলিশ ডরপোক? খালি পান্তাভাত খায় আর ঘুমোয়? হুঁ:!সেই ছকে বাঁধা কথাবার্তা; আমার একঘেয়ে লাগে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।আমার চেতনায় পুলিশ নির্মাণআরে আরে মারবি নাকি? দাঁড়া, একটা পুলিশ ডাকি!বাচ্চা রবীন্দ্রনাথকে ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ পুলিশ আসছে বলে ভয় দেখাতেন।পুলিশ মানে খাঁকি টুপি, বেল্ট, বুটজুতো! লাঠি, বন্দুক!বেশ, কিন্তু আমার ফোর্ট উইলিয়মে চাকরি করা ফৌজিবাবা?উনিও তো খাঁকি পরেন, বেল্ট বাঁধেন, বুটজুতো পরে খটখটিয়ে চলেন।তফাৎ কোথায়? মাকে জিজ্ঞেস করি।মার সরল সমাধানঃ পুলিশ নিজের দেশের লোককে মারে, মিলিটারি দেশের দুশমনকে। কাজেই মিলিটারি, মানে তোমার বাবা, ভাল। তাই মিলিটারি সম্মান পায়, পুলিশ পায় না।একটু বড় হয়ে কানে এলঃ পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশ বারো।অর্থাৎ পুলিশ শব্দটির সঙ্গে মারামারি ব্যাপারটা কেমন যেন জড়িয়ে রয়েছে।ময়দানে ফুটবল ম্যাচ নিয়মিত দেখতে যান, অথচ টিকিটের লাইনে ঘোড়সোয়ার পুলিশের তাড়া কিংবা ব্যাটনের গুঁতো খাননি এমন কেউ আছেন কি?কিন্তু দক্ষিণ কোলকাতার নাকতলায় লুঙ্গি পরে বাজার করা পুলিশ অনুকুলবাবুকে দেখে কোনদিনই ভয় পাইনি কেন?ষাটের দশকের শেষে বাংলাবন্ধের দিনগুলোতে খাঁকি হাফপ্যান্ট পরে শুকনো মুখে লাঠি ঘোরাতে দেখেও না।বরং নাদাপেটে অমন পোশাকে ওঁকে কমেডিয়ান জহর রায়ের মত লাগত।এল -সত্তরের দশক, মুক্তির দশক।কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে গলিতে, পুলিশ মরছে। মরছে আর মারছে, মারছে আর মরছে।তারপর?রক্তমাখা অস্ত্রহাতে যত রক্তআঁখি, শিশুপাঠ্য কাহিনিতে থাকে মুখ ঢাকি।শুনেছি, বিয়ের বাজারে জামাই হিসেবে পুলিশদের বাজারদর তখন বেশ পড়ে গিয়েছিল।ছত্তিশগড়ে এসে দেখি পুলিশজামাতা পেয়ে শ্বশুরের নাক বেশ উঁচু হচ্ছে। মাইনে যাই হোক উপরি টুপরি ভালই, মেয়ে সুখে থাকবে।উটের নুনু ঠিক কোনখানে?ট্রেনে করে আমরা কজন ভোপাল যাচ্ছি একটা ইন্টারভিউ দিতে। দুর্গ থেকে উঠলেন একজন পুলিশ অফিসার। কথায় কথায় বললেনঃ আজকাল যেসব ছেলেছোকরার দল নতুন নতুন গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হয়ে পুলিশের চাকরিতে আসছে এরা সব ভুষিমাল, কিস্যু জানে না।কত করে বোঝাই যে দিনকাল পাল্টেছে, হিসেব করে চল। পুরো মাইনেটাই ব্যাংকে জমা কর, আর এদিক সেদিক করে যা পাবে তাই দিয়ে সংসার চালাও। কিন্তু শোনে কে! এরা জানে শুধু ছুটি আর বদলির দরখাস্ত লিখতে। কোন্ও বাস্তববুদ্ধি নেই। জিজ্ঞেস করুন: উটের নুনু ঠিক কোনখানে? বলতে পারবে না।পশুর অ্যানাটমি নিয়ে অমন উচ্চস্তরের জ্ঞানলাভের কথা শোনাচ্ছিলাম কোরবা শহরের সদর থানা বা কোতোয়ালির থানেদার উত্তম সিং রনধাওয়াকে। উনি রবিশংকর ইউনিভার্সিটিতে আমার সিনিয়র ছিলেন।উত্তমজী হাসলেন না।গম্ভীর হয়ে বললেনঃ রায়, একটা কথা ভেবেছিস, আমরা পুলিশেরা কত একা? আমাদের সমাজ কেন এড়িয়ে চলে? সেদিন রকের আড্ডায় বসে হেসে গড়াচ্ছিলি। কিন্তু আমি গিয়ে যেই বললাম ক্যা চল রহা ভাই? হমে ভি বাতাও, আমি্ও তোমাদের সঙ্গে হেসে নিই; ব্যস্, তোদের মুখে কুলুপ এঁটে গেল। কেন? পুলিশের কি হাসি পেতে নেই?হোলির দিনের কথাই ধর। সবাই একে তাকে রং মাখাবে, কিন্তু পুলিশ বাদ। আমরা সেদিন ডিউটি দেব, শান্তিরক্ষা করব।আমাদের ছুটি পরের দিন।সেদিন পুলিশেরা খালি নিজেদের মধ্যে হোলি খেলবে।মানে, পুলিশেরা খালি খাঁকি বৌদিদের রং মাখাবে। কেন? আমাদের কি পাড়ার অন্য বৌদিদের রং মাখাতে ইচ্ছে করে না?আর দেখেছিস, হেড কোয়ার্টারে থাকলে আমাদের কোন ছুটি নেই!আমাকে যদি তোর মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে যেতে হয় তো রোজনামচায় তোদের পাড়ার কাছে কোথাও ইনস্পেকশনে বা ইনভেস্টিগেশনে যাচ্ছি দেখিয়ে রেজিস্টারে এন্ট্রি করে তবে যেতে পারব।আমাদের শালা রাতে ঘুম পেতে নেই। পরপর দুদিন না ঘুমোলেও কিছু হয় না!এসব তো সামান্য ব্যাপার। আমাদের বৌদের জন্যেই তোদের বাঙালী কবি লিখে গিয়েছেন: ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।এরপর কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেলে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বে মানবাধিকার কমিশন।ওদের হিসেবে চোরডাকাত, খুনি, টেররিস্ট সবারই হিউম্যান রাইটস্ আছে, নেই শুধু পুলিশের। আমরা তো হিউম্যান নই।ওরা শেখাবে: অপরাধিদের বাবাবাছা, আপনি আজ্ঞে করে কথা বলতে হবে।ওরা আমার মা বোন তুলে মুখখারাপ করলে্ আমাদের বাধ্য ছাত্রের মত সোনামুখ করে শুনতে হবে, ওদের পেঁদিয়ে বিন্দাবন দেখানো চলবে না।আমি বলিঃ আপনি দাদা হিউম্যান রাইটস্ এর ব্যাপারটা কিচ্ছু বোঝেন নি।তারপর ঝাড়ি একটা মাস্টারজি মার্কা লম্বা লেকচার। রাজা জন, ম্যাগনাকার্টা, রাষ্ট্রসংঘ, চার্টার অফ হিউম্যান রাইটস্ পেরিয়ে সোজা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে এসে দম নিই।রনধা্ওয়াজি আমাকে টেরচা চোখে দেখতে লাগলেন।আমার উৎসাহ কমে না। বলিঃ দোষ আপনার একার নয়, দোষ আপনাদের সিস্টেমের।ভাবটা হল যার একমাস পরে ফাঁসি হবে তার এখন থেকেই খাওয়া বন্ধ করে দাও।সরকারের খরচা বাঁচে।এখানেই মানবাধিকারের প্রশ্ন।আচ্ছা, আপনাকে দিয়েই শুরু করি। এই থানার লক আপে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা ব্যবস্থা আছে?: বিলকুল আছে; যা না, এগিয়ে গিয়ে দ্যাখ। দুধনাথ, রায়সাবকো ইঁহা কী ব্যবস্থা জরা দিখা দো।দুধনাথ বা থানার মুন্সীজির সঙ্গে ওঁর চোখে চোখে কিছু কথা হয়।ও আমাকে একটা লক আপের দিকে নিয়ে গিয়ে তালা খোলে।বলে, যান, দেখুন গে।চোখে পড়ে কোণের দিকে একটা গোটানো কম্বল আর একটা এলুমিনিয়ামের সানকি। কিন্তু বাথরুম পায়খানার ব্যবস্থা? কিছুই তো দেখছিনে!কানে আসে থানেদারের কণ্ঠস্বরঃ সবই আছে, আরেকটু এগিয়ে যা, ঠিক দেখতে পাবি।ভেতরে কোন বাল্ব নেই।তবু দু পা এগিয়ে যাই।এমন সময় পেছনে আওয়াজ, ঘড় ঘড় ঘড়াৎ।দুধনাথ লক আপের গেট বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। বলি: রনধাওয়াজি, এটা কি হচ্ছে? অ্যাই দুধনাথ, তালা খোল, এসব ইয়ার্কি ভাল লাগে না।দুধনাথ বোবা চোখে তাকায়, তালা খোলার কোন চেষ্টা করে না।থানেদার উবাচঃ এটা ইয়ার্কি কে বললে?আমার গলা শুকোতে থাকে, এর মানে? মামার বাড়ি নাকি!: মামার বাড়ি কি শ্বশুরবাড়ি ভাল করে বুঝবি যখন ভাবীজি এসে তোকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন।: আমার অপরাধ?: অপরাধ অনেক।এক, কোরবা বাজারের সব্জিওয়ালি জামুনবাঈকে যৌনসংসর্গের জন্য প্ররোচিত করা।দুই, উক্ত জামুনবাঈ অস্বীকূত হইলে তাহার সহিত জোরজবরদস্তি করা।তিন, প্রকাশ্য বাজারে তাহার গায়ে হাত তোলা।চার, উহার চিৎকার শুনিয়া বাজারে কর্তব্যরত পুলিশ সিপাহী দুধনাথ সিং শান্তিরক্ষা করিতে গেলে তাহাকে বাধা দেওয়া। পাঁচ, তাহাকে চপেটাঘাত করা। ছয়, তাহাকে মাতূগমনকারী নরাধম বলিয়া অভিহিত করা।দুধনাথ!এবার রায়জিকে এই ছয় অপরাধ পেনাল কোডের কোন কোন ধারায় দন্ডনীয় তা বুঝিয়ে দে।দুধনাথ বলির সময় পুরুতঠাকুরের মন্ত্র পড়ার মত কিছু অং বং চং বলে।আমার মাথা ঘুরতে থাকে, হাত পা কাঁপে। কাঁপা গলায় শেষ চেষ্টা করি।: এ সব ডাহা মিথ্যে। সব জানেন, শুধু শুধু ।: সত্যি মিথ্যে আদালত ঠিক করবে।:মানে? আপনি আমাকে কোর্টে তুলবেন!চালান পেশ করবেন?: আলবাৎ, আইন আইনের পথে চলবে।: প্রমাণ করতে পারবেন? তাছাড়া কে এই জামুনবাঈ? আমি চিনি না।আমি তো হাটবাজার করিনে, আমার স্ত্রী করে।কাজেই আপনার ওসব গুলপট্টি ওকে খাওয়াতে পারবেন না। ও আমাকে ভাল করে চেনে।: এগজ্যাক্টলি! বৌদি নিজে বাজার করেন। তাই তরকারিওয়ালি জামুনবাঈকে ভাল করে চেনেন।হার্ডকোর রেণ্ডি। আর ও হচ্ছে পুলিশের খবরি! গোপন খবর দেয়। মাসোহারা পায়। পুলিশের যেমনটি চাই তেমনই সাক্ষী দেবে।তারপর বৌদি তোকেও নতুন করে চিনবেন।চিন্তা করিসনে। যে কদিন জামিন না হয় তোর মানবাধিকারের হিসেবে সব সুবিধে পাবি।জামাকাপড়, টুথব্রাশ, খবরের কাগজ।বাড়ি থেকে খাবার আসবে। উকিলের সাথে কথা বলতে পারবি।আমার হাঁটু আর ভার সামলাতে পারে না, গরাদের ওপাশে মাটিতে বসে পড়ি।নিজের গলার স্বর চিনতে পারিনে।একটা ফ্যাঁসফেঁসে গলা বলেঃ আমায় ছেড়ে দিন, ঘাট হয়েছে।:দুধনাথ! লক আপের তালা খুলে দে। রায়কে বাইরে নিয়ে আয়। ও আর কোনদিন থানায় বসে মানবাধিকার নিয়ে লেকচার দেবে না।আরে! বেচারার হাত পা কাঁপছে।যা, ওকে মোটরবাইকে বসিয়ে বাসস্টপে ছেড়ে দে।দুধনাথ বলেঃ চলুন রায়জি, গাড়ি স্টার্ট করছি।________________________________________গিন্নি দেখি আরও এককাঠি সরেস। তৎক্ষণাৎ আলমারি খুলে একটা বাঁধানো খাতা বার করল, তাতে কোলাজের ঢংয়ে খবরের কাগজের নানান কাটিং আঠা দিয়ে সাঁটা।:পুলিশ কী পারে আর কী পারে না দেখে না্ও।না:, আমি হাল ছাড়িনি। পুলিশ সম্বন্ধে শেষ কথা বলার সময় এখন্ও আসে নি।মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন যে সংসদে একতূতীয়াংশ মহিলা হলে সেশন অনেক সংযত ও উন্নতমানের হবে।আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে ওখানে সনিয়া গান্ধী, রেণুকা চৌধুরি, সুষমা স্বরাজ, বূন্দা কারাতদের সংখ্যা বেড়ে গেলে অমুকভাইয়া বা তমুকউদ্দিনদের হাতের গুলি ফোলানো বা বিরোধীদের সংগে শকারবকার বিনিময়ে কিছুটা ভাটা পড়বে।মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।তাহলে পুলিশ কেন বাদ যায়?ইউরেকা! চাই পুলিশবাহিনীতে তেত্রিশ পার্সেন্ট মহিলা আরক্ষণ! তবেই পুলিশি বর্বরতা কমবে, পুলিশ আরও গণমুখী হবে।মার দিয়া কেল্লা! এই আইডিয়াটা লিখে পাঠাতে হবে।পাঠাবো দুজনকে, মাননীয়া কিরণ বেদী ও মাননীয়া মমতা ব্যানার্জীকে।কদিন পরে যেতে হল থানায়।রাতের অন্ধকারে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে। হামলাকারীরা পরিচিত। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক দলের চাপে পুলিশ ডায়েরি নিচ্ছে না। থানায় মুন্সীজি বললেন: দেখুন, আপনি যে ভাবে লিখে এনেছেন তাতে কেসটা উইক হয়ে যাবে।শব্দগুলো আর ঘটনার ক্রমপরম্পরা একটু বদলে নিলে এটাই অন্তত: হাজার চল্লিশের কেস, কী বুঝলেন? আর আপনি যেমন লিখে এনেছেন তাতে মাত্র দশহাজার, ক্যা সমঝে আপ?বলতে লজ্জা করছে, আমাদের এত বড় থানার স্টেশনারি খরচা বাবদ মাসিক বরাদ্দ মাত্র চল্লিশ টাকা! সেতো মাসের পহেলা হপ্তাতেই শেষ হয়ে যায়। এখন মাসের কুড়ি তারিখ। কাজেই কাগজ কার্বন পেপার ইত্যাদি কেনার জন্যে কিছু দিন, আর স্টাফদের জন্যে নাস্তা। তারপর দেখুন মজা!শালেলোগোকোঁ হাতকড়ি লগওয়াকে দোচার লাথমুক্কা লাগাতে হুয়ে ঘর সে খিঁচকর লায়েংগে। তব না উনকে ঘরওয়ালোঁ নে হাতকড়ি খুলওয়ানে কে লিয়ে অউর কুছ মালপানি দেঙ্গে?(ব্যাটাদের হাতকড়ি পরিয়ে ঠুঁসোলাথ মারতে মারতে ঘর থেকে টেনে আনা হবে, তবে তো ওদের ঘরের লোকজন কিছু মালপানি উপুড় করবে?) আমি পকেট থেকে দুটো নম্বরি নোট বের করে চা জলখাবারের নামে একজন সেপাইয়ের হাতে দিলাম।এমনসময় থানার ভেতরে শোনা গেল এক চাপা উল্লাসধ্বনি।তাকিয়ে দেখি একজন সেপাইয়ের পেছন পেছন সলজ্জমুখে ঢুকছেন দুই মহিলাপুলিশ।ভাবটা যেন দ্বিরাগমনের পর নতুন বৌ ছোটবোনকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরছে। তক্ষুণি চাওয়ালা এসে সবাইকে চায়ের গেলাস ধরিয়ে দিল।তারপর পাশের একটি কামরায় ছোটবোনপুলিশ একটু গড়িয়ে নিলে।আর পেছনের বারান্দায় জনতা স্টোভ জ্বেলে বৌপুলিশ সবার জন্যে খিচুড়ি চড়িয়ে দিল।আমি আলাপ জমাই।আপনারা কোন কেসের ব্যাপারে এসেছেন?: বড়সড় সিঁদেল চুরির কেস।কোরবা শহরে কেলো করে জবড়াপাড়ায় গা ঢাকা দিয়ে আছে।দলের লীডার একজন মেয়েছেলে, তাই আমরা এসেছি।: আপনার বেশ সাহস তো!:দূর! একা যাব নাকি?দুজন সেপাইয়ের মোটরবাইকের পেছনে বসে যাব।উনি শরীরে ঢেউ তুলে হাসলেন।মহিলাদের উপস্থিতি যে থানাকে একটু সভ্যভব্য করে তুলবে আমার এই বিশ্বাস দূঢ হল।বিকেলে হঠাৎ উদয় হলেন আমার কলেজ জীবনের দুই দোস্ত, বিজয় আর প্রসাদ।রাত্তিরে গিন্নির কূপায় খ্যাটন বেশ ভাল হল।মে মাস। গরমকাল।বেশ গরম হাওয়া দিচ্ছে, ঘুম আসছে না।তাই আমরা তিনবন্ধু রাস্তায় একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেরোলাম।পায়ে পায়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছি। রাত বারোটা, ফিরতে হবে।পাড়াটা একটু নির্জন,আলোগুলো প্রায় নিভে গেছে।হঠাৎ কেউ যেন কঁকিয়ে এল।কোথায়? কোনদিকে, নাকি মনের ভুল!এবার একটা আর্তনাদ, তারপর চাপা গোঙানি।কোথাও কোন ভুল নেই, আওয়াজটা আসছে সামনের কোতোয়ালি থানা থেকে।চারদিকের নিকষকালো অন্ধকারের মধ্যে প্রায় দেড়শো মিটার দূরের থানার আলোজ্বলা হলঘর টিভির পর্দার মত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুজন সেপাই একটা গেঁয়ো লোকের হাত টেনে ধরে রয়েছে আর একটা খেঁটে লাঠি দিয়ে তাকে মেরে পাটপাট করে দিচ্ছে সকালে আলাপ হওয়া সেই বৌপুলিশ!মারতে মারতে খুলে যাচ্ছে তার শাড়ি।হাঁফাতে হাঁফাতে কাপড়চোপড় সামলে নিয়ে জলটল খেয়ে আবার মার!না, মহিলা পুলিশমন্ত্রী ও শ্রীমতী কিরণ বেদীকে সেই চিঠি আজও পোষ্ট করা হয়ে ওঠেনি।ভয়ের রং খাঁকি!বর্ষশেষ।৩১ ডিসেম্বরের রাত।মোবাইল ও এসএমএস এর দৌলতে নিমন্ত্রণ পেয়ে গিন্নির ও বাচ্চাদের চোখ এড়িয়ে পৌঁছেচি আমার এক বন্ধু গজ্জুশেঠের হোটেলে।মধ্যরাতে নববর্ষ বরণ করতে হবে।জড়ো হয়েছি আমরা ক’জন্– কলেজজীবনের জনাদশেক বন্ধু।একটা হলঘরে মাটিতে গদি আঁটা বিছানা, তাকিয়া।সামনে প্লেটেসাজানো
ফিশফ্রাই,কাবাব,টিকিয়া ইত্যাদি পাকস্থলীকে বিরক্ত করার মত কিছু খাদ্যদ্রব্য।গেলাসে গেলাসে রঙিন জল।অদীক্ষিতদের জন্যে কোকস্।কিন্তু একি!একপাশে হাসিমুখে বসে জনাদুই খাঁকি পোশাক।কেন?এদের কে ভিসা দিয়েছে?আমার বাঁকা ভুরু দেখেই গজ্জুশেঠ সাফাই গাইল– ‘এরা দুজন আমার বিশেষ অতিথি’।আমি রাগ চাপতে পারলাম না।এখন এদের সামনে মেপে মেপে কথা বলতে হবে।খেয়াল রাখতে হবে আমিষ চুটকিগুলো পলিটিক্যালি কারেক্ট হচ্ছে কি না! কী চাপ!গজ্জু হেসে বলল–‘ শান্ত হয়ে বস দিকি!একটু পরে টের পাবি যে এঁরা লোকাল থানার কেউ ন’ন।বিলাসপুরেই বাড়ি, ছুটিতে এসেছেন।কাজেই বিশ্বাস করতে পারিস যে এঁরা আমার হোটেলে হপ্তা নিতে আসেননি।এসেছেন পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে’।লম্বাটে চেহারার তিওয়ারি বললেন– বুঝতে পারছি খাঁকি পোশাকে আপনার এলার্জি। বেশ, খুলে রাখলাম’। এই বলে তিনি গেঞ্জি গায়ে বসে পড়লেন।সবাই খেলার ক্রিকেট মাঠের ‘হাউজ দ্যাট’ এর মতন চেঁচিয়ে উঠল।চুটকি, পান–ভোজন, একে তাকে চিমটি কাটা–– এর মধ্যে কেউ গান ধরল।দু’পাত্তর চড়ানোর ফলে ওর গলা যেন ভুল স্পীডে চলা পঁচাত্তর আরপিএম এর গ্রামোফোন রেকর্ড।পাবলিক হেসে গড়াচ্ছে।কেউ বলছে গুলাম আলির গজল চাই তো কেউ বলছে সুফি শুনবো।এর মধ্যে দেখি গজ্জু ওই তিওয়ারির কানে কানে কী যেন গুজগুজ ফুসফুস করছে আর পুলিশ–তিওয়ারি নতুন কনেবৌটির মত সলজ্জ মাথা নাড়ছে।তারপর পাশের কামরা থেকে এসে গেল একটি হারমোনিয়াম। আর তাজ্জব কী বাৎ, গজব কী বাৎ, ওই বাদ্যযন্ত্রটি এসে নামল সোজা ওই পুলিশ ইনস্পেক্টরের সামনে!তাকিয়ে দেখি হারমোনিয়ামে হাত ছোঁয়াতে্ই ওর চেহারা বদলে গেছে।খানিকটা বেলো করে চাপা গলায় একটু আলাপ করে ধরল–‘তুম আপনি রঞ্জোগম, আপনি পরেশানি মুঝে দে দো।কুছ দিন কে লিয়ে ইয়ে নিগেবানি মুঝে দে দো’।আমরা ভুলে গেলাম গালগল্প। সুর চড়ছে।‘তোমার সব ব্যথার বোঝা, দু:খের ভার আমায় দাও’।গলা ছুঁয়ে যাচ্ছে তারার কোমলগান্ধার।‘ম্যায় দেখুঁ তো দুনিয়া তুমে ক্যায়সে সতাতী হ্যায়?কুছ দিনকে লিয়ে ইয়ে নিগেবানি মুঝে দে দো’।আমার বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে।‘দেখি তো তোমায় কে এত কষ্ট দেয়?ক’দিনের জন্যে তোমার সব ভার আমায় দাও’।কিসের এত কষ্ট?খাঁকি পোশাক তো দু:খ দেওয়ার জন্যে, পাওয়ার জন্যে তো নয়।সাতদিন পর সাতসকালে স্টেশন গেছি, কোলকাতা থেকে মা আসছেন।দেখি সেই তিওয়ারিজি।পরনে যথারীতি খাঁকি ধরাচূড়া। আমাকে দেখেও দেখলেন না প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কামরার জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে আদর করে যাচ্ছেন একটি ষোড়শীকে, আর কিমাশ্চর্য্যম!রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চলেছেন। কাঁধে চাপ পড়তেই দেখি গজ্জু শেঠ।বন্ধুর জন্যে নিয়ে এসেছে কিছু আপেল আর কমলালেবু।কী ব্যাপার রে? গজ্জু ইশারায় সরে আসতে বলে।তারপর ব্যাখ্যা করে:তিওয়ারির হয়েছে মাওবাদী বেল্টে ট্রান্সফার।অনেক ধরাধরি করেও আটকাতে পারেনি।এদিকে ওই একটি মেয়ে। ভিলাইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।বাপের সঙ্গে দেখা করে ফিরে যাচ্ছে।পরশুদিন । তি্ওয়ারি গিন্নি স্বামীর ললাটে তিলক লাগিয়ে ‘জয়যাত্রায় যাও গো’ বলে বস্তারের নারায়ণপুরের জন্যে টা–টা করবে আর প্রার্থনা করবে যেন জগদলপুরের দন্তেশ্বরীমাতা স্বামীকে ভালোয় ভালোয় বছরখানেকের মধ্যে বিলাসপুরে ফিরিয়ে দেন।আজকাল ছত্তিশগড়ে পুলিশের জীবনের কোন ভরসা নেই যে!আমি পুলিশকে আর ডরাইনে; তা সে ধরাচূড়া পরেই থাকুক বা না পরে।বুঝে গেছি যে খাঁকি হল পুলিশের সাপের খোলস, ওদের প্রোটেকশন।কিন্তু পুলিশ সামনে এলে মনে মনে প্রয়াত কবি তুষার রাযের দেওয়া মন্ত্রটি বিড়বিড় করি:‘পুলিশ!ওরে পুলিশ!কবির সামনে আসার আগে টুপিটা তোর খুলিস্’।============================*******======================================অফবিট
চারপাশে ঘটতে থাকা অদ্ভুত মজার ঘটনা ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়| আপনাদের জন্য এরকম ই কিছু ট্রেন্ডিং নিউজের তাজা আপডেট| অ্যামেরিকায় আমরা সরকারের নয় ভগবানের পুজো করি - ট্রাম্পের এই দাবির মুহতোড় জবাব মুসলিম মহিলার আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বিতর্ক যেন সমার্থক| ট্রাম্প য্খনই যাই করুন না কেন সেটাই বিতর্ক সৃষ্টি করে| সেটা তাঁর ব্ক্তৃতা হোক‚ বা করমর্দন‚ বা স্বাক্ষর! এবং তাঁর ট্যুইট| খুব সম্প্রতি ট্রাম্প তারই এক নিদর্শনরাখলেন|
বাঁধাকপির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাপ! না দেখতে পেয়েখেয়ে ফেললেন এরা ! ৩৫ বছরের আফ্জান ইমাম আর তার মেয়ে ১৫ বছরের আমনা বাঁধাকপির তরকারি রেঁধেছিল| গোল বাধল খাওয়ার সময়| খাবারের স্বাদে সন্দেহ হওয়ায়‚ তারা অবশিষ্ট তরকারি পরীক্ষা করে দেখে এবং আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করে - সেখানে একটি সাপের দেহাংশ মিশে আছে! ইনস্টাগ্রামে ভালো রোলে সুযোগ চাইলেন নীনা গুপ্তা, অনুপ্রাণিত এই সব ব্ড় স্টাররাও। বুনিয়াদ-খ্যাত নীনা গুপ্তাকে মনে আছে| বিভিন্ন সিরিয়াল এবং সিনেমায় তিনি তাঁর অভিনয় প্রতিভার জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়া| সম্প্রতি তাঁর একটি পোস্ট এবং সেটিকে উদ্ধৃত করে তাঁর মেয়ের কমেন্ট দৃষ্টি কেড়ে নিল সবার| প্রশংসায় প্রিয়াঙ্কা চোপড়াও| ভারতবর্ষের কোন আকর্ষণে ভারতের প্রেমে পড়লেন এই বিদেশিনী? ভারতের ঐতিহ্যই হল পরকে আপন করে নেওয়া| এদেশের সৌভ্রাতৃত্ববোধ‚ উৎসবময় জীবন ভিনদেশীদের বার বার এই মাটিতে আকর্ষণ করে| প্রমাণ করে ভাষা‚ সংস্কৃতি‚ ধর্ম এখনও এখানে গৌণ|অফবিট
চারপাশে ঘটতে থাকা অদ্ভুত মজার ঘটনা ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়| আপনাদের জন্য এরকম ই কিছু ট্রেন্ডিং নিউজের তাজা আপডেট| অ্যামেরিকায় আমরা সরকারের নয় ভগবানের পুজো করি - ট্রাম্পের এই দাবির মুহতোড় জবাব মুসলিম মহিলার আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বিতর্ক যেন সমার্থক| ট্রাম্প য্খনই যাই করুন না কেন সেটাই বিতর্ক সৃষ্টি করে| সেটা তাঁর ব্ক্তৃতা হোক‚ বা করমর্দন‚ বা স্বাক্ষর! এবং তাঁর ট্যুইট| খুব সম্প্রতি ট্রাম্প তারই এক নিদর্শনরাখলেন|
বাঁধাকপির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাপ! না দেখতে পেয়েখেয়ে ফেললেন এরা ! ৩৫ বছরের আফ্জান ইমাম আর তার মেয়ে ১৫ বছরের আমনা বাঁধাকপির তরকারি রেঁধেছিল| গোল বাধল খাওয়ার সময়| খাবারের স্বাদে সন্দেহ হওয়ায়‚ তারা অবশিষ্ট তরকারি পরীক্ষা করে দেখে এবং আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করে - সেখানে একটি সাপের দেহাংশ মিশে আছে! ইনস্টাগ্রামে ভালো রোলে সুযোগ চাইলেন নীনা গুপ্তা, অনুপ্রাণিত এই সব ব্ড় স্টাররাও। বুনিয়াদ-খ্যাত নীনা গুপ্তাকে মনে আছে| বিভিন্ন সিরিয়াল এবং সিনেমায় তিনি তাঁর অভিনয় প্রতিভার জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়া| সম্প্রতি তাঁর একটি পোস্ট এবং সেটিকে উদ্ধৃত করে তাঁর মেয়ের কমেন্ট দৃষ্টি কেড়ে নিল সবার| প্রশংসায় প্রিয়াঙ্কা চোপড়াও| ভারতবর্ষের কোন আকর্ষণে ভারতের প্রেমে পড়লেন এই বিদেশিনী? ভারতের ঐতিহ্যই হল পরকে আপন করে নেওয়া| এদেশের সৌভ্রাতৃত্ববোধ‚ উৎসবময় জীবন ভিনদেশীদের বার বার এই মাটিতে আকর্ষণ করে| প্রমাণ করে ভাষা‚ সংস্কৃতি‚ ধর্ম এখনও এখানে গৌণ| সফরনামা ভ্রমণের ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে শব্দ এবং ক্যামেরায় বন্দী করে আপনাদের সামনে তুলে ধরছেন আড্ডার মুসাফিরেরা| অচেনা অচানকমারের অন্দরে ::২
বারো কিলোমিটার পথ উজিয়ে যখন বাংলোয় এসে পৌঁছলাম, তখন বেশ ঠাণ্ডা আমেজ বাতাসে। মাথার উপর দূষণহীন মস্ত আকাশের চাঁদোয়ায় পরিচিত অপরিচিত তারাদের রকমারি নক্শা। কিছুক্ষণ পরেই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল পূর্ণিমার নিটোল চাঁদ। নরম জ্যোৎস্নার আলোয় মায়াবী হয়ে উঠল জঙ্গলমহল। অচেনা অচানকমারের অন্দরে ::১
যখন ঘোষণা করলাম এবার বসন্তে 'অচানকমার্' যাব‚ জোড়া জোড়া চোখ তখন কপাল ছাড়িয়ে সিলিং এ‚ প্রবল ফিসফিসানি‚ ঘোরতর সন্দেহ! এটা আদৌ কোন জঙ্গল নাকি সলমন খানের কোন ভিলেন পটকানো প্যাঁচ| বিস্তর ওকালতি করে শেষ পর্য্যন্ত বাঘা বাঘা জঙ্গলকে পর্য্যুদস্ত করে গণভোটে জিতিয়ে আনা গেল ছত্তিশগড়ের এই অপরিচিতাকেই| বৃষ্টিভেজা এক শৈলশহরে কয়েকদিন আমার বহুকালের ইচ্ছে ছিল বৃষ্টির সময় একটা হিল স্টেশনে বেড়াতে যাই| সেখানে গিয়ে কুয়াশা ঘেরা সবুজ বনানীর মধ্যে দিয়ে অসংখ্য জলপ্রপাতের কলতান শুনতে শুনতে হেঁটে বেড়াই| পশ্চিমবঙ্গে বা সিকিমে এরকম জায়গা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু আমি আরও একটু অচেনা শৈল শহরে যেতে চাইছিলাম| অম্বিকা কালনা কালনা একটি ছোট মন্দির নগর। ভাগীরথীর পশ্চিম পারে অবস্থিত বর্ধমান জেলার কালনা সাব ডিভিশনের অংশ। বর্ধমান জেলার সীমায় অবস্থিত নগরটির থেকে হুগলী ও নদীয়া জেলার বর্ডার খুব কাছেই। প্রাচীন অম্বিকা দেবীর মন্দিরের জন্য এই জায়গাটির নাম অম্বিকাকালনা।
সফরনামা ভ্রমণ পিপাসু বাঙালী সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েন চেনা অচেনার উদ্দেশ্যে| সেই সব ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে শব্দ এবং ক্যামেরায় বন্দী করে আপনাদের সামনে তুলে ধরবেন আড্ডার মুসাফিরেরা| অচেনা অচানকমারের অন্দরে ::২
বারো কিলোমিটার পথ উজিয়ে যখন বাংলোয় এসে পৌঁছলাম, তখন বেশ ঠাণ্ডা আমেজ বাতাসে। মাথার উপর দূষণহীন মস্ত আকাশের চাঁদোয়ায় পরিচিত অপরিচিত তারাদের রকমারি নক্শা। কিছুক্ষণ পরেই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল পূর্ণিমার নিটোল চাঁদ। নরম জ্যোৎস্নার আলোয় মায়াবী হয়ে উঠল জঙ্গলমহল। অচেনা অচানকমারের অন্দরে ::১
যখন ঘোষণা করলাম এবার বসন্তে 'অচানকমার্' যাব‚ জোড়া জোড়া চোখ তখন কপাল ছাড়িয়ে সিলিং এ‚ প্রবল ফিসফিসানি‚ ঘোরতর সন্দেহ! এটা আদৌ কোন জঙ্গল নাকি সলমন খানের কোন ভিলেন পটকানো প্যাঁচ| বিস্তর ওকালতি করে শেষ পর্য্যন্ত বাঘা বাঘা জঙ্গলকে পর্য্যুদস্ত করে গণভোটে জিতিয়ে আনা গেল ছত্তিশগড়ের এই অপরিচিতাকেই| বৃষ্টিভেজা এক শৈলশহরে কয়েকদিন আমার বহুকালের ইচ্ছে ছিল বৃষ্টির সময় একটা হিল স্টেশনে বেড়াতে যাই| সেখানে গিয়ে কুয়াশা ঘেরা সবুজ বনানীর মধ্যে দিয়ে অসংখ্য জলপ্রপাতের কলতান শুনতে শুনতে হেঁটে বেড়াই| পশ্চিমবঙ্গে বা সিকিমে এরকম জায়গা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু আমি আরও একটু অচেনা শৈল শহরে যেতে চাইছিলাম| অম্বিকা কালনা কালনা একটি ছোট মন্দির নগর। ভাগীরথীর পশ্চিম পারে অবস্থিত বর্ধমান জেলার কালনা সাব ডিভিশনের অংশ। বর্ধমান জেলার সীমায় অবস্থিত নগরটির থেকে হুগলী ও নদীয়া জেলার বর্ডার খুব কাছেই। প্রাচীন অম্বিকা দেবীর মন্দিরের জন্য এই জায়গাটির নাম অম্বিকাকালনা।
রেসিপি রেসিপিলিখুন
আড্ডার রাঁধুনীদের নিজের কিচেনে তৈরী রান্নার রেসিপি এখানে| ট্রাই করে দেখুন নিজের হেঁশেলে| আপনিও শেয়ার করুন| চিকেন টেন্ডারস উইথ ম্যাশডপোটেটো
পনীর টিক্কা মসালা স্বাস্থ্যকর পিৎজা পিন্ডি ছোলে রেসিপি রেসিপিলিখুন
আড্ডার রাঁধুনীদের নিজের কিচেনে তৈরী রান্নার রেসিপি এখানে| ট্রাই করে দেখুন নিজের হেঁশেলে| আপনিও শেয়ার করুন| চিকেন টেন্ডারস উইথ ম্যাশডপোটেটো
পনীর টিক্কা মসালা স্বাস্থ্যকর পিৎজা পিন্ডি ছোলে রেসিপি রেসিপিলিখুন
আড্ডার রাঁধুনীদের নিজের কিচেনে তৈরী রান্নার রেসিপি এখানে| ট্রাই করে দেখুন নিজের হেঁশেলে| আপনিও শেয়ার করুন আপনার পছন্দের ডিসগুলি| 2, 'col-xs-12 hidden-sm hidden-md hidden-lg nogutter': $index()Details
Copyright © 2023 ArchiveBay.com. All rights reserved. Terms of Use | Privacy Policy | DMCA | 2021 | Feedback | Advertising | RSS 2.0